সমকামী গ্রুপে যোগাযোগের পর রুম ডেটের জন্য স্থপতি ইমতিয়াজ মোহাম্মদ ভূঁইয়াকে ডেকে নেয় সমকামীদেরই একটি গ্রুপ। এরপর তাকে ব্ল্যাকমেইল করে চাহিদামতো টাকা না পেয়ে হত্যা করে অভিযুক্ত আরাফাত-আলিফসহ তাদের সহযোগীরা।

মুন্সীগঞ্জ থেকে লাশ উদ্ধারের পর স্থপতি ইমতিয়াজ হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। ইতোমধ্যে অভিযুক্ত পাঁচজনকে শনাক্তের পর তিনজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এরপরই বেরিয়ে আসে স্থপতি ইমতিয়াজ হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যের পুরো ঘটনা।

স্থপতি ইমতিয়াজ হত্যা মামলায় অভিযুক্ত চার আসামি

গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে জানা যায়, একটি সমকামী চ্যাটিং(গে চ্যাটিং) অ্যাপসের সদস্য আলিফ। সেই অ্যাপসের অনুসারী ছিলেন স্থপতি ইমতিয়াজও। এরই সূত্র ধরেই আলিফের সঙ্গে পরিচয় হয় ইমতিয়াজের। একদিন আলিফ তার সমকামী সঙ্গী আরাফাতের কলাবাগানের ক্রিসেন্ট রোডের বাসায় ইমতিয়াজকে ডেকে নেয়। সেখানে ফাঁদ পেতে করা হয় ব্ল্যাকমেইল। ইমতিয়াজের কাছে দাবি করা হয় মোটা অঙ্কের টাকা। কিন্তু সেই টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানায় ইমতিয়াজ। আর এতেই ক্ষুব্ধ হয়ে আরাফাতের নির্দেশে ব্যাপক মারধর করা হয় ইমতিয়াজকে। একপর্যায়ে ইমতিয়াজ মারা গেলে তার মরদেহ মুন্সিগঞ্জ সিরাজদিখানের নির্জন স্থানে ফেলে পালিয়ে যায় আরাফাত ও তার ঘনিষ্ঠ সমকামী মুন্না, মেঘ হিজড়া ও আলিফ।

অভিযুক্তরা হলেন- আরাফাত ওরফে ফয়সাল আহমেদ রাহাত ওরফে হৃদয়, মিল্লাত হোসেন মুন্না (১৯), আলিফ, এহসান ওরফে মেঘ হিজড়া(২৩) ও আনোয়ার হোসেন(৩৮)। এদের মধ্যে মিল্লাদ হোসেন মুন্না, আনোয়ার হোসেন ও এহসান ওরফে মেঘ হিজড়াকে পৃথক তিন জেলা থেকে গ্রেপ্তার করে ডিবি তেজগাঁও বিভাগের দল।

জানা যায়, নিহত ইমতিয়াজ ঢাকার তেজগাঁও থানা এলাকার মোহাম্মদ হোসেন ভূঁইয়ার ছেলে। তিনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বাড়ির নকশার কাজ করতেন। তাঁর স্ত্রী, এক ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে। স্থপতি ইমতিয়াজ তেজগাঁও থানার ডমিসাইল এলাকায় নিজের ফ্ল্যাটে সপরিবারে বসবাস করতেন।

ডিবি পুলিশ বলছে, অভিযুক্ত আরাফাত গত আট বছর যাবত সমকামিতার মতো অসামাজিক ও অনৈসলামিক কার্যক্রমে জড়িত। সে মুন্না, আলিফ ও মেঘ হিজড়াকে দিয়ে ক্লায়েন্ট সংগ্রহ করতো। এরপর সমকামী বিভিন্ন লোকজনকে রুম ডেটের কথা বলে বাসায় ডেকে নিয়ে আসত। পরে বিভিন্ন কায়দায় ব্ল্যাকমেইল করে নগদ টাকাসহ গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র হাতিয়ে নিত তারা।

