ক্লার্ক কাম টাইপিস্ট (সিসিটি) পদে (তৃতীয় শ্রেণি) জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরে (ডিপিএইচই) চাকরি করেন মোফাজ্জল হোসেন। প্রতিবন্ধী কোটায় চাকরি নেওয়া মোফাজ্জল বর্তমানে ‘বাংলাদেশ জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন’ নামের একটি সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক। পাশাপাশি বিএনপি ও জাতীয় পার্টির পাট চুকিয়ে বর্তমানে হয়েছেন আওয়ামী লীগার। এ দুই কারণে জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরে তার প্রভাবও ব্যাপক। দিনদিন তার প্রভাব এতই বেড়েছে যে অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ‘মোফাজ্জল গং’-এ অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন।

প্রতিনিয়ত তারা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে বদলিসহ ঘুষ বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন। বলা যায়, ডিপিএইচই’র সব দপ্তরে মাফিয়া মোফাজ্জলে কোণঠাসা কর্মকর্তারা! অভিযোগ আছে, মোফাজ্জলকে টিকিয়ে রাখতে সবসময়ই সহযোগিতা করেন স্থানীয় সরকার বিভাগের একজন অতিরিক্ত সচিব। ডিপিএইচই’র ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এ প্রতিবেদককে বিষয়টি বিস্তারিত জানিয়েছেন।

ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দাবি, মোফাজ্জলের চাকরি সিসিটি পদে হলেও নিজ পদের কোনো কাজ করেন না। সিসিটি’র কোনো কাজ না করে তিনি কর্মচারীদের দাবি আদায়, ঘুষ ও বদলি বাণিজ্যে ব্যাপক মনোযোগী। তিনি মূলত দাবি আদায়ের আড়ালে তদবির, ঘুষ, চাঁদাবাজি, পদোন্নতি ও বদলি বাণিজ্যের একটি সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছেন। সরকারি বিভিন্ন দিবসকে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের ব্লাকমেইলের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন মোফাজ্জল গং। যেকোনো কর্মচারী অপরাধ করে অফিসিয়ালি শাস্তি পেলেও মোফাজ্জলের শক্তিতে পার পেয়ে যান। প্রধান প্রকৌশলী থেকে শুরু করে অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীদের নানাভাবে হুমকি-ধামকি ও ব্ল্যাকমেইল করে শাস্তি পাওয়া কর্মচারীদের পদোন্নতিও পাইয়ে দেন কথিত আওয়ামী লীগার মোফাজ্জল। এছাড়া, বিভিন্ন দুর্যোগের সময়ে দেশ-বিদেশে ত্রাণ পাঠিয়েও আলোচনায় থাকেন তিনি। সম্প্রতি তুরস্কে ৩০০ কম্বল পাঠিয়েও মানবিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন এ আওয়ামী লীগার!

তবে, তার এ মানবিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে টাকা কোথা থেকে পান, সেটি কারও বোধগম্য নয়। যদিও তিনি দাবি করেন, সংগঠনের টাকায় নাকি দুর্যোগকালীন দানখয়রাত করে থাকেন।

মোফাজ্জলের পাশাপাশি নানা অভিযোগে অভিযুক্ত তারই ‘ডান হাত’ বলে পরিচিত প্রধান প্রকৌশলীর দপ্তরের উচ্চমান সহকারী সৈয়দ মো. ইকরামুল হক। মোফাজ্জলের তদবির, ঘুষ, গুরুত্বপূর্ণ চিঠি সাপ্লাই, চাঁদাবাজি ও বদলি বাণিজ্যের প্রধান সহযোগী হিসেবে কাজ করেন তিনি।

অভিযোগ আছে, মোফাজ্জল প্রভাবেই ইকরামুল হক সিনিয়রদের টপকে সিসিটি থেকে উচ্চমান সহকারী হিসেবে পদোন্নতি নিয়ে প্রধান প্রকৌশলীর দপ্তরে এসেছেন। সারাদেশ থেকে প্রধান প্রকৌশলীর দপ্তরের আসা গুরুত্বপূর্ণ সব চিঠি মোফাজ্জলকে দিয়ে সহায়তা করেন ইকরামুল। এর মাধ্যমে মোফাজ্জল গং কর্মকর্তাদের ব্ল্যাকমেইল করার সুযোগ পান।

মোফাজ্জল ও ইকরামুলের বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগের তথ্য-প্রমাণ ঢাকা পোস্টের কাছে সংরক্ষিত আছে।

