কক্সবাজার পানি শোধনাগার প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণে আলোচিত দুর্নীতির অনুসন্ধান করতে গিয়ে রোষানলে পড়েছিলেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চাকরিচ্যুত উপ-সহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিন।

তার অনুসন্ধানে পৌর মেয়র ও আমলাসহ অনেকের সম্পৃক্ততা উঠে এসেছিল। কিন্তু অদৃশ্য কারণে মামলার অনুমোদন আর হয়নি। এরপর অনুসন্ধান কর্মকর্তা পরিবর্তন করা হলেও অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বড় পরিবর্তন আসেনি।

কক্সবাজার পানি শোধনাগার প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণে ৩৫ কোটি টাকা সরকারের ক্ষতিসাধন করা হয়েছে বলে প্রমাণ পেয়েছিলেন অনুসন্ধান কর্মকর্তা। আর ওই অনুসন্ধান প্রতিবেদনে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পৌর মেয়র মুজিবুর রহমান, কক্সবাজারের সাবেক জেলা প্রশাসক (বর্তমানে যুগ্ম-সচিব, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়) মো. কামাল হোসেন, সাবেক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) (বর্তমানে উপ-সচিব, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়) আশরাফুল আফসারসহ ৩৭ জনকে আসামি করে মামলার সুপারিশ করেছিলেন অনুসন্ধান কর্মকর্তা উপপরিচালক আলী আকবর।

তবে এবারও বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে কমিশন থেকে অনুসন্ধান কর্মকর্তা পরিবর্তন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত নতুন কর্মকর্তা হলেন উপপরিচালক সিরাজুল ইসলাম। অনুসন্ধান প্রতিবেদনের কপি ঢাকা পোস্টের কাছে সংরক্ষিত রয়েছে।

এ বিষয়ে অনুসন্ধান কর্মকর্তা উপপরিচালক আলী আকবরের কাছে জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য দিতে অস্বীকার করেন। দুদকের জনসংযোগ দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন তিনি।

যদিও জনসংযোগ দপ্তর এ বিষয়ে নতুন কোনো তথ্য জানা নেই বলে জানিয়েছে। অন্যদিকে, নুতন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। আমি অফিসের কাজে ঢাকার বাইরে অবস্থান করছি।

দুদকের প্রধান কার্যালয়ের চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত ডেস্ক প্রধান পরিচালক মুহাম্মদ ইউসুফের কাছে জানতে চাইলে তিনিও জনসংযোগ বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দিয়েছেন।

তবে দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে ঢাকা পোস্টকে বলেন, অনুসন্ধান কর্মকর্তার মামলার সুপারিশ যাচাই-বাছাই করে বেশি কিছু কোয়ারি দেওয়া হয়েছে। অধিকতর অনুসন্ধানের স্বার্থে কর্মকর্তা পরিবর্তন করা হয়েছে। কেন পরিবর্তন করা হয়েছে, সেটা কমিশনই ভালো বলতে পারবে। তবে সাদা চোখে দেখলে, নতুন অনুসন্ধানেও বড় কোনো পরবর্তন হওয়ার সুযোগ নেই।

অনুসন্ধান প্রতিবেদনে যা বলা হয়েছে
২০১৫ সালে কক্সবাজার পৌরসভার তৎকালীন মেয়র সরওয়ার কামাল জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের আওতায় কক্সবাজার পানি শোধনাগার প্রকল্পের জন্য বাঁকখালী নদীর উত্তরপাড়ে প্রায় ১ কোটি ২৩ লাখ টাকা মূল্যের জমি বাছাই করেন। তার দায়িত্ব শেষ হওয়ার পর নতুন মেয়রের দায়িত্ব পান মুজিবুর রহমান। প্রকল্প নির্মাণে আগের বাছাই করা জমি বাদ দিয়ে বাঁকখালী নদীর দক্ষিণপাড়ে ৩৬ কোটি ৬৭ লাখ টাকা মূল্যের জমি বাছাই করেন। নতুন করে বাছাই করা জমির মধ্যে বেশির ভাগ জমি ছিল সরকারি রিসিভারে থাকা জমি। মেয়র কৌশলে জমি অধিগ্রহণের আগে রিসিভারকৃত জমির ১ দশমিক ৭২ একর তার স্ত্রী ও শ্যালকের নামে ব্যক্তিগত জমিতে রূপান্তর করেন। সরকারি রিসিভারকৃত জমি ব্যক্তির জমিতে রূপান্তর করতে মেয়রকে সহায়তা করেন কক্সবাজারের সদরের সাবেক সহকারী কমিশনার (ভূমি) শাহরিয়ার মোক্তারসহ আরও দুজন সহকারী কমিশনারসহ (ভূমি) জেলার বিভিন্ন পদের কর্মকর্তারা।

