জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে জীবন-জীবিকাসহ নানা ঝুঁকির মুখে পড়েছেন দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষ। অভাব-অনটন আর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এসব এলাকার লোকেরা বেঁচে থাকার জন্য তাদের প্রতিদিনের খাবারের পরিমাণ কমিয়ে দিচ্ছেন। গবেষণা বলছে, প্রায় ৩০ শতাংশের মতো মানুষ শুধুমাত্র তাদের খাবার খাওয়াই কমিয়ে দেননি, চাল ও মসুর ছাড়া অন্যান্য পুষ্টিকর খাবারের সামর্থ্যও তাদের নেই। সাতক্ষীরা জেলার ৫টি বস্তি ও শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা, পদ্মপুকুর ও বুড়িগোয়ালিনি ইউনিয়নে পরিচালিত এক জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

সোমবার (২০ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে এডুকো বাংলাদেশ ও উত্তরণ আয়োজিত ‌‘বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা ও বস্তি এলাকায় বসবাসরত মানুষের জীবিকা ও বিকল্প সমাধান, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব’ গবেষণার ফলাফল শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠানে এসব তথ্য তুলে ধরেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী।

ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অর্থায়নে ইউএনওপিএস’র সহযোগিতায় এডুকো বাংলাদেশ, উত্তরণ এবং খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় যৌথভাবে এই গবেষণা পরিচালনা করে।

গবেষণায় বলা হয়, সিডর, আইলা এবং অন্যান্য ঘূর্ণিঝড়ের কারণে চিংড়ি খামারসহ মৎস্য শিল্প এবং ফসলি জমির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। ফলস্বরূপ খামার এবং মাছ ধরার নৌকাগুলোতে দৈনিক শ্রমের সুযোগ মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হয়েছিল। এমনকি এসব এলাকার লোকেরা কাজ, বিকল্প আয় এবং ইট প্রস্তুতকারক, রিকশাচালক এবং শ্রমিক হিসেবে কর্মসংস্থানের জন্য অন্যান্য অঞ্চলে স্থানান্তরিত হতে বাধ্য হয়েছিল।

গবেষণাকৃত তিনটি ইউনিয়নে বেশকিছু সমস্যা মারাত্মকভাবে চিহ্নিত হয়েছে। এরমধ্যে কর্মসংস্থানের অভাব, মাটিতে লবণাক্ততা এবং সেচের অভাবের কারণে দুর্বল কৃষি উৎপাদনশীলতা, পানীয় জল ও ব্যবহারযোগ্য পানির অভাব, মেয়েদের জন্য স্যানিটেশন এবং স্বাস্থ্যবিধি এবং সকলের জন্য স্বাস্থ্যের ঝুঁকি, এবং অনুপযুক্ত বাঁধ ছিল অন্যতম।

গবেষণা প্রসঙ্গে অধ্যাপক আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, উপকূলীয় এলাকাগুলোতে একটি পরিবারের দৈনিক আয় ২০০ টাকা, যা জীবন ধারণের জন্য খুবই সামান্য। তবে লবণ সহিষ্ণু কৃষি কাজ, ক্ষুদ্র ব্যবসার বিকাশসহ বিকল্প জীবিকায় গুরুত্বারোপ করেন তিনি। এক্ষেত্রে উপকূল এলাকায় টেকসই বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে বলে জানান তিনি। একইসঙ্গে ভবিষ্যতের জলবায়ু ধাক্কা মোকাবিলা এবং জলবায়ুজনিত স্থানচ্যুতির হার কমাতে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর সক্ষমতা বৃদ্ধির কথা তুলে ধরেন।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মিজানুর রহমান বলেন, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে জীবিকার স্মার্ট বিকল্পগুলো খুঁজে বের করতে হবে। শ্যামনগর উপজেলার মানুষদের জন্য আমরা কীভাবে বিকল্প জীবিকাগুলো নির্বাচন করতে পারি সেদিকে আমাদের বিশেষভাবে নজর দিতে হবে। এক্ষেত্রে এডুকো বাংলাদেশ ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা থেকে আসা বিকল্প জীবিকার সমাধানগুলো এসব এলাকার মানুষদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে এবং আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যে তারা এই সমাধানগুলো ব্যবহার করতে সক্ষম হবেন।

তিনি বলেন, সরকার উপকূলীয় এলাকায় টেকসই বাঁধের উদ্যোগ নিয়েছে। তবে শুধু বাঁধ করে দিলেই হবে না, বাঁধের রক্ষণাবেক্ষণে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। নয়তো প্রতিবছর বাঁধ হবে, আবার সেটি ভেঙে যাবে।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি কোয়েন এভারার্ট বলেন, বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনে ঝুঁকি মোকাবিলায় কাজ করছে। আমি আশা করি বাংলাদেশ সরকার, উন্নয়ন সহযোগী এবং বিভিন্ন স্টেকহোল্ডাররা তাদের পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য গবেষণার সুপারিশগুলো বিবেচনা করবে এবং প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বসবাসকারী মানুষের জীবনে উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটাবে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রশমন এবং অভিযোজন উভয়ের জন্য কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

টিআই/এমএ