মোফাজ্জলের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ

অভিযোগ-১ : শারীরিক নির্যাতন, যৌন হয়রানি, ধর্ষণ চেষ্টা ও অনৈতিক যৌন সম্পর্ক স্থাপনের অভিযোগের ভিত্তিতে গত ২০২০ সালে ৪ সেপ্টেম্বর ১১ থেকে ২০ গ্রেডের সরকারি চাকরিজীবীদের সম্মিলিত অধিকার আদায় ফোরাম কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ কৈফিয়ত চেয়ে চিঠি দেয় মোফাজ্জলকে। চিঠিতে সই করেন সংগঠনের সভাপতি মো. মিরাজুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক মো. মাহমুদুল হাসান।

চিঠিতে বলা হয়, ২০২০ সালের ২৭ আগস্ট মোসাম্মদ ফারহানা পারভিন (সহ-মহিলাবিষয়ক সম্পাদিকা, কেনিফ) আপনার বিরুদ্ধে শারীরিক নির্যাতন, যৌন হয়রানি, ধর্ষণ চেষ্টা ও অনৈতিক যৌন সম্পর্ক স্থাপনের লিখিত অভিযোগ করেন। অভিযোগের ভিত্তিতে একই বছর ৪ সেপ্টেম্বর মোফাজ্জলকে প্রাথমিক সদস্য পদসহ সংগঠনের সকল কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

অভিযোগ-২ : ২০২০ সালে নেত্রকোণা কেন্দুয়া উপজেলার রয়েলবাড়ি ইউনিয়নের যুবলীগের সভাপতি এস এম সালেহীন স্থানীয় সরকার বিভাগে মোফাজ্জলের বিরুদ্ধে লিখিতভাবে দুর্নীতির অভিযোগ করেন। বিষয়টি আমলে নিয়ে ২০২০ সালের ১ সেপ্টেম্বর স্থানীয় সরকার বিভাগের উপসচিব মোহাম্মদ ফজলে আজিমের সই করা এক চিঠি তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয় জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরকে।

অভিযোগ-৩ : গত বছর বোরকা পরে ক্যাশিয়ার পদে স্ত্রীর পরীক্ষা দিতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন বরিশালের সিসিটি আশরাফ হোসেন। এরপর তাকে সাসপেন্ড করা হয়। কিন্তু মোফাজ্জলের চাপে পড়ে সেই আশরাফকে সিসিটি থেকে সরাসরি ক্যাশিয়ারের দায়িত্ব দিয়ে ঝালকাঠিতে বদলি করে ডিপিএইচই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, এখানে মোটা অঙ্কের লেনদেন করেছে মোফাজ্জল। গত ৩০ জানুয়ারি নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার সিসিটিকে ক্যাশিয়ার করে চাঁপাইনবাবগঞ্জে বদলি করিয়েছেন তিনি। সিসিটি থেকে সরাসরি ক্যাশিয়ার পদে পদায়ন করায় ক্ষোভ বিরাজ করছে মূল ক্যাশিয়ারদের মাঝে। এমন বদলির প্রতিবাদ জানিয়ে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী সরোয়ার হোসেনের কাছে চিঠি দিয়েছে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর ক্যাশিয়ার ফোরাম নামের একটি সংগঠন।

