দেশব্যাপী ট্রেনের টিকিট কালোবাজারি চক্রের মূলহোতাসহ চার জনকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। বুধবার (৮ ফেব্রুয়ারি) বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত রাজধানীর কমলাপুর ও বিমানবন্দর রেলস্টেশন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।

র‌্যাব বলছে, রেলস্টেশনে যে পরিমাণ টিকিট বরাদ্দ থাকে তার মধ্যে ৫০ শতাংশ বিক্রি হয় অনলাইনে। যার ফলে কাউন্টারে এসে অনেকে টিকিট না পেয়ে ফিরে যান। আর এই সুযোগটি নেয় টিকিট কালোবাজারি চক্রের সদস্যরা।

ট্রেন ছাড়ার সময় যত ঘনিয়ে আসে চক্রের মজুত করা কালোবাজারি টিকিটের দাম তত বাড়তে থাকে। চক্রটি সাধারণত দ্বিগুণ মূল্যে টিকিট বিক্রি করে থাকে। সুযোগ, সময় বুঝে অনেক ক্ষেত্রে তারা টিকিটের দাম আরও বাড়িয়ে দেয়। টিকিট কালোবাজারি চক্রের মূলহোতা উত্তম দাসের নেতৃত্বে ও রেল কর্তৃপক্ষের একটি অসাধু চক্রের যোগসাজশে রাজধানীতে টিকিট কালোবাজারির একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট রয়েছে।

গ্রেপ্তাররা হলেন— ট্রেনের টিকিট কালোবাজারি চক্রের মূলহোতা উত্তম দাস (৩২), মো. ইলিয়াস (৫৯), মো. শাহ আলম (৩৪) ও মো. খোকন মিয়া (৫৫)।

এসময় তাদের কাছ থেকে ৪২টি কালোবাজারি টিকিট (৫৬টি আসন), তিনটি মোবাইল ফোন, একটি সিমকার্ড ও ১৫০০ টাকা জব্দ করা হয়।

বৃহস্পতিবার (৯ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে রাজধানীর টিকাটুলিতে র‍্যাব-৩ এর সদর দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র‍্যাব-৩ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ।

তিনি বলেন, দেশের বিভিন্ন রেলস্টেশনে অধিক মুনাফার আশায় ট্রেনের টিকিট কালোবাজারি করে একটি সংঘবদ্ধ চক্র দীর্ঘদিন ধরে তাদের তৎপরতা চালিয়ে আসছে। কমলাপুর রেলস্টেশনে এই কালোবাজারি চক্রটির অন্যতম মূলহোতা উত্তম দাস।

অন্য সদস্যরা মিলে রেলস্টেশনে লাইনে দাঁড়িয়ে এক একটি এনআইডি ব্যবহার করে টিকিট সংগ্রহ করে। এছাড়াও অনলাইনে বিভিন্ন পরিচয়পত্র (এনআইডি) ও মুঠোফোন নম্বর ব্যবহার করেও টিকিট সংগ্রহ করে। এরপর উত্তম দাসের নেতৃত্বে এক একটি ট্রেন ছাড়ার ৩/৪ ঘণ্টা আগে থেকে তারা অধিক মূল্যে টিকিট বিক্রির তৎপরতা শুরু করে। ট্রেন ছাড়ার সময় যত ঘনিয়ে আসে তাদের মজুত করা কালোবাজারি টিকিটের দাম তত বাড়তে থাকে।

এই চক্রটি মূলত সোনার বাংলা, কালনী এক্সপ্রেস, চট্টলা এক্সপ্রেস, তূর্ণা নিশিথা, পঞ্চগড় এক্সপ্রেস, সুন্দরবন এক্সপ্রেস, তিস্তা এক্সপ্রেস, মহানগর প্রভাতী, জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস, ব্রহ্মপুত্র এক্সপ্রেস এবং পারাবত এক্সপ্রেস— এসব ট্রেনের টিকিট কালোবাজারি করে থাকে।

র‍্যাব-৩ এর অধিনায়ক বলেন, এই চক্রটির আরও সদস্য ইউনিট রয়েছে। প্রতিটি ইউনিটে ৫-৭ জন করে সক্রিয় সদস্য রয়েছে। যারা তাদের টার্গেট করা ট্রেনগুলোর টিকিট কালোবাজারি করে সাধারণ যাত্রীদের কাছে চড়া দামে বিক্রি করে প্রচুর মুনাফা অর্জন করে।

