শ্রম আদালতে পরিচালিত মামলাসমূহ দ্রুত নিষ্পত্তি, শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় করণীয় সম্পর্কে পর্যালোচনার জন্য বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) ও সেইফটি অ্যান্ড রাইটস্ সোসাইটি (এসআরএস) একটি সভার আয়োজন করে। 

সভায় শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান ও ঢাকার দুটি শ্রম আদালতের চেয়ারম্যানসহ শ্রম আদালতের সদস্য, আইনজীবী ও এনজিও প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন।

দেশে বর্তমানে শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান দ্রুত বিকাশ লাভ করায় শ্রমিকদের কর্মসংস্থানও বেড়েছে। শিল্পের বিকাশের সাথে সাথে শিল্প বিরোধও বৃদ্ধি পেয়েছে। সাধারণত অসচেতন ও কম সচেতন শ্রমিকেরা একেবারে নিরুপায় না হলে আদালতের দ্বারস্থ হন না। তথাপি, অনেক সময় শ্রম বিরোধ নিষ্পত্তির দীর্ঘসূত্রিতা ও আদালতে মামলার জট বিচারিক প্রক্রিয়ায় তাদের বিরোধ মীমাংসার আগ্রহকে আরও সংকুচিত করে। দীর্ঘদিন ধরে আদালতে এসে মামলা পরিচালনা করা শ্রমিকদের পক্ষে অনেক সময়ই সম্ভব হয় না। ফলে অনেক সময় তারা ন্যায়বিচার পান না।

সভায় বলা হয়, বর্তমানে দেশে ১৩টি শ্রম আদালত ও ১টি শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল রয়েছে। দেশের এসব আদালতে বর্তমানে ২৫ হাজার ৮১টি মামলা বিচারাধীন আছে। শ্রম আদালতগুলোকে মামলার চাপে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ফলে যারা নানা বাধা ও হয়রানি উপেক্ষা করে আদালতের দ্বারস্থ হন, তাদের পক্ষেও দীর্ঘসূত্রিতার কারণে মামলা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না এবং তারা আইনি প্রতিকার থেকে বঞ্চিত হন।
 
সভার শুরুতে স্বাগত বক্তব্যে ব্লাস্টের উপ-পরিচালক (আইন) মো. বরকত আলী সভার উদ্দেশ্য বর্ণনা করেন। তিনি শ্রমিকদের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে উপস্থিত সকল পক্ষকে কী ভূমিকা রাখতে পারে সে বিষয়ে সকলের মূল্যবান মতামত আহ্বান করেন।

সভায় যৌথভাবে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ব্লাস্টের স্টাফ আইনজীবী অ্যাডভোকেট সিফাত-ই-নুর খানম ও এসআরএসের সহকারী আইন কর্মকর্তা মো. ফারুক হোসেন। সভায় নিম্নোক্ত সুপারিশ উপস্থাপন করা হয়।

>> শ্রম সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তিতে বাধ্যতামূলকভাবে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি পদ্ধতি বাংলাদেশ শ্রম আইনে অন্তর্ভুক্তকরণের ব্যবস্থা করা।

>> ই-জুডিশিয়ারি কার্যক্রম শ্রম আদালত অন্তর্ভুক্ত করা।

>>তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে শ্রম মামলার বাদীর সাক্ষ্যগ্রহণসহ মামলার পরিচালনার ব্যবস্থা করা।

>> শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা বাড়ানো।

>> বিচারকদের প্রশিক্ষণে শ্রম আইন অন্তর্ভুক্ত করা।

>> শ্রমিক আইন সহায়তা সেলের সাথে প্যারালিগ্যাল কার্যক্রমের সমন্বয়ে আইন সহায়তা সহজ করা।

>> সরকারি ও বেসরকারি আইন সহায়তা প্রদান সংক্রান্ত শ্রম আদালতের মামলা শনাক্ত করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করা। যেন অসহায় বিচারপ্রার্থীরা দ্রুত আইনি প্রতিকার পেতে পারেন।

>> শ্রমিকদের মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সমন্বয় বৃদ্ধি করা।

প্যানেল আলোচনায় অ্যাডভোকেট শারমিন সুলতানা বলেন, আদালতে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং আদালতের কর্মঘণ্টার পূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। পাশাপাশি বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থাও জরুরি। 

ট্যানারি শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আবুল কালাম আজাদ বলেন- আদালতের প্রতি মানুষের আস্থা কমছে। পিআইএফই ও ডিওএল-এর মাধ্যমে এখন আর আগের মতো বিরোধ নিষ্পত্তি হচ্ছে না। 