আরও পড়ুন- স্থপতি ইমতিয়াজ হত্যার অভিযোগে ৩ জন গ্রেপ্তার

নিখোঁজ জিডি, মামলা ও গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত ৭ মার্চ দুপুর ১টা ১০ মিনিটে তেজগাঁও হুন্ডাগলির বাসা থেকে ছেলেকে নিয়ে বের হন স্থপতি ইমতিয়াজ। তিনি দুই জমজ মেয়েকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে প্রিন্টিংয়ের কাজের উদ্দেশ্যে যাচ্ছেন বলে বের হন। এরপর তিনি আর ফেরেননি। স্ত্রী তেজগাঁও থানায় যান। সেখানে থানা পুলিশ ইমতিয়াজের লোকেশন খুঁজে দেখেন তার সর্বশেষ লোকেশন ৪টা ১৮ মিনিটের দিকে কলাবাগান থানার ক্রিসেন্ট রোডে। এদিন রাতেই নিখোঁজ ইমতিয়াজের স্ত্রী কলাবাগান থানায় নিখোঁজ জিডি করেন।

নিখোঁজের পরদিন ৮ মার্চ সন্ধ্যায় মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানের চিত্রকোট কামারকান্দা সেতু এলাকা থেকে অজ্ঞাতপরিচয় এক ব্যক্তির মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। আইনি প্রক্রিয়া শেষে ৯ মার্চ পুলিশ মরদেহ আঞ্জুমান মুফিদুলে হস্তান্তর করে। এর ১০ দিন পর পরিবার জানতে পারে- ইমতিয়াজ মোহাম্মদ খুন হয়েছেন। সিরাজদিখানে যে ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করা হয়েছে তা ইমতিয়াজের বলে শনাক্ত করে ইমতিয়াজের স্বজনরা।ওই ঘটনায় সিরাজদিখান থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের হয়।

এ বিষয়ে ডিবি তেজগাঁও জোনাল টিমের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) এনামুল হক মিঠু ঢাকা পোস্টকে বলেন, নিখোঁজ জিডির তদন্তের এক পর্যায়ে দেখতে পাই নিখোঁজ ইমতিয়াজের সঙ্গে সর্বশেষ তিনবার পরপর কথা হয়েছে একটি নাম্বারে। আমরা তার পরিচয় বিস্তারিত খুঁজে দেখি নাম আলিফ। পরে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় অভিযুক্ত সকলের নাম্বার খুঁজে পাই। এসময় আরাফাত ওরফে ফয়সাল ওরফে হৃদয়, মিল্লাত হোসেন মুন্না ওরফে মুন ও এহসান ওরফে মেঘ হিজড়ার মোবাইল নম্বরও বন্ধ পাই। তবে তাদের একে অপরের পরিচয় ও যোগাযোগের তথ্য মেলে। তারা সবাই গে বা সমকামী।

পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, মুন্না গত চার মাস বাসায় আসে না, থাকে কলাবাগানের ক্রিসেন্ট রোডে আরাফাতের বাসায়। মুন্না ফোন করে পরিবারকে জানায়, আরাফাতের সঙ্গে সে ভারত চলে গেছে। তার জরুরি টাকা দরকার। বিকাশ নাম্বার দেয়। সেই নাম্বারে টাকা দিতে বলে। সেই বিকাশ নম্বরের সূত্র্র ধরে মেলে ময়মনসিংহ মুক্তাগাছার ঠিকানা। যেখানে কাদের ও ফুলকি নামে দুই হিজড়ার সন্ধান মেলে। ফুলকি হিজড়া ভারতে থাকে। ফুলকি হিজড়ার মাধ্যমে টাকা চাচ্ছিল মুন্না। পরে তাদের অবস্থান নিশ্চিত হয়ে ফেরত পাঠানোর জন্য পারিবারিকভাবে চাপ দেয়া হয়। পরে গত ১৩ মার্চ আরাফাত ও মুন্না আখাউড়া সীমান্ত হয়ে দেশে ফিরে আসে।

ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান হারুন অর রশীদ

ডিবি পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ভারত থেকে ফিরে আরাফাতের গ্রামের বাড়ি পঞ্চগড়ে চলে যায় মুন্না ও আরাফাত। সেখান থেকে তারা রংপুরে যায়। এরপর দুজন বিচ্ছিন্ন হয়ে মুন্না সিরাজগঞ্জে মামার বাসায় আশ্রয় নেয়। সেখান থেকেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। মুন্নার জবানবন্দিতে উঠে আসে হত্যা ও সমকামিতার নামে ফাঁদ পেতে ভয়াবহ প্রতারণার গল্প।

মুন্না জিজ্ঞাসাবাদে গোয়েন্দা পুলিশকে জানিয়েছে, অ্যাপসের মাধ্যমে আলিফের সঙ্গে পরিচয় হয় তার। গত ৬ মার্চ তাদের দেখা করার কথা ছিল। কিন্তু আরাফাত ৭ মার্চ দেখা করার কথা জানায়। ৭ মার্চ সেখানে যাওয়ার পর ফাঁদ পেতে ইমতিয়াজকে ব্ল্যাকমেইল করা হয়। তারা ছবিও তোলে। অর্থও দাবি করা হয়। কিন্তু ইমতিয়াজের কাছে টাকাই ছিল মাত্র ২০০। নগদ অর্থ না পেয়ে বেধড়ক মারধর করে হত্যা করা হয় ইমতিয়াজকে।

