বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র ফারদিন নূর পরশ (২৪) আত্মহত্যা করেছেন বলে দাবি করেছে পুলিশের এলিট ফোর্স র‍্যাব। তাদের দাবি, ডেমরার সুলতানা কামাল ব্রিজ থেকে স্বেচ্ছায় নদীতে ঝাঁপ দেন ফারদিন।

সিসিটিভি ফুটেজ, ডিজিটাল ফুটপ্রিন্টসহ অন্যান্য সব আলামত বিবেচনায় নিয়ে এই সিদ্ধান্তে এসেছে র‌্যাব। তারপরও সংস্থাটির বক্তব্য, ফারদিনের মৃত্যু সংক্রান্ত অন্য কোনো সূত্র বা আলামত পাওয়া গেলে, তা বিবেচনায় নিয়ে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা তার কার্যক্রম পরিচালনা করবেন।

ফারদিনের মৃত্যুর বিষয়ে তদন্তের অগ্রগতি জানাতে বুধবার (১৪ ডিসেম্বর) রাত ৭টা ৫০ মিনিটের দিকে কারওয়ান বাজার র‍্যাব মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করে র‌্যাব। এতে ব্রিফ করেন র‍্যাব সদর দপ্তরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ফারদিন নূর পরশের নিখোঁজের ঘটনায় গত ৫ নভেম্বর রাজধানীর রামপুরা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন বাবা কাজী নুর উদ্দিন। জিডিতে উল্লেখ করেন, গত ৪ নভেম্বর বিকেল থেকে নিখোঁজ রয়েছেন ফারদিন। এর পরিপ্রেক্ষিতে অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও র‌্যাব নিখোঁজ শিক্ষার্থীকে খুঁজে বের করতে তদন্ত শুরু করে। গত ৭ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদী থেকে একটি মরদেহ উদ্ধার করে স্থানীয় নৌ-পুলিশ।

পরবর্তী সময়ে জানা যায়, মরদেহটি নিখোঁজ বুয়েট শিক্ষার্থী ফারদিন নূর পরশের। মরদেহটি উদ্ধারের পর ফারদিনের বাবা কাজী নুর উদ্দিন রাজধানীর রামপুরা থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।

ঘটনাটি চাঞ্চল্যকর হওয়ায় র‌্যাব মৃত্যুর রহস্য উদ্ঘাটন করে জড়িতদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে।

ফারদিন নূর পরশের মৃত্যুর ঘটনায় র‌্যাব পারিবারিক সূত্র, অধিকতর তথ্য প্রযুক্তির বিশ্লেষণ, সিসিটিভি ফুটেজসহ স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রের আলোকে রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করে।

তদন্তে প্রযুক্তির সহায়তায় জানা যায়, গত ৪ নভেম্বর বিকেল ৩টার দিকে ডেমরার কোনাপাড়া নিজ বাসা থেকে পরীক্ষার কথা বলে বুয়েটের হলের উদ্দেশে বের হয় ফারদিন। বিকেল ৫টায় ফারদিন সায়েন্স ল্যাব মোড়ে তার পরিচিতার সঙ্গে দেখা করেন। সেখান থেকে নীলক্ষেত ও ধানমন্ডিসহ পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন স্থানে ঘোরাঘুরি করেন। পরে সাত মসজিদ রোডে একটি রেস্টুরেন্টে খাবার খেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশে রওনা করে।

রাত ৮টায় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিসহ পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন স্থানে ঘোরাঘুরি করেন। পরে তিনি রিকশায় করে রামপুরার উদ্দেশে যান। আনুমানিক রাত পৌনে ১০টার দিকে রামপুরা ব্রিজ এলাকায় রিকশা থেকে নেমে যায় এবং কিছুক্ষণ রামপুরা ব্রিজ এলাকায় ঘোরাফেরা করেন।

মঈন বলেন, প্রযুক্তিগত বিশ্লেষণে দেখা যায়, পরে তিনি কেরাণীগঞ্জের জিনজিরা, বাবুবাজার ব্রিজ সংলগ্ন এলাকা, পুরান ঢাকার জনসন রোড, গুলিস্তানের পাতাল মার্কেট এলাকায় যায়।

সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণে জানা যায়, রাত ২টা ১ মিনিটে (সিসিটিভি ফুটেজ টাইম ২টা ৩) যাত্রাবাড়ীর বিবিরবাগিচা থেকে নিহত ফারদিনকে লেগুনায় উঠতে দেখা যায়। রাত ২টা ২০ মিনিটে সুলতানা কামাল ব্রিজের অপর পাশে তারাবো বিশ্বরোডের বাসস্ট্যান্ড এলাকায় লেগুনা থেকে নেমে যায় ফারদিন।

তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে জানা যায়, রাত ২টা ২৬ মিনিটে সুলতানা কামাল ব্রিজের তারাবো প্রান্তে ফারদিনের অবস্থান ছিল। রাত ২টা ৩৪ মিনিটে সুলতানা কামাল ব্রিজের প্রায় মাঝখানে আসে ফারদিন।