বিজিএমএর অতিরিক্ত সচিব (শ্রম) মো. রফিকুল ইসলাম এডিআর বিষয়ে বিজিএমইএর আর্বিট্রেশন কাউন্সিলের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, কোর্টে কখনো মেম্বার আসেন না, কখনো চেয়ারম্যান সময় দিতে পারেন না, ফলে মামলা দীর্ঘায়িত হয়। আবার আইনজীবীও বারবার সময় নিয়ে মামলার সময় দীর্ঘ করে ফেলেন।

সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের সভাপতি রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, আদালতে পর্যাপ্ত স্টাফ নেই, বিচারককে হাতে লিখতে হয় অথবা নিজেকে টাইপ করতে হয়, এতে আদালতের সময় বেশি লাগে। মামলার বিশ্লেষণ নিয়ে ডকুমেন্ট রাখা যেমন- মামলার সংখ্যা, নিষ্পত্তি, পেন্ডিং ফর হিয়ারিং ও মামলার ধরন নিয়ে রিসার্চ করা প্রয়োজন। 

তিনি শ্রম আদালতে একটি লাইব্রেরির প্রয়োজনীয়তার কথাও তুলে ধরেন। পাশাপাশি প্যারালিগ্যালদের করণীয় নিয়ে সঠিকভাবে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থার দিকে জোর দিয়েছেন। 

বার এসোসিয়েশনের সভাপতি অ্যাডভোকেট সেলিম আহসান খান বলেন, ভুক্তভোগী শ্রমিক যেন ন্যায়বিচার পায় তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। 

উন্মুক্ত আলোচনায় উপস্থিত আমন্ত্রিত অতিথি, শ্রমিক প্রতিনিধি ও এনজিও প্রতিনিধিরা তাদের সুচিন্তিত মতামত প্রদান করেন।
  
সভায় বিশেষ অতিথি হিসেবে তৃতীয় শ্রম আদালতের চেয়ারম্যান শেখ মেরিনা সুলতানা ও দ্বিতীয় শ্রম আদালতের চেয়ারম্যান মো. মঞ্জুরুল ইমাম বক্তব্য রাখেন। 

মঞ্জুরুল ইমাম প্রযুক্তি ব্যবহারে প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধি ও দক্ষ লোকবল বৃদ্ধির প্রতি গুরুত্ব দেন। আইনজীবীদের কাজের জবাবদিহিতা বাড়াতে হবে। তিনি মামলার রায় বাস্তবায়নে উভয় পক্ষের সদিচ্ছা বাড়ানো জরুরি বলে মত প্রকাশ করেন। শ্রমিক নেতাদের আরো কার্যকর ও শ্রমিক অধিকার রক্ষায় আরও সততা প্রদর্শন প্রয়োজন।

তৃতীয় শ্রম আদালতের চেয়ারম্যান শেখ মেরিনা সুলতানা জানান, বর্তমানে মামলা নিষ্পত্তির সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্যারালিগ্যাল সার্ভিসের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে তিনি এই সার্ভিস মামলার জট কমাতে সহায়ক বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, মামলা নিষ্পত্তিতে এডিআর পদ্ধতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এই পদ্ধতি প্রয়োগ করে ৫০ শতাংশ মামলাই শুরুতে নিষ্পত্তি করা যায়। মামলার দ্রুত নিষ্পত্তিতে মালিকদের সহায়তাও প্রয়োজন বলে তিনি উল্লেখ করেন।
 
সভার প্রধান অতিথি বিচারপতি মো. ফারুক (এম. ফারুক) শ্রম আদালতের সংখ্যা বাড়ানোর প্রতি গুরুত্বারোপ করেন। পাশাপাশি এর কার্যকারিতা বৃদ্ধির জন্য লোকবল বাড়ানোর কথা বলেন। পরিশেষে তিনি মামলার রায় বাস্তবায়নে মালিক পক্ষের সদিচ্ছা বৃদ্ধির জন্য আহ্বান জানান।

সভায় সভাপতিত্ব করেন সাবেক বিচারপতি ও বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের সভাপতি মো. নিজামুল হক। তিনি তার বক্তব্যে বলেন, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার করে বিচারিক কাজে স্বচ্ছতা আনা সম্ভব। সমন জারিতে ইমেইলের ব্যবহার বিচার ব্যবস্থার গতি বৃদ্ধি করতে পারে।
 
ওএফ