অভিযোগ-৪ : চলতি বছরের ১ জানুয়ারি মোফাজ্জলের ঘুষ বাণিজ্য ও প্রতারণার শিকার হয়ে জনস্বাস্থ্যের প্রধান প্রকৌশলীর কাছে চিঠি দেন সাহেদ আলম নামের এক ব্যক্তি। ভুক্তভোগী চিঠিতে উল্লেখ করেন, পাবলিক হেলথের এক কর্মীর মাধ্যমে মোফাজ্জলের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। সেই সুবাদে সিসিটি মোফাজ্জলের আশ্বাসে আমার নিজ জেলায় সিসিটি পদে (মাস্টার রোল) চাকরি পাইয়ে দিতে চার লাখ টাকা চুক্তি হয়। এরপর মোফাজ্জলের নির্দেশনায় তিন লাখ টাকা প্রধান প্রকৌশলী ‘বড় বাবু’ সৈয়দ ইকরামুল হকের শেওড়াপাড়ার বাসায় গিয়ে দিয়ে আসি। বাকি এক লাখ টাকা কাজ হয়ে গেলে দিতে হবে বলে জানান ইকরামুল হক। মোফাজ্জলের সঙ্গে ইকরামুল হকের ঘনিষ্ঠতা আছে এবং মোফাজ্জলের মাধ্যমে নির্দেশিত হয়ে আমি ইকরামকে টাকা দিই। কিন্তু প্রধান প্রকৌশলী অবসর চলে যাওয়ার পরের দিন মোফাজ্জল বলেন, সাইফুর স্যার কোনো চাকরির সিভিতে সই করেননি। কিছুদিন অপেক্ষা করেন নতুন প্রধান প্রকৌশলী সরোয়ার স্যার চেয়ারে বসলে সময় মতো সবগুলোন পারমিশন করিয়ে আনব। পরে জানতে পারি মাস্টার রোলে চাকরি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তখন টাকা ফেরত চাইলে বলেন, টাকা ফেরত হবে না। আমি টাকা চেয়ে জোর দিলে আমাকে হুমকি-ধামকিও দেয়। ইকরামুল হকও বলেন, অপেক্ষা করেন চাকরি হবে, টাকা ফেরত হবে না। এমন অনেকের কাছ থেকেই টাকা নিয়েছে মোফাজ্জল ও ইকরামুল।

অভিযোগ-৫ : সম্প্রতি শেখ রাসেলের জন্মদিন উপলক্ষ্যে ডিপিএইচই ভবনের সামনে একটি ব্যানার টানানো হয়। সেই ব্যানার ইচ্ছা করে খোলার অভিযোগ এনে ভবনে তুলকালাম কাণ্ড করেন মোফাজ্জল ও তার সহযোগীরা। ওই ঘটনায় ফেসবুকে লাইভ করে বঙ্গবন্ধুর নামে স্লোগান দিয়ে তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলীর রুমে দলবল নিয়েও প্রবেশ করেন মোফাজ্জল গং। যা চাকরি বিধির সম্পূর্ণ পরিপন্থি। এরপর ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ে বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী সরোয়ার হোসেনকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করেন তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী সাইফুর রহমান।

কমিটির প্রধান ও বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী সরোয়ার হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ওই ব্যানার কেউ ইচ্ছা করে খোলেনি। ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের তাণ্ডবে সেটি পড়ে যায়। অন্যকিছু নয়। তারা (মোফাজ্জল) যে অভিযোগ এনে ফেসবুক লাইভ ও স্লোগান দিয়েছে, তার কোনো সত্যতা পাইনি। তদন্ত কমিটি যথা সময়ে ওই ঘটনার বিস্তারিত উল্লেখ করে প্রতিবেদন দিয়েছে।’

অভিযোগ-৬ : সিসিটি মো. আজাদের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটূক্তির অভিযোগ আনেন মোফাজ্জল। আজাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনার পরই তাকে চাকরি থেকে অপসারণ এবং তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি তোলেন মোফাজ্জল। মোফাজ্জলের দাবির ভয়ে ভীত হয়ে তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী সাইফুর রহমান অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী তুষার মোহন সাধু খাঁকে প্রধান করে আবারও তদন্ত কমিটি গঠন করেন। কিন্তু তদন্ত কমিটি অভিযোগের কোনো সত্যতা খুঁজে পায়নি বলে জানা গেছে।

সিসিটি আজাদ তার বিরুদ্ধে তোলা অভিযোগের বিষয়ে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘মোফাজ্জল যে অভিযোগ তুলেছিল সেটি ভুয়া ও বানোয়াট। ওই সময় মোফাজ্জলের সঙ্গে আমার কথা কাটাকাটি হয়েছিল বিধায় সে ওই সময় আমার নামে মিথ্যা অপবাদ দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। মূলত ব্যক্তিগত রেষারেষিতে ও এমনটা করেছে।’

আজাদের বিষয়ে গঠন করা তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী তুষার মোহন সাধু খাঁ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ব্যানারটি বাতাসে পড়ে গিয়েছিল। সেখানে বঙ্গবন্ধুর ছবি ছিল, সবাই ওই ব্যানারের ওপরে জুতা পরে হাঁটছিল। এটি দেখে নির্বাহী প্রকৌশলী রওশন এটাকে সরিয়ে রেখেছিল। এর বাইরে কিছুই নয়। দুই পক্ষের মধ্যে বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে। এখানে বঙ্গবন্ধুকে অবমাননা ও কটূক্তি করার প্রমাণ তদন্ত কমিটি পায়নি। আমরা তদন্ত রিপোর্ট জমা দিয়েছি।’