গুম করতে মরদেহ ফেলা হয় মুন্সিগঞ্জের নির্জন স্থানে

মারধরের ফলে আকস্মিক মৃত্যু হয় ইমতিয়াজের। যার ফলে মরদেহ সরাতে মরিয়া হয়ে উঠে আরাফাত। মগবাজার থেকে আনা হয় মেঘ হিজড়ার প্রাইভেটকার। তাতে মরদেহ উঠানো হয়। আর ইমতিয়াজের মোবাইল ভেঙ্গে হাতিরঝিলের পানিতে ফেলে দেয়া হয়। এরপর লাশ নিয়ে মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানের চিত্রকোট ইউনিয়নের কামারকান্দা গ্রামের নবাবগঞ্জ হাইওয়ে রোডের পাশের ঝোপে ফেলে দিয়ে তারা ঢাকা ফিরে আসে।

দুদিনের চেষ্টায় ভারতে পালায় আরাফাত-মুন্না

ওই রাতেই আরাফাত, মেঘ হিজড়া ও মুন্না চলে যায় নারায়ণগঞ্জ। সেখানে কেয়া নামক হিজড়ার পরিচিত রহিমার বাসায় আশ্রয় নেয়। ৮ মার্চ সেখানের একটি গ্যারেজে প্রাইভেটকার রেখে তারা ঢাকার সদরঘাট হয়ে চাঁদপুর, মুন্সিগঞ্জ থেকে দনপুর হয়ে কুমিল্লার আখাউড়া হয়ে অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ করে।

দেশে ফেরার পর সিরাজগঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার মুন্নার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে হত্যাকাণ্ডে জড়িত অপর আসামি আনোয়ার হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে এহসান ওরফে মেঘ হিজড়াকে নারায়ণগঞ্জ জেলার বন্দর থানা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। একইসঙ্গে মরদেহ বহনে ব্যবহৃত প্রাইভেটকার(ঢাকা মেট্রো-গ-১১-১৯৪৪) উদ্ধার করা হয়।

এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন গোয়েন্দা পুলিশ প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ বলেন, গ্রেপ্তারকৃতরা সমকামী এবং হিজড়া সদস্য। তারা একটি গে চ্যাটিং অ্যাপসের মাধ্যমে রুম ডেটের কথা বলে বিভিন্ন লোকজনকে বাসায় ডেকে নিত। সেখানে বিভিন্ন কায়দায় ব্ল্যাকমেইল করে টাকাসহ গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র হাতিয়ে নেয়া হতো।

হারুন বলেন, মামলা হয়েছে মুন্সিগঞ্জে। তবে নতুন করে আর মামলা করা হয়নি। আমরা গ্রেপ্তার আসামিদের মুন্সিগঞ্জের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ইতোমধ্যে আসামিদের রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তার তিনজনই ইমতিয়াজ হত্যায় নিজেদের সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার করেছে। পলাতক আলিফ ও মূলহোতা আরাফাতকে গ্রেপ্তারে চেষ্টা চলছে।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, গে চ্যাটিং অ্যাপসটির গ্রাহক প্রায় ৫০ মিলিয়ন। আমরা হত্যা মামলার আসামিদের খোঁজ করতে গিয়ে ভয়াবহ তথ্য পেয়েছি। আন্তর্জাতিকভাবে প্রচারিত এই অ্যাপসটি মূলত সমকামী বা গে’রা ব্যবহার করেন। সেই অ্যাপসে অনেক বাংলাদেশি ডাক্তার, আইনজীবী, বিচারপতি, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষকে মেম্বার হয়েছেন বলে তথ্য পেয়েছি। ইতোমধ্যে আমরা একজন উকিল, ডাক্তার ও ভিন্ন পেশার একজনকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দিয়েছি।

তিনি আরও বলেন, মুন্না ও আলিফ ক্লায়েন্ট সংগ্রহ করতো। ব্লাকমেইলের কাজে ব্যবহার করা হতে মেঘ হিজড়াকে। অ্যাপসটিতে মুন্না মুন নামে সমকামী হিসেবে বিভিন্নজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতো।

জেইউ/এমজে