দেশে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের খুচরা দাম পাঁচ শতাংশ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক নির্বাহী আদেশে ১ জানুয়ারি থেকে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হবে। বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর এমন সিদ্ধান্ত ভোক্তার ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সরকারের এই সিদ্ধান্ত ভর্তুকি কমাতে কিছুটা সাহায্য করলেও মূল্যস্ফীতিকে আর এক দফা বাড়িয়ে দেবে। আবার বিদ্যুৎ দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তকে মন্দের ভালো বলছেন কেউ কেউ।

বৃহস্পতিবার (১২ জানুয়ারি) বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিষয়টি নিয়ে ঢাকা পোস্টের কাছে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান। বিদ্যুতের দাম বাড়ানোয় বাজার ব্যবস্থাপনায় অস্থিরতার আশঙ্কা করেছেন তিনি।

গোলাম রহমান বলেন, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি অপ্রত্যাশিত কিছু ছিল না। পাইকারি পর্যায়ে যখন দাম বৃদ্ধি করা হয়েছিল, তখনই আশঙ্কা করেছিলাম খুচরা পর্যায়েও দাম বৃদ্ধি পাবে। এর আগে আমরা প্রতিবাদ করেছি। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কারিগরি কমিটি ১৫ শতাংশ দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছিল, এখন ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটাকে স্বাগত জানানোর প্রশ্নই আসে না। তবে আমি বলব মন্দের ভালো।

তিনি বলেন, কেন মন্দের ভালো বললাম...কারণ প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সবাই বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকি কমানোর কথা বলেছেন। উৎপাদনের জন্য যে ব্যয় হয়, সে ব্যয় ভোক্তাদেরকেই দিতে হবে। সেই প্রেক্ষাপটে আমার মনে হয় বিইআরসি যথেষ্ট সুবিবেচনার পরিচয় দেয়নি। 

ক্যাব সভাপতি বলেন, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। আমরা আশা করবো ব্যবসায়ীরা অন্যান্য সেক্টরে ব্যয় সংকোচন করে পণ্য মূল্য ঠিক রাখবেন। আমরা আশা করব যতটুকু বৃদ্ধি হয়েছে, সে কারণে যেন পণ্যের মূল্যের ওপর প্রভাব পড়বে না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কৃষিখাতে সোলার বিদ্যুতের ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে।

এদিকে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি ভোক্তার ওপর বাড়তি চাপ তৈরির পাশাপাশি বাজার পরিস্থিতিকে জটিল করবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।

তিনি বলেন, ইতোমধ্যে আমরা উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। মূল্যস্ফীতির এই কাঠামোর মধ্যে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করা ভোক্তার দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করলে পরিস্থিতি জটিল করবে। এর মাধ্যমে সহজেই অনুমেয় উৎপাদন ব্যয় যেমন বৃদ্ধি পাবে, তেমনিভাবে জীবনযাত্রার ব্যয় কিছুটা হলেও বৃদ্ধি পাবে। বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ফলে হয়তো সরকারের ভর্তুকি ব্যয় আংশিকভাবে কিছুটা কমিয়ে আনা যাবে। কিন্তু বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করে সরবরাহ বৃদ্ধি করা সম্ভব হবে না। অর্থাৎ বিদ্যুতের সরবরাহ বাড়ানো ভূমিকা ন্যূনতম। এর ফলে ভোক্তার ওপর চাপ বৃদ্ধি পাবে।

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, আমার কাছে মনে হয়েছে আইএমএফের সঙ্গে ঋণ চুক্তি ইস্যুতে উদ্যোগের অংশ হিসেবেই সরকারের এমন সিদ্ধান্ত হতে পারে। অর্থাৎ ভর্তুকি কমানোই ছিল মূল লক্ষ্য। এর বাইরে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর এই উদ্যোগের তেমন কোনো গুরুত্ব আছে বলে মনে হয় না। বরং সরকার যদি প্রকৃত অর্থেই বড় আকারে ভর্তুকি কমাতে চাইতো, তাহলে কুইক রেন্টালের মতো বিদ্যুৎকেন্দ্রে অবসায়ন করে নবায়নযোগ্য জ্বালানি নির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ দীর্ঘমেয়াদি ও মধ্যমেয়াদি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ওপর জোর দিতো। এক্ষেত্রে সরকারের ভর্তুকি কমার পাশাপাশি ভোক্তার স্বার্থ রক্ষা হতো। এর পাশাপাশি সরকারের অন্যান্য লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সহজতর হতো।

বৃহস্পতিবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে বিদ্যুৎ সচিব হাবীবুর রহমান বলেন, গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি বিষয়ক প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়েছে।

এর আগে রোববার (৮ জানুয়ারি) বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ওপর গণশুনানির আয়োজন করে বিইআরসি। তাতে বিদ্যুৎ বিতরণকারী ছয়টি প্রতিষ্ঠান/সংস্থা দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব উত্থাপন করে। ওই শুনানিতে বিদ্যুতের দাম ১৫.৪৩ শতাংশ বৃদ্ধির সুপারিশ করেছিল বিইআরসির কারিগরি কমিটি। গত ৩০ নভেম্বর বিইআরসি অধ্যাদেশ ২০২২ সংশোধনের কারণে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা পায় সরকার। ওই অধ্যাদেশের আওতায় বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

আরএম/কেএ