রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন মাহবুব রায়হান। নিয়মিত বাসে মিরপুর ১০ নম্বর থেকে ধানমন্ডিতে যাতায়াত করেন। ৭-৮ বছর আগেও সকালের দিকে বাসে করে ৩০ মিনিটে এই পথ পাড়ি দিতে পারতেন তিনি। কিন্তু এখন সময় লাগে এক ঘণ্টার বেশি।

মাহবুব রায়হান ঢাকা পোস্টকে বলেন, সময়ের সঙ্গে সব কিছুর পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু ঢাকা শহরে যানবাহনের গতি বাড়েনি, বরং কমেছে। এখন অফিস টাইমে রাস্তায় বের হলেই দেখা যায় গাড়ির দীর্ঘ সারি। গাড়িগুলো টানা হর্ন দিয়ে যাচ্ছে আর থেমে থেমে এগোচ্ছে। আগে একটি স্টপেজে বাস থামার পর আরেক স্টপেজ পর্যন্ত দ্রুত গতিতে যেত। কিন্তু এখন এক স্টপেজ থেকে অন্য স্টপেজে গাড়ি যায় হাঁটা গতিতে।

দিনদিন গাড়ির সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে, যদি সব গাড়ি একসঙ্গে রাস্তায় নামিয়ে দেওয়া হয় তবে ঢাকা শহরের কোনো রাস্তা বোধ হয় আর খালি পাওয়া যাবে না— যোগ করেন তিনি।

আরও পড়ুন >>> কার্যকর আইনে সড়কে আচরণগত ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণ 

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের গবেষণার তথ্য বলছে, মানদণ্ডে পরিকল্পিত কোনো শহরে ২৫ শতাংশ সড়ক থাকার কথা। কিন্তু ঢাকা শহরে আছে মাত্র ৭ শতাংশ।

এদিকে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) শুরু থেকে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে ৫৫ লাখ ৯২ হাজার ৫৯টি মোটরযানকে রেজিস্ট্রেশন দিয়েছে। শুধু ঢাকা শহরেই রেজিস্ট্রেশন দিয়েছে ১৯ লাখ ৫৫ হাজার ৪০৯টি মোটরযানকে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানদণ্ড অনুযায়ী ঢাকা শহরে ১৮ শতাংশ সড়কের ঘাটতি আছে। আর যে ৭ শতাংশ সড়ক আছে সেখানে গাড়ি আছে ১০০ শতাংশের বেশি। যার ফলে নগরবাসী নিয়মিত যানজটের কবলে পড়ছে। এতে কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। তারপরও অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বিআরটিএ গাড়ির রেজিস্ট্রেশন দিয়েই যাচ্ছে।

আরও পড়ুন >>> মোটরসাইকেলে সব নিষেধাজ্ঞা কেন? 

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সকাল ও বিকেলে ব্যক্তিগত গাড়ির বহর থাকে সড়কে। অন্যদিকে যাত্রীবাহী বাসগুলো লেন না মেনে রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠানামা করায়। এসময় বাসের সামনে গাড়ির জট না থাকলেও পেছনে জট লেগে যায়। অবৈধ পার্কিংয়ের জন্যও রাস্তা সরু হয়ে যায়। কোনো কোনো রাস্তায় নির্মাণ কাজের জন্য লেন কমানো হয়। আবার কোনো কোনো সড়কে দ্রুতগতির যানবাহনের পাশাপাশি চলে ধীরগতির যানবাহন। সবমিলিয়ে ঢাকা শহরের রাস্তায় যানজট লেগে থাকে প্রতিনিয়তই। আর বিশেষ কোনো কারণে রাস্তা বন্ধ থাকলে যাত্রীর দুর্ভোগ বহুগুণ বেড়ে যায়।

বিআরটিএর প্রতিবেদন বলছে, ঢাকা শহরে গত এক যুগের মধ্যে বিআরটিএ সর্বোচ্চ সংখ্যক মোটরযান রেজিস্ট্রেশন দিয়েছে সদ্য বিদায়ী ২০২২ সালে। যার পরিমাণ ১ লাখ ৭৪ হাজার ৮১২টি। এই এক যুগে দ্বিতীয় সংখ্যক মোটরযান রেজিস্ট্রেশন দিয়েছিল ২০১৮ সালে, ১ লাখ ৭১ হাজার ৩১২টি। ২০১১-১৫ সাল পর্যন্ত মোটরযান রেজিস্ট্রেশনের সংখ্যা লাখের নিচে থাকলেও ২০১৬ সাল থেকে লাখের ঘরে উন্নীত হয়। এরপর সর্বোচ্চ সংখ্যক মোটরযান রেজিস্ট্রেশন দেয় ২০১৮ ও ২০২২ সালে।

