নিখোঁজ-ধর্ষণ নিয়ে চট্টগ্রামে চাঞ্চল্য : অক্ষত উদ্ধার দুই শিশু
চট্টগ্রাম নগরে একের পর এক শিশু নিখোঁজ হচ্ছে। কয়েকদিন পর তাদের মরদেহ উদ্ধার হচ্ছে। কেউ বিকৃত যৌনাচারের শিকার হচ্ছে আবার কাউকে মুক্তিপণ না পেয়ে হত্যা করা হচ্ছে। অতীতের কয়েকটি ঘটনায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীদের উদ্ধারে থানা পুলিশের উদাসীনতাও পরিলক্ষিত হয়েছে।
এমন পরিস্থিতি সামনে রেখে নিখোঁজ শিশুদের উদ্ধারে তৎপর হয় নগর পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। সবশেষ পুলিশের চেষ্টায় অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার হয় নিখোঁজ হওয়া দুই শিশু।
রোববার (২ এপ্রিল) দিবাগত রাতে নগরের হালিশহর থানার সিএন্ডবি বড়পুকুর পাড় ও খুলশীর মাস্টার লেইন অগ্রদূত এলাকা থেকে পৃথক অভিযানে দুই শিশুকে উদ্ধার করা হয়।
বিজ্ঞাপন
পুলিশ সূত্র জানায়, হালিশহর থানার রামপুরা এলাকার বাসিন্দা পারভীন আক্তার গত ২৮ মার্চ সন্ধ্যায় তার মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস মাইশাকে (৯) পড়াশোনার জন্য বকাঝকা দেয়। মায়ের বকুনি খেয়ে শিশু মাইশা কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে পারভীন আক্তার ২৯ মার্চ হালিশহর থানায় একটি নিখোঁজ ডায়েরি করেন। এরপর হালিশহর থানা পুলিশ অজানা আশঙ্কায় তৎপর হয় এবং নিখোঁজ শিশুকে উদ্ধার করতে ছয় সদস্যের একটি টিম গঠন করে। ওই টিম এলাকার বিভিন্ন সূত্র ধরে বিভিন্ন লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। একই সঙ্গে সংগ্রহ করা হয় সম্ভাব্য বিভিন্ন পয়েন্টের সিসিটিভি ফুটেজ।
এছাড়াও শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে পোস্টারিং এবং মাইকিং করা হয়। টানা অভিযানের একপর্যায়ে রোববার দিবাগত রাতে হালিশহর থানার সিএন্ডবি বড়পুকুর পাড় থেকে মাইশাকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ।
বিজ্ঞাপন
হালিশহর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ জহির উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, সিএমপি কমিশনার স্যার আমাকে ডেকে বলেছেন, 'আর কোনো মৃত্যুর সংবাদ চাই না।' এরপর আমরা টানা অভিযান পরিচালনা করি। ঘটনার পর থেকে টানা পাঁচ রাত ঘুমাইনি। একদিন দই-কলা আরেকদিন মুড়ি-দই খেয়ে রোজা রেখেছি। উদ্ধারের পর জানা গেল ঘটনার দিন শিশুটি মায়ের সঙ্গে রাগ করে চট্টগ্রাম রেলস্টেশন চলে গিয়েছিল। সেখান থেকে একজন ব্যক্তিকে অনুসরণ করে পেছন পেছন হাঁটতে থাকে। পরে ওই ব্যক্তি তাকে বাড়িতে আশ্রয় দেয়। পাশাপাশি শিশুর ঠিকানা খুঁজে পেতে চেষ্টা করে। একপর্যায়ে আমরা ওই ব্যক্তির কাছ থেকে শিশু মাইশাকে উদ্ধার করি।
এদিকে পুলিশ সূত্র আরও জানায়, গত ২৭ মার্চ দিবাগত রাত ৯টার দিকে খুলশী থানার সেগুন বাগান এলাকা থেকে নিখোঁজ হয় জান্নাত আক্তার নামে এক শিশু। এ ঘটনায় খুলশী থানায় একটি নিখোঁজ ডায়েরি হয়। পরবর্তীতে শিশুকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধারে মাঠে নামে পুলিশ। টানা অভিযান পরিচালনা করা হয় নগরের বিভিন্ন স্থানে। একপর্যায়ে ওই থানার মাস্টার লেন অগ্রদূত ক্লাবের রেলওয়ের স্টাফ রেহেনা আক্তারের বাসা থেকে রোববার দিবাগত রাতে জান্নাতকে উদ্ধার করা হয়।