তিনি জানান, এই চক্রের মূলহোতা উত্তম দাস নিজ জেলা কুমিল্লার বিভিন্ন গণ্যমান্য ব্যক্তিদের পরিচয় ব্যবহার করে ও রেলস্টেশনে কর্মরত অসাধু একটি চক্রের যোগসাজশে ২০১৮ সাল থেকে টিকিট কালোবাজারি শুরু করে। সে মূলত নিজে টিকিট কাটার কাজ না করে তার অধীন ৪/৫ জন কর্মী দিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে টিকিট সংগ্রহ করে চড়া মূল্যে বিক্রি করে থাকে।

চক্রের কৌশলের বিষয়ে র‍্যাব-৩ এর অধিনায়ক আরিফ মহিউদ্দিন জানান, এই সংঘবদ্ধ চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে চক্রের মূলহোতা উত্তম দাসের নেতৃত্বে বিমানবন্দর ও কমলাপুর রেলস্টেশন এলাকায় বিভিন্ন ট্রেনের টিকিট কালোবাজারির মাধ্যমে যাত্রীদের কাছ থেকে প্রচুর অর্থ হাতিয়ে নেয়। তারা কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে বিভিন্ন জেলার রেলস্টেশনগুলোতেও তাদের এজেন্টদের সঙ্গে যোগসাজশের মাধ্যমে টিকিট কালোবাজারির কার্যক্রম চালিয়ে থাকে। রেলস্টেশনে যে পরিমাণ টিকিট বরাদ্দ থাকে তার মধ্যে ৫০ শতাংশ বিক্রি হয় অনলাইনে। যার ফলে কাউন্টারে এসে অনেকে টিকিট না পেয়ে ফিরে যান। আর এই সুযোগ কাজ লাগাতে তারা রিকশাওয়ালা, কুলি, দিনমজুর এদের অল্প টাকার বিনিময়ে লাইনে দাঁড় করিয়ে তাদের মাধ্যমে টিকিট সংগ্রহ করে।

এছাড়াও অনলাইনে বিভিন্ন পরিচয়পত্র (এনআইডি) ব্যবহার করেও টিকিট সংগ্রহ করে থাকে। সংগ্রহ করা টিকিট নিয়ে এরা রেলস্টেশনের ভেতরে ছড়িয়ে পড়ে। এরা রেলস্টেশনে এসে টিকিট না পাওয়া যাত্রীদের কাছে তাদের কালোবাজারির টিকিট বিক্রির জন্য ঘুরতে থাকে। ট্রেন ছাড়ার ঘণ্টা দুয়েক আগে যাত্রী সমাগম শুরু হলে তাদের দৌরাত্ম্য বেড়ে যায়। সাপ্তাহিক সরকারি ছুটি অথবা বিভিন্ন ছুটিকে কেন্দ্র করে তারা এক একটি টিকিট ৩-৪ গুণ বেশি মূল্যে বিক্রি করে থাকে।

রেল কর্তৃপক্ষের যোগসাজশের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, টিকিট কালোবাজারি চক্রের মূলহোতা উত্তম দাসের নেতৃত্বে ও রেল কর্তৃপক্ষের একটি অসাধু চক্রের যোগসাজশে রাজধানীতে টিকিট কালোবাজারির একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট রয়েছে। তারা দেশব্যাপী টিকিট কালোবাজারির কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন। দেশের বিভিন্ন জায়গায় উত্তম দাসের ক্লায়েন্ট রয়েছে। যাদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করলে তারা মানুষের সুযোগ বুঝে চড়া দামে কখনো দ্বিগুণ, তিনগুণ দামে টিকিটগুলো বিক্রির ব্যবস্থা করে থাকে। এভাবেই দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে উত্তম দেশব্যাপী টিকিট কালোবাজারির অপকর্ম চালিয়ে আসছে।

গ্রেপ্তারদের সম্পর্কে লে. কর্নেল আরিফ বলেন, চক্রটির মূলহোতা উত্তম দাসের বিরুদ্ধে টিকিট কালোবাজারির দায়ে দুটি মামলা রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাছে আগে সে আরও দুইবার গ্রেপ্তার হয়েছে। বিভিন্ন মেয়াদে জেল খেটেছে।

এই চক্রের আরেক সদস্য খোকন মিয়ার নামে টিকিট কালোবাজারির দায়ে ছয়টি মামলা রয়েছে। এছাড়াও আসামি মো. শাহ আলমের বিরুদ্ধে টিকিট কালোবাজারির ছয়টি মামলা রয়েছে। আসামিরা বিভিন্ন মেয়াদের সাজা খেটে জেল থেকে বের হয়ে আবারও টিকিট কালোবাজারির সঙ্গে যুক্ত হয়। আসামিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন আছে।

জেইউ/এসএসএইচ/