আরও পড়ুন >>> আলমডাঙ্গা মহাসড়কের একদিন 

২০২২ সালের প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ঢাকা শহরে রেজিস্ট্রেশন পাওয়া সর্বোচ্চ সংখ্যক মোটরযানের মধ্যে প্রথম স্থানে আছে মোটরসাইকেল। যার রেজিস্ট্রেশন সংখ্যা ১ লাখ ২০ হাজার ৮৪৮টি। দ্বিতীয় স্থানে আছে প্রাইভেট প্যাসেঞ্জার কার, যার রেজিস্ট্রেশন সংখ্যা ১৪ হাজার ৯৪৬টি। অন্যদিকে গণপরিবহন (বাস) রেজিস্ট্রেশন হয়েছে ২ হাজার ২৩৩টি, জিপ ৯ হাজার ৩৫০টি, পিকআপ ৭ হাজার ৭৫৩টি, মাইক্রোবাস ৬ হাজার ৬৯৫টি, কাভার্ডভ্যান ৩ হাজার ৮৪৫টি, ট্রাক ৩ হাজার ২৬৭টি। এছাড়াও অ্যাম্বুলেন্স, অটোরিকশা, অটো টেম্পু, কার্গোভ্যান, ডেলিভারি ভ্যান, হিউম্যান হলার, মিনিবাস, স্পেশাল পারপাস ভেহিক্যাল, ট্যাংকার, টেক্সিক্যাব এবং অন্যান্য ক্যাটাগরিতে বাকি মোটরযানগুলোর রেজিস্ট্রেশন হয়েছে।

একইভাবে সারা দেশে গত এক যুগের মধ্যে বিআরটিএ সর্বোচ্চ সংখ্যক মোটরযান রেজিস্ট্রেশনও দিয়েছে সদ্য বিদায়ী ২০২২ সালে। যার পরিমাণ ৫ লাখ ৭৮ হাজার ১৫১টি। এর মধ্যে মোটরসাইকেলের রেজিস্ট্রেশন সংখ্যা ৫ লাখ ৬ হাজার ৯১২টি। প্রাইভেট প্যাসেঞ্জার কার রেজিস্ট্রেশন হয়েছে ১৬ হাজার ৬৯৫টি, বাস ২ হাজার ৬৮৮টি, জিপ ১০ হাজার ২৪০টি, পিকআপ ৯ হাজার ৮০৪টি, অটোরিকশা ৭ হাজার ৬০৬টি, মাইক্রোবাস ৭ হাজার ৩৯৯টি, কাভার্ডভ্যান ৪ হাজার ৪২৪টি, ট্রাক ৪ হাজার ৫২৮টি। এছাড়াও অ্যাম্বুলেন্স, অটো টেম্পু, কার্গোভ্যান, ডেলিভারি ভ্যান, হিউম্যান হলার, মিনিবাস, স্পেশাল পারপাস ভেহিক্যাল, ট্যাংকার, টেক্সিক্যাব এবং অন্যান্য ক্যাটাগরিতে বাকি মোটরযানগুলোর রেজিস্ট্রেশন হয়েছে।

আরও পড়ুন >>> গণপরিবহন কি জনভোগান্তির অপর নাম?

শহরের যানজট নিরসনে বেশ কয়েকটি ফ্লাইওভার নির্মিত হয়েছে ঢাকায়। কিন্তু সড়কে অতিরিক্ত গাড়ির চাপের কারণে ফ্লাইওভারের ওপরও প্রায়ই গাড়ির জট তৈরি হয়।

সড়ক বাড়ছে না কিন্তু গাড়ির সংখ্যা প্রতিনিয়তই বাড়ছে, শহরে যানজট হচ্ছে। গণপরিবহন সেবা বিঘ্নিত হচ্ছে। এ অবস্থায় বিআরটিএর যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করা উচিত কি না— জানতে চাইলে ঢাকা শহরের গণপরিবহন সমন্বয়ে কাজ করা ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) নির্বাহী পরিচালক সাবিহা পারভীন ঢাকা পোস্টকে বলেন, শহরের যানজট নিরসন সম্ভব হচ্ছে না ছোট ছোট গাড়ির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় এবং অবৈধ গাড়ি চলাচল করায়। আমরা অভিযান চালিয়ে অবৈধ গাড়িগুলোকে থামানোর চেষ্টা করছি। যানজট নিরসনে দুই সিটি কর্পোরেশনকেও বলা হয়েছে যেন রাস্তায় পর্যাপ্ত জায়গা থাকে, সেইভাবেই যেন পরিকল্পনা করা হয়।

তিনি বলেন, আমরা ব্যক্তিগত গাড়ি রাস্তায় চালাতে নিরুৎসাহিত করছি। আমরা চেষ্টা করছি ভালো মানের একটি গণপরিবহন ব্যবস্থা চালু করতে। আমাদের বাস রুট রেশনালাইজেশন যদি পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় তবে ঢাকার সড়কের যানজট ২০ থেকে ৩০ শতাংশ কমানো সম্ভব হবে।

