• নিয়ন্ত্রণহীন প্রায় এক হাজার মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান 
• বিএফআইইউয়ের তালিকা পেয়ে অভিযানে সিআইডি 
• নেপথ্যে বহু প্রভাবশালী, শুরুতে টার্গেট ‘চুনোপুটি’
• অবৈধদের জন্য চাপে বৈধরা 
• ডলার কেনাবেচার আড়ালে চলে অর্থ পাচারও

সাত শতাধিক মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান ছিল বাংলাদেশে। তবে নানা অনিয়ম ও কারসাজির অভিযোগে অনেক প্রতিষ্ঠান হারিয়েছে বৈধতা। বর্তমানে বাংলাদেশে বৈধ মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান রয়েছে ২৩৫টি। সেগুলোর লেনদেনের তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংক জানতে পারলেও নিয়ন্ত্রণহীন এক হাজার অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান।

অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জগুলোর নেপথ্যে রয়েছে অনেক রাঘববোয়াল। বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) থেকে অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জগুলোর তালিকা পাওয়ার পর তাদের বিরুদ্ধে অভিযান নেমেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

অভিযানে নামার পর সিআইডির কর্মকর্তারা বলছেন, অবৈধ এসব মানি এক্সচেঞ্জের পেছনে রয়েছে রাজনীতিক, সামাজিক ও অর্থনীতিক প্রভাবশালী অনেক রাঘব বোয়াল। চুনোপুটি ধরে ধীরে ধীরে তাদের বিরুদ্ধে লিগ্যাল অ্যাকশনে যেতে চায় অপরাধ তদন্ত সংস্থাটি। 

মানি এক্সচেঞ্জ অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশে বৈধ মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের লেনদেনের লিমিট আছে, আছে নজরদারিও। কিন্তু অবৈধ প্রতিষ্ঠানগুলোর কোনো লিমিট নেই, নেই কোনো নজরদারিও। এদের জন্য চাপে থেকে কাজ করতে হচ্ছে বৈধ মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলোকেই।

বাংলাদেশ ব্যাংক ও সিআইডির তথ্য মতে, সারা দেশে অন্তত এক হাজার অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা ডলার কেনাবেচার আড়ালে অর্থ পাচারে সঙ্গে জড়িত। এর মধ্যে শুধু ঢাকাতেই অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জের সংখ্যা ছয় শতাধিক। বৈধ-অবৈধ প্রতিষ্ঠানের বাইরেও ভ্রাম্যমাণ কিছু ব্যবসায়ী রয়েছে। যারা ফোনে ফোনে যোগাযোগ করে হোম ডেলিভারিতে বেচাকেনা করছে ডলারসহ দেশি-বিদেশি মুদ্রা। 

আরও পড়ুন : ব্যাগ কাঁধে ঘুরে ঘুরে মোবাইল ফোনে চলছে ডলার ব্যবসা

মঙ্গলবার অভিযানের পর ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। 

দেশে ডলার সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে গত মঙ্গলবার রাজধানীর পাঁচ স্থানে একযোগে অভিযান চালায় সিআইডি। এর মধ্যে তিনটি অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জ অফিস হচ্ছে- গুলশানের জেএমসিএইচ প্রাইভেট লিমিটেড, মোহাম্মদপুরের টোকিও স্কয়ারের আলম অ্যান্ড ব্রাদার্স এবং উত্তরার আশকোনা মুক্তিযোদ্ধা মার্কেটের তৈমুর মানি এক্সচেঞ্জ। বাকি দুটি ফেরারি প্রতিষ্ঠান। এ অভিযানে প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ১৪ জনকে গ্রেপ্তারসহ এক কোটি ১১ লাখ ১৯ হাজার টাকা জব্দ করা হয়।

যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তারা হলেন- আবু তালহা ওরফে তাহারত ইসলাম তোহা (৩২), আছাদুল শেখ (৩২), হাছান মোল্যা (১৯), আব্দুল কুদ্দুস (২৪), হাসনাত এ চৌধুরী (৪৬), শামসুল হুদা চৌধুরী ওরফে রিপন (৪০), সুমন মিয়া (৩০), তপন কুমার দাস (৪৫), আব্দুল কুদ্দুস (৩২), কামরুজ্জামান রাসেল (৩৭), মনিরুজ্জামান (৪০), নেওয়াজ বিশ্বাস, আবুল হাসনাত (৪০) ও শাহজাহান সরকার (৪৫)।

যোগাযোগ করা হলে সিআইডির ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইমের বিশেষ পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবির ঢাকা পোস্টকে বলেন, গ্রেপ্তারদের বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইনের উত্তরা পশ্চিম, বিমানবন্দর, আদাবর, মোহাম্মদপুর এবং গুলশান থানায় পাঁচটি পৃথক মামলা দায়ের করা হয়েছে। সেই মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতের অনুমতিক্রমে তাদের রিমান্ডে নেওয়া হবে।

বুধবার দুপুরে সিআইডির প্রধান কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে সিআইডির প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আসামিরা স্বীকার করেছে যে প্রতিটি প্রতিষ্ঠান দিনে গড়ে প্রায় ৭০ থেকে ৭৫ লাখ টাকা সমমূল্যের বিদেশি মুদ্রা অবৈধভাবে ক্রয়-বিক্রয় করে। মাসে ২২ বা ২৪ কর্ম দিবসে আরও কী পরিমাণ তারা ক্রয়বিক্রয় করছেন তার ধারণা করা যায়।