অনুসন্ধান প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ২০১৫ সালের ১৮ মে কক্সবাজার জেলার এলএ মামলার (নং-০৪/১৯-২০) প্রস্তাবিত বাঁকখালী নদীর উত্তরপাড়ের জমি গ্রহণ না করে সরকারি অর্থের অপচয়, কারচুপি ও আত্মসাতের উদ্দেশে বাঁকখালী নদীর দক্ষিণপাড়ে ৩০ গুণ বেশি মূল্যের জমিতে প্রকল্প নির্মাণের পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এরপর ৩০ সেপ্টেম্বর বৈঠক ডেকে ভূমি অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। প্রকল্পের জন্য বাছাই করা জমির ২ দশমিক ১৯ একরের মধ্যে ১ দশমিক ৭২ একর জমি মেয়র মুজিবুর রহমান পূর্বপরিকল্পিতভাবে আদালতের রিসিভারি থাকা জমি মেয়রের স্ত্রী ফারহানা আক্তার ও স্ত্রীর বড় ভাই মিজানুর রহমানের নামে দখল দেখিয়ে নামজারির মাধ্যমে ব্যক্তিগত জমিতে রূপান্তর করেন। একইসঙ্গে নামজারি ও জমাভাগের মামলার (মামলা নং-৪১৭০/২০১০) মূল নথি গায়েব করেন। এছাড়া ২০১৯ সালের ২৭ অক্টোবরের দায়ের করা রিট পিটিশনের (নং-১৪৬৮১/২০১৯) আদেশকে মিসগাইড করে সহকারী কৌশলী মোহাম্মদ ইসহাকের সহায়তায় মিজানুর রহমানকে ২০২০ সালের ৯ জুলাই জমি অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণ বাবদ ৭ কোটি ১৬ লাখ ৮৯ হাজার ৭৯৪ অবৈধভাবে দেওয়া হয়।

অন্যদিকে, বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্পের ক্ষতিগ্রস্ত জসিম উদ্দিন গং ক্ষতিপূরণ বাবদ ২ কোটি ২২ লাখ চার হাজার ১৮৭ টাকা পান, সেই টাকা থেকে কমিশন বাবদ এক কোটি ৪৮ লাখ টাকা সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে নিয়েছেন মেয়র মুজিবুর রহমান। এ টাকা থেকে ১০ লাখ টাকার চেক দেন স্ত্রীর ভাই মিজানুর রহমানকে। দুদকের অনুসন্ধানে দালিলিক ও সাক্ষ্য প্রমাণ দ্বারা তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে বলে প্রতিবেদনে ১৯৪৭ সনের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় ৩৭ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়েরের সুপারিশ করা হয়।

এ বিষয়ে কক্সবাজার মেয়র মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ঢাকা পোস্ট থেকে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

যাদের বিরুদ্ধে মামলার সুপারিশ করা হয়েছে
অনুসন্ধান প্রতিবেদনে মোট ৩৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা সুপারিশ করা হয়েছে। তারা হলেন, কক্সবাজার পৌরসভার মেয়র মজিবুর রহমান, কক্সবাজারের সাবেক ডিসি (বর্তমানে যুগ্ম-সচিব, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়) মো. কামাল হোসেন, সাবেক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) (বর্তমানে উপ-সচিব, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়) মোহাম্মদ আশরাফুল আফসার, সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও বর্তমানে সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) এএইচএম মাহফুজুর রহমান, সাবেক সহকারী কমিশনার ভূমি মোহাম্মদ নূর হোসেন, কক্সবাজার ভূমি অফিসের সাবেক কানুনগো বাচ্চু মনি চাকমা, সাবেক ইউনিয়ন ভূমি উপ-সহকারী কর্মকর্তা মিজবাহ উদ্দিন, কক্সবাজার সদরের সাবেক সহকারী কমিশনার রাশেদুল ইসলাম, সাবেক সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও বর্তমানে সিনিয়র সহকারী সচিব (সাময়িক বরখাস্ত) জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় নাজিম উদ্দিন, উপজেলা ভূমি অফিসের কানুনগো বসন্ত কুমার চাকমা, ইউনিয়ন সহকারী কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাহেদ ও আবুল হোছাইন, ইউনিয়ন ভূমি উপ-সহকারী কর্মকর্তা মোহাম্মদ সৈয়দ নূর, উপজেলা ভূমি অফিসের রেকর্ড কিপার জসীম উদ্দিন, সার্ভেয়ার মো. জাহাঙ্গীর আলম।

ইউনিয়ন ভূমি উপ-সহকারী কর্মকর্তা মোহাম্মদ জায়েদ হোসাইন, সাবেক সহকারী কমিশনার (ভূমি) মুহাম্মদ শাহরিয়ার মুক্তার, সরকারি কৌশলী (জিপি) মোহাম্মদ ইসহাক, কক্সবাজার পৌরসভার সচিব রাছেল চৌধুরী, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা মো. শামীম হুসাইন, একই শাখার অতিরিক্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ আতাউর রহমান।

কানুনগো নুরুল ইসলাম, সার্ভেয়ার জিয়াউর রহমান, সাইফুল ইসলাম ও সার্ভেয়ার আইএম আশরাফুজ্জামান, মেয়রের স্ত্রী ফারহানা আক্তার, স্ত্রীর ভাই মিজানুর রহমান, কক্সবাজারের বাসিন্দা মমতাজুল ইসলাম, মফিজুর রহমান, মাহবুবুর রহমান, খোরশেদা বেগম, সদর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের মোস্তাক আহমেদ, মোসাম্মদ মাহমুদা খাতুন, রেজাউল করিম, মোজাফফর আলী, সালাহউদ্দিন এবং হাসান মেহেদী রহমান।

আরএম/এসএম