অভিযোগ-৭ : এ প্রতিবেদকের কাছে আসা এক ফোনকল রেকর্ডে শোনা যায়, একটি চিঠির স্মারক ফেলতে এক ভুক্তভোগীর কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা দাবি করেন মোফাজ্জল। তিনি সৈয়দ ইকরামের কাছে দ্রুত টাকা জমা দিতে বলেন। টাকা দিলেই কাজটি হয়ে যাবে বলে ভুক্তভোগীকে নিশ্চিত করেন মোফাজ্জল। কিন্তু টাকা দিতে না পারায় দুই দিন পর ভুক্তভোগীকে বলেন, আপনার কাজটি আর হবে না। আপনার ফাইল নিয়ে যান। ফেরত দেওয়া ফাইলে দেখা যায়, স্মারক পেলেও সেটি আবার কেটে দেওয়া হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ভুক্তভোগী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘মোফাজ্জল আমাকে পরে জানিয়েছিল, ইকরামের কাছে টাকা দিতে বলেছিলাম আপনাকে। কিন্তু আপনি টাকা দেননি। তাই স্মারক নম্বর দিয়েও কেটে ফেলা হয়েছিল। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরে মোফাজ্জল ও ইকরামের এমন চাঁদাবাজির কথা এখন ওপেন সিক্রেট। তারপরও তাদের বিরুদ্ধে অধিদপ্তর ব্যবস্থা নিতে পারে না। মোফাজ্জল প্রভাব খাটিয়ে অধিদপ্তরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় নিজের লোকদের বসিয়েছে। এতে করে অফিসারদের ব্যক্তিগত তথ্য নিয়ে প্রতিনিয়ত মানুষদের ব্ল্যাকমেইল করছে।’

অভিযোগ-৮ : সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা ১৯৭৯ এর বিধি ২২ অনুযায়ী, কোনো সরকারি কর্মচারী বিভাগীয় প্রধানের অনুমতি ছাড়া নিজের দায়িত্ব ব্যতীত কোনো টেলিভিশন ও পত্র/পত্রিকায় বক্তব্য দিতে পারবেন না। কিন্তু তিনি প্রতিনিয়ত কর্মচারী বিধিমালা লঙ্ঘন করে বিভিন্ন পত্র/পত্রিকা ও টিভিতে বক্তব্য দেন।

অভিযোগ-৯ : নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিপিএইচই’র এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘সাবেক প্রধান প্রকৌশলী সাইফুর রহমানকে ব্ল্যাকমেইল করে প্রধান প্রকৌশলীর দপ্তরের প্রধান সহকারীর দায়িত্ব নেন ইকরাম। এর আগে তিনি ল্যাবরেটরিতে কর্মরত ছিলেন। মূলত এখান থেকে বিভিন্ন কর্মকর্তাদের গোপনীয় তথ্য মোফাজ্জলকে সরবরাহ করেন ইকরাম। সেই তথ্য মোফাজ্জল তুলে দেন কথিত ভুঁইফোঁড় সাংবাদিকদের হাতে। এরপর শুরু হয় কর্মকর্তাদের ব্ল্যাকমেইলিং ও নীরব চাঁদাবাজি। তাদের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

‘মোফাজ্জল’ সিন্ডিকেটে অসহায় ডিপিএইচই কর্মকর্তারা! 

সৈয়দ ইকরাম মোফাজ্জলের প্রধান সহযোগী। মোফাজ্জলের সব অপকর্মের দেনদরবার ইকরাম করে থাকেন। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরে দৈনিক হাজিরাভিত্তিক সিসিটি (ক্লার্ক কাম টাইপিস্ট) পদে ২০০৬ সালের ২৯ জুন সেগুনবাগিচা ভাণ্ডার বিভাগে কাজ শুরু করেন ইকরাম। তিনি মোফাজ্জল গংয়ের সব অপকর্মের সাক্ষী। নিজেও অপকৌশলে নিয়েছেন পদোন্নতি। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী অধিদপ্তর ২০১৩ সালে ২২৪ জনকে ক্লার্ক কাম টাইপিস্ট ও এলডিএ’দের জ্যেষ্ঠতা তালিকা প্রণয়ন করে। সেই তালিকায় ইকরামের ক্রমিক নং ছিল ১৮৩। তিনি তখন প্রধান প্রকৌশলীর দপ্তরে কর্মরত ছিলেন। ২০১৪ সালের জুন মাসে সেই জ্যেষ্ঠতা তালিকায় ৩১ জন কর্মচারীকে টপকে ১৭ জুন প্রধান প্রকৌশলীর কার্যালয়ের উচ্চমান সহকারী পদে পদোন্নতি পান মোফাজ্জল গংয়ের ডান হাত ইকরাম।

