ছবি : সংগৃহীত

কুশিয়ারা নদী তীর সংরক্ষণ প্রকল্পে অনিয়ম পেয়েছে সংসদীয় উপ-কমিটি। বৃহস্পতিবার সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ প্রতিবেদন উত্থাপন করা হয়। 

জানা গেছে, ভাঙনের হাত থেকে বিবিয়ানা বিদ্যুৎ কেন্দ্র রক্ষা ও বর্ষা মৌসুমে তিন জেলার ১০টি ইউনিয়নের বন্যা প্রতিরোধে ‘হবিগঞ্জ জেলার বিবিয়ানা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সম্মুখে কুশিয়ারা নদীর উভয় তীরের ভাঙনরোধ’ প্রকল্পে অনিয়ম পেয়েছে সংসদীয় উপ-কমিটি। আগামী জুনে ওই প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও এখনো কাজের প্রায় ৪২ শতাংশ বাকি রয়েছে। প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ নিয়েও নানা অভিযোগ উঠেছে। প্রকল্প প্রস্তাবনা অনুযায়ী কাজ না হওয়ায় হুমকির মুখে পড়েছে বিবিয়ানা বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এমনকি আগামী বর্ষা মৌসুমে বন্যার ঝুঁকিও বাড়বে বলে জানিয়েছে সংসদীয় উপ-কমিটি।

এর আগে সিদ্ধান্ত মোতাবেক সংসদীয় উপ-কমিটির সদস্যরা গত ২৪ ও ২৫ নভেম্বর হবিগঞ্জ জেলার বিবিয়ানা পাওয়ার প্ল্যান্ট এলাকা সরেজমিন পরিদর্শন করেন। স্থানীয় সংসদ সদস্য গাজী মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মিজানুর রহমান ও পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)’র মহাপরিচালক ফজলুর রশিদসহ অন্যান্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে উপ-কমিটির সদস্য প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখার পাশাপাশি স্থানীয় জনগণসহ সংশ্লিষ্ট সকলের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। ওই তদন্তে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে উপ-কমিটি একটি প্রতিবেদন তৈরি করে তা মূল কমিটিতে জমা দেয়। প্রতিবেদনে প্রকল্পের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণসহ ৬দফা সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে।

তদন্ত প্রতিবেদনে নদীর ঢাল ও নদী তীর প্রতিরক্ষা কাজ অতিদ্রুত সম্পাদনের সুপারিশ করা হয়েছে। সুপারিশে বলা হয়েছে, প্রকল্পের নির্ধারিত সময় আগামী জুন মাস হলেও আগাম বন্যা প্রতিরোধে এপ্রিল মাসের মধ্যেই কাজ শেষ করতে হবে। পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়াতে নদীর ড্রেজিং করতে হবে। বিদ্যুৎ প্ল্যান্টসমূহের সামনে জমে থাকা পলি অপসারণ না করে স্ট্রিম তৈরি ও কুরিং সিস্টেম সচল রাখতে পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে স্বল্প ব্যয়ে দুটি ইনটেক চ্যানেল নির্মাণ করা যেতে পারে। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মালামাল নৌপথে সরবরাহের লক্ষ্যে দুটি জেটি নির্মাণের ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া প্রকল্পের প্রতিরক্ষা কাজ টেকসই করতে স্লপিং ব্লক, ডাম্পিং ব্লক ও জিও টিউবের মান ও স্থাপন পদ্ধতি নিয়মিত তদারকির সুপারিশ করা হয়েছে।

প্রকল্পটি বাস্তবায়নে নানা অনিয়ম ও ধীরগতি লক্ষ্য করা গেছে বলে জানিয়েছেন সংসদীয় তদন্ত কমিটির সদস্য নূরুন্নবী চৌধুরী শাওন।

