শুরুতে আগুনের তীব্রতা ছিল কম। ফায়ার সার্ভিস এসে কিছু কাজ করার পর দেখা যাচ্ছিল শুধু ধোঁয়া। আগুন থেকে বাঁচতে ভবনের ১১/১২ তলায় উঠে চিৎকার ও আর্তনাদ করছিলেন ভবনের ৪/৫ জন বাসিন্দা। জানাচ্ছিলেন উদ্ধারের আকুতি। তবে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ব্যস্ত ছিলেন আগুন নেভাতে। একপর্যায়ে উপায় না পেয়ে চোখের সামনে একে একে লাফ দেন কয়েকজন। 

ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা যখন আগুন নেভানোর সিদ্ধান্ত নেয় তখন শুধু ধোঁয়া ছিল। তারপরও তারা পানি মেরে যাচ্ছিলেন। এর ফলে তাদের চোখের সামনেই প্রাণ বাঁচাতে ভবন থেকে লাফ দেন অনেকে। এ ঘটনায় শেষ পর্যন্ত দুই জনের মৃত্যুও হয়েছে।

গত ১৯ ফেব্রুয়ারি (রোববার) সন্ধ্যা ৭টার দিকে গুলশান-২ নম্বরের ১০৪ নম্বর রোডের ১২ তলা ভবনের ৭ম তলায় আগুনের সূত্রপাত হয়। ঘটনাস্থলে পৌঁছে ফায়ার সার্ভিসের ৭টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করলে আগুনের তীব্রতা কমে আসে। তবে হঠাৎ আগুন আবার বেড়ে যায়। পরে আগুন নিয়ন্ত্রণে যুক্ত হয় ফায়ারের মোট ১৯টি ইউনিট। প্রায় চার ঘণ্টা পর রাত ১১টার দিকে আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসে।

‘জাকির মোশাররফ স্কাইলেন’ নামে ওই ভবন পরিদর্শন করা অগ্নি-নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, সেদিন ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তাদের ভূমিকা অত্যন্ত প্রশ্নবিদ্ধ ও বিভ্রান্তিকর ছিল। কারণ তারা নিশ্চিত ছিলেন না আগে আগুন নেভাবেন নাকি ভবনে আটকেপড়াদের উদ্ধার করবেন। তারা চাইলেই ভবনের ছাদ থেকে উদ্ধার কাজ শুরু করতে পারতেন। তারা তা করেননি। এমনকি কৌশল নির্ধারণের জন্য কিছুক্ষণ অপেক্ষাও করেছেন। একপর্যায়ে তারা আগে আগুন নেভানোর সিদ্ধান্ত নেন। যখন তারা বাইরে থেকে আগুন নেভানোর সিদ্ধান্ত নেন তখন কোনো আগুন দেখা যায়নি। শুধু ধোঁয়া ছিল। তারপরও তারা পানি মেরে যাচ্ছিলেন। এর ফলে তাদের চোখের সামনেই প্রাণ বাঁচাতে ভবন থেকে লাফ দেন অনেকে। এ ঘটনায় শেষ পর্যন্ত দুই জনের মৃত্যুও হয়েছে।

আরও পড়ুন- ‘ভবনটিতে নিরাপত্তার সব ব্যবস্থাই ছিল’

অগ্নি-নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী আহমদ খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ওইদিন যারা ভবনটিতে রেসকিউ অভিযান চালিয়েছেন তাদের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পেরেছি, উদ্ধারকারী প্রথম দল ভবনের ভেতরে প্রবেশ করলেও উদ্ধার অভিযানে তাদের তেমন অ্যাপ্রোচ ছিল না। ছাদের ওপর দিয়ে গিয়ে ভিকটিমদের উদ্ধার করতে পারত ফায়ার সার্ভিস। তাদের এমন প্রশিক্ষণ রয়েছে। কিন্তু তারা উদ্ধার অভিযান চালাতে পারেনি।

