বঙ্গবন্ধু জন্মদিনে শিশুদের সঙ্গে সময় কাটাতে পছন্দ করতেন

স্বাধীন দেশে পা রেখেই ভেবেছেন শিশুদের কথা। ভেবেছেন কিভাবে স্বাধীন দেশে সুন্দরভাবে শিশুরা বেড়ে উঠতে পারে। শিশুদের ভালোবেসে তৈরি করেছিলেন জাতীয় শিশু নীতি। আর এসব নিয়ে যিনি ভেবেছেন ও বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নিয়েছেন তিনি আর কেউ নন, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

আজ ১৭ মার্চ। বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি ও দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০১তম জন্মবার্ষিকী। একইসঙ্গে দিনটি রাষ্ট্রীয়ভাবে জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। দিবস দুটি মিলিয়ে আজ সরকারি ছুটি। বঙ্গবন্ধু শিশুদের ভালোবাসতেন বলেই তার জন্মদিন ১৭ মার্চকে জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে পালন করা হয়।

স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে পা রাখেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যুদ্ধবিধ্বস্ত এই দেশে তখন জনগণের তিন বেলা খাবারের ব্যবস্থা করাই ছিল অনেক কষ্টের। রাষ্ট্রীয় কোষাগারের অবস্থাও ছিলো নাজকু। কিন্তু শিশুদের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা থাকায় ১৯৭৩ সালে প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করেন। এর পরের বছর ১৯৭৪ সালে শিশু আইন প্রণয়ন ও প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেন তিনি।

‘আজ যদি বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকতেন, আমাদের শিশুরা আরও অনেক সুবিধা পেত। কারণ, উনি সব কিছুতেই শিশুদের কথা আগে ভাবতেন।’ মঙ্গলবার (১৬ মার্চ) ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপকালে এভাবেই নিজের আবেগ প্রকাশ করেন বাংলাদেশ শিশু একাডেমির চেয়ারম্যান লাকী ইনাম।

লাকী ইনাম বলেন, ‘আমি যতটুকু বঙ্গবন্ধুকে জেনেছি, উনি শিশুদের অসম্ভব ভালোবাসতেন। তিনি ১৯৭২ সালে স্বাধীন দেশে পা রেখেই শিশুদের জন্য যা কিছু করা সম্ভব, যে সুবিধাগুলো শিশুদের দিতে হবে সেগুলো নিয়ে কাজ শুরু করেন। সবার আগে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করেন। এরপর ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু জাতীয় শিশু নীতি প্রণয়ন করেন। তিনি সবকিছুতেই শিশুদের কথা আগে ভাবতেন। এমনই একজন মহান নেতাকে আমরা হারিয়েছি।’

বঙ্গবন্ধু শিশুদের কেমন ভালোবাসতেন এমন এক প্রশ্নের জবাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিকভাবে কখনো জন্মদিন পালন করেননি। তিনি শিশুদের সঙ্গে সময় কাটাতে পছন্দ করতেন। এমনকি ১৯৭৫ সালে তার শেষ জন্মদিনেও তিনি শিশুদের সঙ্গে সময় কাটিয়েছেন। সেদিনও তিনি শিশুদের সঙ্গে সময় কাটিয়ে রুটিন মাফিক অফিসে গিয়েছিলেন। সব সময় তিনি শিশুদের সঠিকভাবে শিক্ষা দেওয়া, লালন করার বিষয়টিতে নজর রাখতেন।’