তিনি সাংবাদিকদের বলেন, প্রকল্প অনুযায়ী নদীর উভয় তীরের কাজ হওয়ার কথা। কিন্তু গত আড়াই বছরে শুধু ডান তীরে কাজ হয়েছে। অথচ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নদীর বাম তীরে অবস্থিত। নামের সঙ্গে বিবিয়ানা বিদ্যুৎ কেন্দ্র না থাকলে হয়তো এ প্রকল্পটি পাশই হতো না। মূলত বিদ্যুৎ কেন্দ্র রক্ষার জন্য এ প্রকল্পটি পাস হয়েছে। অথচ নদীর ভাঙন ডান তীরে বেশি হওয়ায় কেবল ডান তীরেই কাজ হয়েছে। আর বাম তীরে পলি জমে নদী সংকীর্ণ হয়ে গেছে। এতে বিদ্যুৎ কেন্দ্র ঝুঁকির মুখে পড়েছে। গুরুত্বপূর্ণ ওই প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজের অগ্রগতিও সন্তোষজনক নয়। 

সরেজমিন পরিদর্শনকালে প্রকল্প পরিচালক এস এম শহিদুল ইসলাম তদন্ত কমিটিকে জানান, কুশিয়ারা নদীর ডান তীরের নকশা প্রথমে অনুমোদিত হওয়ায় ডান তীর সংরক্ষণ কাজ আগে শুরু হয়। বাম তীরের নকশা দেরিতে অনুমোদনের কারণে বাম তীরের বাস্তবায়ন কাজের অগ্রগতি কম। তাছাড়া করোনাকালীন লকডাউন এবং নির্মাণ সামগ্রী ও শ্রমিক সংকটের কারণে বাস্তবায়ন কাজের ধীর গতি হয়েছে। বর্তমানে প্রয়োজনের তুলনায় বরাদ্দ কম থাকায় প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজ বিঘ্নিত হচ্ছে। এ পর্যন্ত প্রকল্প কাজের অগ্রগতি ৫৮ দশমিক ৪ শতাংশ। 

এ বিষয়ে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি রমেশ চন্দ্র সেন বলেন, প্রকল্প এলাকা সরেজমিনে পরিদর্শন করে সংসদীয় উপ-কমিটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। প্রতিবেদন নিয়ে কমিটির আগামী বৈঠকে আলোচনা হবে। আলোচনা শেষে কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোকে নির্দেশনা দেওয়ার জন্য মন্ত্রণালয়কে বলা হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, প্রতিবছর বর্ষাকালে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ‘কুশিয়ারা ডাইক’ ভেঙে হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার ৫টি, সিলেটের ওসমানী নগর উপজেলার ২টি, মৌলভীবাজার সদর উপজেলার ৩টি ইউনিয়নের কয়েক হাজার হেক্টরের ফসল ও হাওরাঞ্চলের বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নদী ভাঙনের কারণে বিবিয়ানা বিদ্যুৎ কেন্দ্রও ঝুঁকির মুখে পড়ে। এ কারণে কুশিয়ারা নদীর উভয় তীর সংরক্ষণের দাবি জানিয়ে আসছিলো স্থানীয় জনগণ। 

এলাকাবাসীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ৫৭৩ কোটি টাকা ব্যয়ে কুশিয়ারা নদীর উভয় তীর রক্ষায় ‘হবিগঞ্জ জেলার বিবিয়ানা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সন্মুখে কুশিয়ারা নদীর উভয় তীরের ভাঙনরোধ’ শীর্ষক প্রকল্প গ্রহণ করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। ৭ দশমিক ৪ কিলোমিটার নদী তীর ও ঢাল প্রতিরক্ষায় ২০২০ সালের ডিসেম্বরে ১১টি প্যাকেজে কাজ শুরু হয়। কিন্তু বাস্তবায়ন কাজ শুরু থেকে ধীরগতিতে চলছে। এরপর নিম্নমানের উপকরণ ব্যবহার, অদক্ষ লোকবল দিয়ে কাজ করানো ও বাঁধের সঠিক মাপে মাটির ব্যবহার না করার অভিযোগ রয়েছে। এলাকাবাসী স্থানীয় জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে বিষয়টি পাউবোকে জানানোর পর কাজ না হলে সংসদীয় কমিটিকে জানায়। পরে অভিযোগ তদন্তে সংসদীয় উপ-কমিটি গঠন করা হয়।

এসআর/এসকেডি