আরও পড়ুন- শর্ট সার্কিট থেকে গুলশানে আবাসিক ভবনে আগুন, ধারণা পুলিশের

এদিকে গুলশান অগ্নিকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আগুন লাগার কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি চলে আসে। প্রায় ২০ মিনিটের মতো পানি দেওয়ার পর আগুন দেখা যায়নি। তখন ভেতর থেকে শুধু ধোঁয়া বের হচ্ছিল। তখন ভবনে থাকা অনেক মানুষ নিচে নেমে আসে। এরমধ্যেই ভবনটির ১১ ও ১২ তলায় ৫/৬ জন মানুষ আটকা পড়ে। তখন তারা বারান্দায় এসে মোবাইল ফোনের টর্চ লাইট জ্বালিয়ে বাঁচার আকুতি জানাতে থাকেন। প্রায় ৪৫ মিনিট ধরে তারা সাহায্যের আবেদন জানান। তখন পর্যন্ত ধোঁয়া ছাড়া ভবনটিতে কোনো আগুন দেখা যায়নি। আগুন না থাকা সত্ত্বেও ধোঁয়ার মধ্যে পানি ছিটিয়ে যাচ্ছিলেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। এছাড়া টার্ন টেবল লেডার (টিটিএল) ঘটনাস্থলে এনে ১৫-২০ মিনিট ফেলে রাখা হয়। হঠাৎ ১১ তলার বারান্দায় আগুন লাগে, আর সেখানে ফায়ার সার্ভিসের অপেক্ষায় থাকা মানুষগুলো জীবন বাঁচাতে লাফিয়ে পড়ে।

লাফিয়ে পড়ে নিহত হওয়া আনোয়ার হোসেন যে মালিকের বাসায় বাবুর্চি ছিলেন সেই মালিকের গাড়ি চালক মো. ইকবাল গুলশানের অগ্নিকাণ্ডের একজন প্রত্যক্ষদর্শী। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আনোয়ার লাফিয়ে পড়ার ৫ মিনিট আগেও আমার সঙ্গে ফোনে কথা বলেছিল। তখন ১১ তলার বারান্দায় আনোয়ার ও আমার মালিকের স্ত্রীসহ আরও ৩ জন দাঁড়িয়ে ছিল। আনোয়ার আমাকে ফোন দিয়ে বলেছিল আঙ্কেল ভেতরে অনেক ধোঁয়া, আমরা নিচে নামতে পারছি না। দ্রুত ফায়ার সার্ভিসের লোক পাঠান, আমাদের বাঁচাতে বলেন। আমি আনোয়ারকে বলেছিলাম বাবা ধৈর্য ধরো, ফায়ার সার্ভিসের লোকজন ওপরে যাচ্ছে। প্রায় ৪৫ মিনিট ধরে আনোয়ার ও বাকিরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে ফায়ার সার্ভিসের লোকদের অপেক্ষা করেছিল, কিন্তু কেউ তাদের উদ্ধার করতে যায়নি। এর মধ্যে বারান্দায় আগুনও ছিল না। কিন্তু হঠাৎ আগুন চলে আসে বারান্দায়, আর জীবন বাঁচাতে আনোয়ারসহ বাকিরা লাফিয়ে পড়ে।  

গুলশানের ভবন থেকে নিজ চেষ্টায় বেঁচে ফেরা গৃহকর্মী রিনা আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি ভবনটির ১১ ও ১২ তলায় কাজ করি। ধোঁয়া দেখার সঙ্গে সঙ্গে আমরা কয়েকজন গৃহকর্মী লিফটে করে নিচে নেমে আসি। তখন ভেতরে শুধু ধোঁয়া ছিল, আগুন ছিল না। আমরা নিচে এসে ফায়ার সার্ভিসের লোকদের বলেছি ১১ ও ১২ তলায় অনেক মানুষ আটকে আছে। কিন্তু তখন তারা ভেতরে যায়নি, তখন যদি তারা ভেতরে যেত তাহলে মানুষগুলোকে নামিয়ে নিয়ে আসতে পারত।

ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, গুলশানের আগুন নির্বাপণ এবং উদ্ধার কাজ চলাতে গিয়ে তাদের কিছু টেকনিক্যাল সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। বহুতল ভবনের অতিরিক্ত ডেকোরেশন ও উৎসুক জনতার কারণে তাদের এই সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়েছে।

এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের উপ-পরিচালক (ঢাকা বিভাগ) দিনমনি শর্মা ঢাকা পোস্টকে বলেন, আগুন বা যেকোনো দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে আমাদের প্রথম টার্গেট থাকে জীবিত মানুষকে উদ্ধার করা। এরপর অন্য অপারেশন। তবে গুলশানের আগুন নির্বাপণ ও উদ্ধার অভিযানের ক্ষেত্রে আমাদের বেশ কিছু সমস্যায় পড়তে হয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো উৎসুক জনতা। তারা ঘটনাস্থলে এসে ছবি তোলেন এবং ভিডিও করেন। তারা সহযোগিতা তো করেনই না, উল্টো আমাদের কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন। তারা রাস্তায় ভিড় সৃষ্টি করার ফলে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঘটনাস্থলের দিকে এগোতে পারে না।

অভিজাত এলাকার আগুন নির্বাপণের আরেকটি সমস্যা হলো পানির স্বল্পতা- এটি উল্লেখ করে তিনি বলেন, অভিজাত এলাকায় যথাস্থানে পানি পাওয়া যায় না আগুন নির্বাপণের জন্য। রাজধানীর বহু জায়গায় এই সমস্যা থাকে।

আরও পড়ুন- উৎসুক জনতা অনেক কষ্ট দিয়েছেন : ফায়ার সার্ভিসের ডিজি

গুলশানের ভবনটি এবং এর আশপাশের ভবনের অতিরিক্ত ডেকোরেশনের কারণে ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধার কাজ ব্যাহত হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আটকেপড়াদের উদ্ধার করতে লেডার যাচ্ছিল। কিন্তু বহুতল ভবনের সামনে থাকা ডেকোরেশনের কারণে আমাদের গাড়ি এগোতে পারেনি। 

ভিআইপিদের মহড়ায় ব্যাহত হয় ফায়ার সার্ভিসের অপারেশন

ওইদিনের অগ্নিকাণ্ডের সময় ফায়ার সার্ভিসের লোকজনের উদ্ধার অভিযান থেকে শুরু করে সার্বিক অপারেশন ব্যাহত হয় ভিআইপি মহড়ার কারণে। ঘটনার সময় রাত ৯টা ২০ মিনিটের দিকে আগুন লাগা ভবনের সামনে আসেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম। তিনি ঘটনাস্থলে এসে উৎসুক জনতার ভিড় কমানোর চেষ্টা করেন।

প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, মেয়র আতিক একা আসেননি, তার সঙ্গে প্রায় ১৫-২০ জন লোক ছিল। এসব লোকের কারণে এবং মেয়র আতিকের মুভমেন্টের কারণেও ঘটনাস্থলে বিশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি হয়।

সেদিন ঘটনাস্থলে দায়িত্বরত এক ফায়ার ফাইটার নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা পোস্টকে বলেন, গুলশানের আগুনে অনেক ভিআইপি এসেছিলেন। ভিআইপিদের সঙ্গে আরও ১৫-২০ জন করে লোক আসেন। সব মিলিয়ে এদের কারণে ঘটনাস্থলে আরো লোকজনের ভিড় বেড়ে যায়, ফলে আমাদের কাজ করতে অসুবিধা হয়েছিল। 

গুলশানের আগুনে ফায়ার সার্ভিসের যেসব সীমাবদ্ধতা ছিল

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গুলশানের আগুন নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে উদ্ধার অভিযানে ফায়ার সার্ভিসের যেমন কিছু কৌশলগত ভুল ছিল, তেমনি কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল। এর মধ্যে কয়েকটি হলো উৎসুক জনতার ভিড় নিয়ন্ত্রণে পুলিশের নীরবতা, ভিআইপি মহড়া ও গুলশান এলাকার কাছাকাছি ফায়ার স্টেশন না থাকা। এছাড়া অভিজাত এলাকা হলেও ভবনের বাসিন্দাদের ফায়ার সেইফটি সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা ছিল না।