সাবিহা পারভীন বলেন, বিআরটিএ নীতিমালার মধ্য দিয়ে কাজ করছে। নিয়ন্ত্রণ করা উচিত, তবে ব্যবসায়ীদের কথাও চিন্তা করতে হবে। কারণ এখান থেকেও ভালো রকমের রাজস্ব আসে সরকারের।

জানতে চাইলে নগর পরিকল্পনাবিদ আদিল মুহাম্মদ খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, শহরের আদর্শ মাপে ঢাকায় মাত্র ৭ শতাংশ সড়ক আছে। একটা বিদ্যমান শহরে কিন্তু রাস্তা বাড়ানো সম্ভব হয় না। গত এক যুগেও যদি আপনি দেখেন, তাহলে ঢাকায় রাস্তা বানানো বলতে ফ্লাইওভার হয়েছে। ফ্লাইওভারগুলোর লেন দুটি এবং লম্বায় ছোট। এর বাইরে ঢাকায় একটি নতুন রেলপথ হয়েছে, সেটি মেট্রোরেল। মূল নগর এলাকায় সড়কের পরিমাণ খুব বেশি বাড়েনি। নগর এলাকার বাইরে কিছু কিছু নতুন সড়ক হয়েছে, তবে সেটি নগর এলাকার ট্রাফিক ধারণ করবে না। যেহেতু একটা বিদ্যমান শহরে রাস্তার পরিমাণ বাড়ানো যায় না, সেজন্য যানবাহনের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। এটিই হচ্ছে নগর পরিকল্পনার সহজ সমাধান।

আরও পড়ুন >>> যানজটে স্থবির ঢাকা : সমাধান কোথায়? 

তিনি বলেন, সিঙ্গাপুরের মতো উন্নত এবং পরিকল্পিত শহরে তারা গত কয়েক বছর আগেই একটা পলিসি নিয়েছে। তারা পরিকল্পনা নিয়েছে আর একটি নতুন ব্যক্তিগত গাড়িও তারা বাড়তে দেবে না। সেখানে নতুন কোনো গাড়ি কেনার সুযোগ নেই। এমন হতে পারে, একজনের একটি গাড়ি আছে তিনি গাড়িটি ছাড়বেন। তখন আমি সেই গাড়িটি নিতে পারব। মূল কথা হচ্ছে যতগুলো গাড়ি ছাড়া হবে, ততগুলো গাড়ি নামবে। তবে নতুন কোনো গাড়ি ঢুকবে না। এটা হচ্ছে একদম বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনা। কিন্তু আমাদের এই শহরে ব্যক্তিগত গাড়ি এবং মোটরসাইকেল লাগামহীনভাবে বেড়েছে।

২০২২ সালের বিআরটিএর রেজিস্ট্রেশনের পরিসংখ্যানের বিষয়ে জানতে চাইলে আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, মোটরসাইকেলের কারণে ভয়ংকর একটি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে ঢাকা শহরে। আর ব্যক্তিগত গাড়ির লাগাম কখনোই টানা হয়নি। যেহেতু সড়ক বাড়ছে না, তাহলে আমরা কেন অবৈজ্ঞানিক উপায়ে দিনকে দিন এই গাড়িগুলো বাড়তে দিচ্ছি। এর কোনো ব্যাখ্যা বিআরটিএর কাছে নেই। বিআরটিএ সড়কের সঙ্গে যানবাহনের সমন্বয় করার যে বিষয় সেটি নিয়ে কখনো আলোচনা করে না।

তিনি বলেন, গত দুই তিন মাসে যানজট উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। আগে বলতাম সপ্তাহে একদিন বা দুই দিন রাস্তায় বেশি যানজট আছে। এখন সপ্তাহে পাঁচ দিনের মধ্যে চার দিনই প্রচন্ড যানজট থাকে। আর বন্ধের দিনে তো আরও বেশি।

সড়কের তুলনায় গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে। বিআরটিএর যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করা উচিত কি না জানতে চাইলে বিআরটিএর পরিচালক (রোড সেফটি) শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রব্বানী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের কাজই হচ্ছে রেজিস্ট্রেশন ও লাইসেন্স দেওয়া। লাইসেন্স দেওয়া যাবে না, এরকম কোনো নির্দেশনা আমাদের নেই। আমরা নিয়মিত সমন্বয় করি। আমাদের কমিটি আছে, মেয়র মহোদয়ের সঙ্গেও নিয়মিত বৈঠক হয়। সমন্বয় সব জায়গাতেই আছে।

/এমএইচএন/এসএসএইচ/