তার এ পদোন্নতি বিধিসম্মত না হওয়ায় নিয়োগ ও পদোন্নতি কমিটির সদস্য বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের সহকারী পরিচালক এম এ মান্নান পদোন্নতি সংক্রান্ত কার্যবিবরণীতেও স্বাক্ষর করেননি। তার স্বাক্ষর ছাড়াই পদোন্নতি দেওয়া হয় ইকরামকে। অবৈধভাবে পদোন্নতি গ্রহণ করায় তার সঙ্গে নিয়োগকৃত ও তার চেয়ে জ্যেষ্ঠরা (১৫০ জন কর্মচারী) আন্দোলনও করেন।

আন্দোলনকারীরা সৈয়দ ইকরামুল হকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট আবেদন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়ে ২০১৭ সালে পদোন্নতি যোগ্য ২৯ জন কর্মচারীকে উচ্চমান সহকারী পদে পদোন্নতি প্রদান করে। সেই পদোন্নতিতেও একসঙ্গে নিয়োগকৃত এবং তার চেয়ে জ্যেষ্ঠ ১৩ জন কর্মচারী পদোন্নতি বঞ্চিত হন। এরপর ২০১৮ সালে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরে কর্মরত উচ্চমান সহকারী/হিসাবরক্ষকদের খসড়া জ্যেষ্ঠতা তালিকা প্রদান করা হয়। সেই তালিকায় তিনি কর্মচারী ইউনিয়নকে ব্যবহার করে তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলীকে চাপ দিয়ে তার চেয়ে ২৩ বছর আগে চাকরিতে যোগদানকৃত কর্মচারীকে জুনিয়র বানান। সকল ক্ষেত্রে তিনি কর্মচারী ইউনিয়নকে ব্যবহার করেন।

২০০৬ সালে নিয়োগকৃত কয়েকজন কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমরা সৈয়দ ইকরামুল হকের সঙ্গে ক্লার্ক কাম টাইপিস্ট পদে চাকরিতে যোগদান করি। আমরা তার সিনিয়র অথচ সে আজ দুটি পদোন্নতি নিয়ে প্রধান সহকারী পদে কর্মরত। আমরা এখনও সিসিটি পদে রয়ে গেলাম। ইকরামুল কর্মচারী ইউনিয়নকে ব্যবহারের মাধ্যমে প্রশাসনকে চাপ প্রয়োগ করে এসব পদোন্নতি নিয়েছে। তারা ইকরামুল হকের বিরুদ্ধে মামলা করার কথাও জানান।

অভিযোগ রয়েছে ইকরামুল হক সংগঠনের নামে চাঁদাবাজি ও ঘুষ বাণিজ্য করে রাজধানীর বসিলায় দুটি ফ্ল্যাট ও বসুন্ধরায় তিনটি প্লট কিনেছেন। এছাড়া, মোফাজ্জল তার সকল অর্থনৈতিক লেনদেন ইকরামুলের মাধ্যমেই করেন বলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে।

সৈয়দ ইকরামুল তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের বিষয়ে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আপনি আমার অফিসে আসেন। বসে কথা বলব। এগুলো নিয়ে ফোনে কিছু না বলাই ভালো। আপনি আসেন, সাংবাদিক হিসেবে না, ভাই হিসেবে আসেন। কেউ কিছু জানবে না।’

ঘুষ, বদলি বাণিজ্য এবং কোন পদে চাকরি করেন— এসব বিষয়ে অভিযুক্ত মোফাজ্জল হোসেনকে প্রশ্ন করলে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আপনি যাচাই-বাছাই করে তারপর নিউজ করেন। ভবনে আসলে আমার সঙ্গে দেখা করে কথা বলে নিউজটা করেন। আমি ডিপিএইচইতে অফিস সহকারী এবং এখন অ্যাকাউন্টস অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে আছি।’