এ ব্যাপারে বিশেষ পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবির বলেন, গুলশান এলাকার কোনো কোনো অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানে দিনে লেনদেন হয় ১০ কোটি টাকাও। যেখানে কয়েক কোটি টাকার ডলার ক্রয়-বিক্রয় হয়। 

আরও পড়ুন : বৈধ ২৩৫ মানি চেঞ্জারের তালিকা প্রকাশ

সিআইডি কার্যালয়ে ব্রিফ করছেন সিআইডি প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া / ছবি : ঢাকা পোস্ট

তিনি বলেন, সে হিসেবে সারা বাংলাদেশের অবৈধ সব প্রতিষ্ঠানে লেনদেনে গড় ৭৫ লাখ টাকা ধরলে দিনে আনুমানিক ৭৫০ কোটি টাকার অবৈধ লেনদেন হয়। যেখানে বাংলাদেশ সরকার কোনো প্রফিট পায় না। বাংলাদেশ ব্যাংকেও থাকে না সঠিক তথ্য। এতে করে ডলার সংকট কিংবা পাচারের বিষয়টিও অস্পষ্ট থেকে যায়।

অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের কেউ টাকা ও ডলারসহ বিদেশে মুদ্রা পাচার করছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা করেছি। কিন্তু তাদের কাজটা অনেকটা মানি লন্ডারিংয়ের মতো। তারা বিদেশি মুদ্রা মজুত রেখে প্রতারণা করে, কেউ কেউ পাচার করছে বলে আমরা তথ্য পেয়েছি। দেশি-বিদেশি মুদ্রা পাচার করা মানি লন্ডারিং। আমরা তালিকা করছি। তদন্ত হচ্ছে। নেপথ্যে যতো বড় রাঘববোয়ালই থাক না কেন আস্তে আস্তে সবাইকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।

গত মঙ্গলবার (১৭ জানুয়ারি) রাজধানীর পাঁচ স্থানে একযোগে অভিযানে অংশ নেওয়া পাঁচ বিশেষ পুলিশ সুপারের এক জন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গুলশানে একটি বৈধ মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানে যে পরিমাণ লেনদেন হচ্ছিল তার চেয়ে বেশি লেনদেন হচ্ছিল অবৈধ জে এম সি এইচ প্রাইভেট লিমিটেডে। সেখানে কোনো কোনো দিন ৫০ কোটি টাকাও লেনদেন, ক্রয়-বিক্রয় হয়েছে, যা সম্পূর্ণ অবৈধ। আমরা তাদের তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছাই করছি। তাদের সাথে আরও অনেকে জড়িত বলে তথ্য মিলেছে।

কেন অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জ বাড়ছে? এমন প্রশ্নের জবাবে সিআইডি প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া বলেন, খুব অল্প সময়ে লাভবান হওয়া যায়, তাই অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জ বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সোর্স ও সিআইডির সোর্সের মাধ্যমে আমরা অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জের বিরুদ্ধে অভিযান করছি। মানিলন্ডারিংয়ের ক্ষেত্রে শুধু সিআইডি নয়, সব এজেন্সি মিলেই কাজ করতে হবে। এ বিষয়ে আলাদা আইন আছে। সে অনুসারে কাজ করা হচ্ছে।

অবৈধভাবে মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিংবা বাংলাদেশ ব্যাংকের জ্ঞাতসারেই হচ্ছে। এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর কোনো গাফিলতি রয়েছে কি না?- এমন প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মাদ আলী মিয়া বলেন, দেশের সচেতন নাগরিক হিসেবে কোনো অবৈধ পথ বেছে নেওয়া উচিত হবে না কারো। বাংলাদেশ ব্যাংক বা অন্য যেকোন ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তা যদি হুন্ডি কিংবা অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জের সঙ্গে জড়ানোর তথ্য মেলে তবে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। দেশের মানুষকে অনুরোধ করব, সরকার ঘোষিত এবং সংশ্লিষ্ট বৈধ ব্যাংক থেকে ডলার ক্রয়-বিক্রয় করতে।

মানি এক্সচেঞ্জ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের মহাসচিব হেলাল সিকদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, অবৈধ লেনদেন, হুন্ডি ও মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে টাস্কফোর্স রয়েছে। সেটার আলোকে কিছু কাজ হচ্ছে। কিন্তু এরপরও হাজারো অবৈধ প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই।লিমিট দেখভাল না হওয়ার কারণে বড় ট্রানজেকশনের সুযোগ পাচ্ছে তারা। অনেক অবৈধ প্রতিষ্ঠান সরাসরি ডলার কারসাজি, ডলার আসার গতি কমাতে সক্রিয়। কারণ তারা হুন্ডির মাধ্যমে লেনদেন করার কারণে দেশে ডলার আসার গতি কমে।

তিনি বলেন, আমাদের মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহিতা আছে। মনিটরিং আছে। প্রতিদিন কে কতো লেনদেন, ক্রয়-বিক্রয় করতে পারবে, সেটাও নির্ধারিত। নির্ধারিত থাকে ডলারসহ অন্যান্য বৈদেশিক মুদ্রার রেটও। বৈদেশিক মুদ্রা আসার গতি বাড়াতে হলে, হুন্ডি ও মানি লন্ডারিং বন্ধ করতে হলে অবৈধ সব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে। আমাদের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে সব ধরনের সহযোগিতা থাকবে।

জেইউ/এনএফ