অগ্নি-নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী আহমদ খান বলেন, অগ্নিকাণ্ডের পরের দিন আমি ভবনটিতে গিয়েছিলাম। বাইরে থেকে ভবনটিকে দেখতে আপাতদৃষ্টিতে সুন্দর মনে হলেও ভেতরে ফায়ার সেইফটি কোড বিন্দুমাত্রও মানা হয়নি। ফলে আগুনটা বড় হয় এবং ভিকটিমরা বের হতে পারেননি। তবে ভিকটিমরা চাইলে ছাদে গিয়ে জীবন বাঁচাতে পারতেন, কিন্তু ফায়ার সেইফটির বিষয়ে সচেতনতা না থাকায় তারা এক জায়গায় আটকে ছিলেন।

আরও পড়ুন- গুলশানে ভবনে আগুন : ২২ জনকে জীবিত উদ্ধার

তিনি বলেন, যখন অগ্নি দুর্ঘটনার অপারেশন চলে তখন ওইসব জায়গায় ভিআইপিদের যাওয়া উচিত নয়। তাদের কারণে উদ্ধার অভিযান ব্যাহত হয়। যখনই কোনো ভিআইপি যায় তার সঙ্গে আরও লোকজন যায়। ফলে ঘটনাস্থলে ভিড় বেড়ে যায়। যার ফলে উদ্ধারকর্মীদের কাজ করতে অনেক অসুবিধা হয়। তবে এসব ভিড় সামাল দিতে পুলিশকে ভূমিকা রাখতে হয়। কারণ ফায়ার সার্ভিসের নিজস্ব কোনো নিরাপত্তাকর্মী নেই। কিন্তু এসব ঘটনার সময় পুলিশ নীরব দর্শক হয়ে যায়। এসব ক্ষেত্রে পুলিশের উচিত সমন্বয় করে কাজ করা, যাতে করে ফায়ার সার্ভিসের গাড়িগুলো সুশৃঙ্খল করে আসতে পারে এবং ফায়ারের লোকজন তাদের মতো করে কাজ করতে পারে। না হলে ভিড়ের কারণে অনেক সমস্যা হয়ে যায় এবং সময় নষ্ট হয়।

এছাড়া কুইক রেসপন্সের জন্য গুলশান ও বনানী এলাকা কেন্দ্রিক একটি ফায়ার সার্ভিস স্টেশন স্থাপন করা খুবই জরুরি বলে মনে করেন এই বিশ্লেষক। অভিজাত এলাকায় নিয়মিত মহড়া করে মানুষজনকে সচেতন করা দরকার বলেও মনে করেন তিনি।

এদিকে গুলশানের ভবনটিতে অগ্নিকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব বিষয় ও দুইজন নিহত হওয়ার ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর। ফায়ার সার্ভিসের একটি সূত্র জানিয়েছে, তদন্ত কমিটি গুলশানের ভবনটিতে আগুন লাগার তিনটি সম্ভাব্য কারণকে সামনে নিয়ে কাজ করছে। সেগুলো হলো- গ্যাস লাইনে লিকেজ, বৈদ্যুতিক গোলযোগ ও সিগারেট থেকে অগ্নিকাণ্ড। তবে এখনো সুনির্দিষ্ট করে কারণ বের করতে পারেনি তদন্ত কমিটি।

জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরের মিডিয়া সেলের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহজাহান শিকদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, তদন্ত কমিটির কার্যক্রমের বিষয়ে আমি জানি না। তারা প্রতিবেদন জমা দিয়েছে কি না সেটাও জানি না। এ বিষয়ে কোনো তথ্য জানতে হলে তদন্ত কমিটির প্রধানের সঙ্গে কথা বলতে হবে।

তদন্ত কমিটির প্রধান ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী জানান, তদন্ত এখনও শেষ হয়নি। কাজ চলমান রয়েছে। তদন্ত শেষ হলে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।

এমএসি/জেডএস