ঘুষ, বদলি বাণিজ্য এবং চাকরির নামে টাকা হাতিয়ে নেওয়া তো দূরের কথা তিনি কর্মচারীদের কাছ থেকে এক কাপ চা ও খান না— দাবি করেন মোফাজ্জল। বলেন, ‘এসব অভিযোগের প্রমাণ দিতে পারলে আমি চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে যাব।’

এত ছোট পদে চাকরি করে দেশ-বিদেশে সহায়তা দেন কীভাবে— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের সংগঠন থেকে কোভিডের সময় মানুষদের সহায়তা করেছি। ওই সময় সংগঠনের মাধ্যমে নিজেরা রান্না করে মানুষের মাঝে বিতরণ করেছি। আপনি চাইলে ছবি দিতে পারব। এছাড়া, শীতার্তদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ করেছি। এখানে আমি মোফাজ্জল একা কোন কিছু করিনি। যা হয়েছে সাংগঠনিকভাবে হয়েছে। আমি সম্প্রতি তুরস্কে কম্বল পাঠিয়েছি। এগুলো আমার ব্যক্তিগত কোনো উদ্যোগ নয়। সব সংগঠনের লোকজনের টাকায় করা হয়েছে।’

বঙ্গবন্ধুর ছবি অবমাননার বিষয়ে মোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘যারা বঙ্গবন্ধুর ছবি অবমাননা করেছে, তাদের বিচারের দাবি করেছিলাম। আপনি আমার বিষয়ে না জেনে কোনো কিছু লিখবেন না। লিখলে কষ্টটা আমার ভেতরে থেকে যাবে। এজন্য আমি বলি আপনি আরও বিস্তারিত জানেন।’

তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কিছু বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

এসব অভিযোগের বিষয়ে নির্বাহী প্রকৌশলী নজরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমি জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি এবং মোফাজ্জল সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সেই সুবাদে তাকে চেনা। তিনি আরও একটি কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক। তার ব্যক্তিগত কোনো অপকর্মের বিষয়ে আমি জানি না। আগে থেকে তার সঙ্গে আমার কোনো পরিচয় ছিল না।

‘তিনি সিসিটি আর আমি নির্বাহী প্রকৌশলী। এখানে তার সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের কিছু নেই। তবে সম্প্রতি তার কম্বল বিতরণের বিষয়টি সবার নজরে এসেছে। একজন সরকারি কর্মচারী হিসেবে তিনি এটি পারেন না। তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ সত্য হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। না হয় ডিপিএইচই-এর ভাবমূর্তি সংকটে পড়বে।'

মোফাজ্জলের কর্মকাণ্ডের বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের পানি সরবরাহ অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. খাইরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি মোফাজ্জল নামের কাউকে চিনি না বা আমার সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগ নেই। আমি খোঁজ নিয়ে দেখব আসলে এ নামের লোকটা কে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে আমরা মন্ত্রণালয় থেকে তদন্তসাপেক্ষে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেব।’

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মো. সরোয়ার হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘সম্প্রতি প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে নতুন দায়িত্ব নিয়েছি। মোফাজ্জলের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত আমার কাছে কেউ সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগ করেননি। তবে, আমি তার নানা কর্মকাণ্ডের বিষয়ে আগে শুনেছি। সম্প্রতি ওদের (মোফাজ্জল) সংগঠনের মিটিংয়ের আলোচনার চিঠি আমার কাছে এসেছে। সেখানে ও আগে কোন কোন দল করত সেগুলোর আলোচনা দেখলাম। আসলে বিষয়টা আমাদের দপ্তরের সঙ্গে সম্পৃক্ত না। কাজেই বিষয়টা আমলে নেওয়ার কিছু নেই। তবে, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তদন্ত করে আমি ওর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।’

তদবির ও চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে মানুষের কাছ থেকে মোফাজ্জলের টাকা হাতিয়ে নেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মোফাজ্জল মাঝে মাঝে বিভিন্ন সুপারিশ করে। আইনের মধ্যে থাকলে ওর সুপারিশ মাঝে মাঝে রাখতে হয়। আমি প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর ওর বিরুদ্ধে অভিযোগ পাইনি। তবে, কোনো অভিযোগের তথ্য-প্রমাণ পেলে প্রশাসনিকভাবে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

‘মোফাজ্জল ও ইকরাম চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে মানুষের কাছে টাকা নিয়েছে— বিষয়টিও আমার জানা নেই। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।’
 
এসআর/এমএআর