খুলশী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সন্তোষ কুমার চাকমা ঢাকা পোস্টকে বলেন, শিশু জান্নাত তার মা মারা যাওয়ার পর থেকে ভাইয়ের বাসায় থাকতেন। সেখান থেকে জান্নাতের খালাতো বোন সাজু আক্তার লালন-পালনের জন্য ভুক্তভোগীকে রেলওয়ের স্টাফ রেহেনার বাসায় দিয়ে দেন। তবে তিনি বিষয়টি কারও সঙ্গে শেয়ার করেননি। পরে পুলিশের অভিযানে তাকে উদ্ধার করা হয়।
নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) স্পিনা রানী প্রামাণিক বলেন, একের পর এক শিশু নিখোঁজের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করা হয়। থানা পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দা টিম এবং কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটও শিশুদের উদ্ধারে অভিযান পরিচালনা করে। এছাড়া পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) টিম উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করেছে।
এর আগে, গত ২১ মার্চ নগরের পাহাড়তলী থানা এলাকার আবিদা সুলতানা আয়নী (১০) নামে এক শিশু নিখোঁজ হয়। বিড়াল ছানা দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে মো. রুবেল (৩৫) নামে বাসার পাশের এক সবজি বিক্রেতা তাকে নিয়ে যায়। এরপর তাকে ওইদিন একটি বাসায় নিয়ে ধর্ষণের পর গলাটিপে হত্যা করে রুবেল। পরে বস্তা ভরে শিশুর মরদেহ ফেলে দেওয়া হয় পার্শ্ববর্তী একটি ডোবায়। পরে ২৯ মার্চ ভোর রাতে পিবিআইয়ের একটি টিম আয়নীর গলিত মরদেহ উদ্ধার করে। ওই সময় ঘটনাটি চট্টগ্রামজুড়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে।
শিশু আয়নীর মা বিবি ফাতেমার অভিযোগ ছিল, নিখোঁজের পর তার সন্তানকে উদ্ধারে একাধিকবার তিনি পাহাড়তলী থানা পুলিশের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। আসামি মো. রুবেল (৩৫) তার সন্তানকে নিয়ে গেছেন বলে পুলিশকে জানিয়েছিলেন। কিন্তু মায়ের এমন অভিযোগ কানেও নেয়নি পুলিশ। এ ঘটনায় একটি মামলাও নেয়নি পাহাড়তলী থানা পুলিশ। নিরুপায় হয়ে ভুক্তভোগী শিশুর মা আদালতে একটি মামলা করেন। মামলা দায়েরের পরদিনই শিশুর গলিত মরদেহ উদ্ধার করা হয়।
জানা গেছে, গত বছরের ১৪ নভেম্বর বিকেলে নগরের ইপিজেড এলাকা থেকে নিখোঁজ হয়েছিলেন আলিনা ইসলাম আয়াত (৫) নামে এক শিশু। মুক্তিপণ আদায়ের উদ্দেশ্যে তাকে অপহরণ করে প্রতিবেশী তরুণ আবীর আলী (১৯)। পিবিআইয়ের হাতে গ্রেপ্তারের পর ২৫ নভেম্বর আবীর পুলিশকে জানায়, আয়াতকে খুনের পর লাশ ছয় টুকরো করে সাগরের পানিতে ভাসিয়ে দিয়েছে। এরপর ৩০ নভেম্বর নগরের আউটার রিং রোডের আকমল আলী ঘাট সংলগ্ন স্লুইচ গেটের এক গর্ত থেকে আয়াতের দুই পা এবং পরদিন খণ্ডিত মাথা উদ্ধার করে পিবিআই কর্মকর্তারা।
এমআর/এমজে