শেষ জন্মদিনে গনভবনে শিশুদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু

তিনি আরও বলেন, যুদ্ধের পর দেশ যখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত, তখন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- ‘যেদিকেই যাই সেদিকেই আর্তনাদ শুনি নির্যাতিতা মহিলার, সন্তান হারা মায়ের’। তখন তিনি প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করে দিলেন। যাতে দেশের প্রতিটি শিশু শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। তিনি প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক ও অবেতনিক এবং একমুখী করে দিলেন। কারণ একমুখী না হলে বৈষম্য তৈরি হবে। ধনী ছেলে-মেয়েরা এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যাবে এবং গরিবরা অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাবে, সেটি বঙ্গবন্ধু কখনোই চিন্তার মধ্যে আনতে পারেননি। তিনি চিন্তা করেছেন, একই স্কুলে একই ধরনের পোশাক পড়ে শিশুরা স্কুলে যাবে। এই যে বঙ্গবন্ধুর চিন্তাভাবনা, এতে বোঝা যায় তিনি শিশুদের ভালোবেসে তাদের সঠিক শিক্ষা দিয়ে বাংলাদেশের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। আজকে আমরা যখন বঙ্গবন্ধুর জন্ম দিবস পালন করি, তখন একই সাথে জাতীয় শিশু দিবস পালন করি। বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা জানানোর এটিই যথাযথ সিদ্ধান্ত বলে তিনি মন্তব্য করেন।

‘বঙ্গবন্ধু শিশুদের অত্যন্ত আদর করতেন, ভালোবাসতেন। সংগ্রামী জীবনের শত ব্যস্ততার মাঝেও তিনি শিশুদের জন্য ভাবতেন। শিশুদের আনন্দ ও হাসি-খুশিতে রাখার প্রতি গুরুত্ব দিতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, আজকের শিশুরাই আগামীর ভবিষ্যৎ। আগামীতে দেশ গড়ার নেতৃত্ব দিতে হবে তাদেরই। শিশুরা সৃজনশীল মুক্তমনের মানুষ হিসেবে গড়ে উঠুক, সব সময়ই তিনি তা আশা করতেন। শৈশব থেকেই ছোট-বড় সবার জন্য দরদি হওয়ার কারণেই মানুষকে তিনি অধিকার আদায়ে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করতে, সচেতন করতে, সংগ্রামী করতে পেরেছেন। রাজনীতির কিংবা দেশের কোনো কাজে যখন গ্রামে-গঞ্জে যেতেন, তখন চলার পথে শিশুদের দেখলে তিনি গাড়ি থামিয়ে তাদের সঙ্গে গল্প করতেন, খোঁজখবর নিতেন। দুঃস্থ ও গরিব শিশুদের দেখলে তাদের কাছে টানতেন। কখনও কখনও নিজের গাড়িতে কোনো দুঃস্থ পিতাকে উঠিয়ে অফিসে কিংবা বাড়িতে নিয়ে তাকে কাপড়সহ অনেক উপহার দিয়ে তার মুখে হাসি ফোটাতেন’। শিশুদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসার কিছু উদাহরণ একটি কলামে এভাবেই তুলে ধরেছিলেন শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মো. শাদাত উল্লা।

বঙ্গবন্ধু শিশুদের কল্যাণে ১৯৭৪ সালের ২২ জুন জাতীয় শিশু আইন জারি করেন। এই আইনের মাধ্যমে শিশুদের নাম ও জাতীয়তার অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। শিশুদের প্রতি সব ধরনের অবহেলা, শোষণ, নিষ্ঠুরতা, নির্যাতন ইত্যাদি থেকে নিরাপত্তার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে।

‘বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন, শিশুর হৃদয় হোক রঙিন’— এ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে ‘জাতীয় শিশু দিবস-২০২১’ উদযাপন করছে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়। দিনটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতার সমাধিসৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণীও দিয়েছেন।

এছাড়া গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতার সমাধিসৌধ প্রাঙ্গণে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে অনুষ্ঠানে যুক্ত হবেন বলে জানা গেছে। অনুষ্ঠানে টুঙ্গিপাড়া প্রান্তে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা। এতে স্বাগত বক্তব্য রাখবেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. সায়েদুল ইসলাম। এছাড়া দেশের সব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও উপাসনালয়ে বিশেষ মোনাজাত ও প্রার্থনার আয়োজন করা হয়েছে।

এমএইচএন/এমএইচএস