ব্রিজের তারাবো প্রান্ত থেকে সুলতানা কামাল ব্রিজের মাঝখান পর্যন্ত দূরত্ব আনুমানিক ৪০০-৫০০ মিটার। রাত ২টা ৩৪ মিনিট ৯ সেকেন্ডে সুলতানা কামাল ব্রিজের রেলিং ক্রস করে ফারদিন এবং রাত ২টা ৩৪ মিনিট ১৬ সেকেন্ডে সুলতানা কামাল ব্রিজের ওপর থেকে স্বেচ্ছায় নদীতে ঝাঁপ দেয়। ওপর থেকে পানিতে সময় লাগে ৪ সেকেন্ড। রাত ২ টা ৩৫ মিনিট ৯ সেকেন্ডে ফারদিনের মোবাইল ফোন বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়াও রাত ২টা ৫১ মিনিটে ফারদিনের হাতের ঘড়িতে পানি ঢুকে অকার্যকর হয়ে পড়ে।

সিসিটিভি ফুটেজ, ডিজিটাল ফুটপ্রিন্টসহ অন্য সব আলামত বিবেচনায় নিয়ে আমাদের তদন্তে বের হয়ে আসে যে, বুয়েট শিক্ষার্থী ফারদিন স্বেচ্ছায় সুলতানা কামাল ব্রিজ থেকে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুবরণ করেন।

কমান্ডার মঈন আরও বলেন, আমরা ফারদিনের মৃত্যুর ঘটনায় তদন্তকারী কর্মকর্তাদের সঙ্গে বসেছি। তাদের আমাদের তথ্যউপাত্ত শেয়ার করে ঐকমত্যে পৌঁছেছি। ওই বুয়েটছাত্রের বাবার সঙ্গেও বসেছি। ঘটনার শুরু থেকে র‌্যাবের তথ্যগত বিষয়গুলো আমরা জানানোর চেষ্টা করেছি। যখন যে উইন্ডো ওপেন হয়েছে তাই গুরুত্ব দিয়ে আমরা তদন্ত করেছি।

এক প্রশ্নের জবাবে কমান্ডার মঈন বলেন, তার মাথায় যে আঘাতের কথা বলা হচ্ছে সেটা কতোটুকু নিশ্চিত সে ব্যাপারে কিছু বলবো না। তবে ঝাঁপ দেওয়ার সময় সে পিলারের কাছেই পড়েছে।

মাদক কারবারিরা তাকে হত্যা করতে পারে এমন তথ্য র‌্যাব ও ডিবি শুরুর দিকে জানিয়েছিলেন। তখন কোন তথ্যের ভিত্তিতে একথা বলা হয়েছিল? এমন প্রশ্নের জবাবে মঈন বলেন, তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় আমরা পেয়েছিলাম চনপাড়ার আশপাশের স্থানে ফারদিনের অবস্থান ছিল। সেসময় বিভিন্ন সাংবাদিকরাও সেখানে গেছেন কাজ করেছেন। কেউ হয়তো তাকে চনপাড়ায় নিয়ে হত্যা করতে পারে। বিভিন্ন সময় মাদক কারবারিরা অনেককে ধরে নিয়ে চনপাড়ায় ফিডিং দিয়েছে, মালামাল লুট করেছে। চনপাড়ার আশপাশে ফারদিনের লোকেশন ছিল বলে সেখানে আমরা কাজ করেছি। তবে আমরা কখনোই বলিনি ফারদিন মাদকাসক্ত ছিলেন।

ফারদিনের মৃত্যুরহস্য নিয়ে আমরা অনেক কাজ করেছি। যার যার সঙ্গে কথা বলা দরকার, ডাক্তার, বিশেষজ্ঞ, অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, টেলিযোগাযোগ বিশেষজ্ঞসহ অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি। আমরা আমাদের ফাইন্ডিংস তদন্তকারী সংস্থাকে জানিয়েছি।

আরেক প্রশ্নের জবাবে কমান্ডার মঈন বলেন, ডাক্তারের বক্তব্য নিয়ে কোনো কথা বলবো না। ফারদিনের যে ড্রেসআপ ছিল, ঘড়ি ছিল, মোবাইল ফোন ছিল, সবই ঠিক ছিল। ডেড বডির সঙ্গে এসব থাকায় অনেক কিছু বোঝায় যে, অন্তত ছিনতাইকারী তাকে খুন করেনি। মাথা, বুকে আঘাতের চিহ্ন অনেক কারণে হতে পারে। আমরা কনক্লুসিভ নিয়ে গত ২/৩ দিন ধরে কাজ করছি। আমরা মনে করি ডিবি তদন্ত করছে। তারা কনক্লুশন জানাবেন।

সিসি ক্যামেরায় যা দেখা গেছে তা দূর থেকে। লাফ দেওয়া ব্যক্তির সঙ্গে ফারদিনের চেহারার মিল আপনারা পেয়েছেন কি না? কীভাবে বলছেন কেউ ব্রিজ থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলেনি? -এমন প্রশ্নের উত্তরে কমান্ডার মঈন বলেন, দূরের সিসিটিভি ফুটেজ। চেহারা বোঝার উপায় নাই। সময়, পারিপার্শ্বিক তথ্য উপাত্ত, মোবাইল ফোন বন্ধ হওয়া, ঘড়ি বন্ধ হওয়া, যেখান থেকে নামছে সেখান থেকে লাস্ট লোকেশন পর্যন্ত দূরত্ব, তদন্তকারী সংস্থাসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে কথা বলে আমরা প্রাথমিকভাবে মনে করেছি, স্বেচ্ছায় ফারদিন ব্রিজ থেকে পানিতে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুবরণ করেছে।

জেইউ/এসএম