জাহেদুল ইসলাম পেশায় ব্যবসায়ী। থাকেন গুলশান-১-এর তিন নম্বর সড়কের কেএফসি গলিতে। গত ২৫ জানুয়ারি সকালে ভবনের সাততলা থেকে স্কুলগামী মেয়েকে নামিয়ে দিতে বের হন। মেয়েকে স্কুলের গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে বাসায় ফিরতে সময় লাগে তিন থেকে সাড়ে তিন মিনিট। এর মধ্যেই তার বাসা থেকে চুরি হয়ে যায় একটি ল্যাপটপ, দুটি মোবাইল।

পুরো বাসায় তন্নতন্ন করে খুঁজে ল্যাপটপ ও মোবাইল না পেয়ে জাহেদুল সিসিটিভি ফুটেজ দেখেন। সেখানে ডাক্তার ও নার্সদের অ্যাপ্রন, মুখে মাস্ক এবং গলায় আইডি কার্ড পরিহিত এক তরুণীকে বাসায় প্রবেশ করতে দেখা যায়। 

তরুণীর পরিচয় সম্পর্কে বাসার দারোয়ান জানান, ওই তরুণী নিজেকে ডাক্তার পরিচয় দিয়েছিল। বলেছিল ফিজিওথেরাপিস্ট। জাহেদুল ইসলামের মাকে থেরাপি দেওয়ার জন্য এসেছে। এ পরিচয় দেওয়ায় তাকে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।

এ ঘটনায় গুলশান থানায় অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী। ওই অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত কার্যক্রমে গুলশান থানা পুলিশ জানতে পারে অভিজাত পাড়ায় রোমহর্ষক চুরির ঘটনা।

গতকাল বুধবার গুলশান-২ পুলিশ চেকপোস্টের সামনে থেকে চোরচক্রের প্রধান আফসানা আক্তার এশা ওরফে মিমকে (২২) গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

ডিএমপির গুলশান বিভাগ পুলিশ জানিয়েছে, ডাক্তার ও নার্সদের অ্যাপ্রন, মুখে মাস্ক এবং গলায় ভুয়া আইডি কার্ড পরে অভিজাত পাড়ায় অভিনব কায়দায় চুরি করে আসছিল মিম। তাকেসহ সংঘবদ্ধ চোরচক্রের ৬ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে গুলশান থানা পুলিশ।

গ্রেপ্তার অন্যরা হলেন- তন্ময় বিশ্বাস (৩০), স্বপন শেখ (৪৫), নুরুল ইসলাম (২৭), কলিম উদ্দিন কালু ওরফে কলিউল্লাহ (৪০) এবং মোখলেছুর রহমান (৫১)।

বুধবার (৫ এপ্রিল) রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। এসময় চুরি যাওয়া ৬টি ল্যাপটপ, ১০টি মোবাইল ফোন ও ২টি ব্যাগ উদ্ধার করা হয়।

বৃহস্পতিবার (৬ এপ্রিল) দুপুরে ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান গুলশান বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. আ. আহাদ।

তিনি বলেন, আমরা একটি চুরির তদন্ত করতে গিয়ে বেশ কয়েকটি চাঞ্চল্যকর চুরির ঘটনার তথ্য পাই। চোরচক্রের প্রধান মিম খুবই ধূর্ত। তার এহেন অপকর্মের প্রধান সহযোগী বয়ফ্রেন্ড তন্ময়।

ডিসি আ. আহাদ বলেন, কোনো বাসায় চুরির আগে রেকি করে চোরচক্রের সদস্যরা। বিশেষ করে খোঁজ রাখে কোন বাসায় অসুস্থ, বৃদ্ধ বাসিন্দা আছে। কোন বাসায় কখন মানুষ কম থাকে, কখন কারা বাচ্চাদের নিয়ে স্কুলে যায়। তবে সকালের সময়টা চুরির জন্য টার্গেট করে তারা। রাজধানীর গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি ও উত্তরার মতো অভিজাত এলাকা তাদের প্রধান টার্গেট। এসব এলাকায় এমনও দিন গেছে একাধিক চুরি সংঘটিত করেছে।

জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, গ্রেপ্তাররা সংঘবদ্ধ চোরচক্রের সক্রিয় সদস্য। চক্রের প্রধান মিম যোগসাজশে কখনো ডাক্তার, কখনো নার্স পরিচয় দিয়ে বাসায় প্রবেশ করেন। মাত্র ২/৩ মিনিটের মধ্যে ফাঁকা বাসা বা অসুস্থ বাসিন্দার উপস্থিতিতেও মোবাইল ল্যাপটপ নিয়ে সটকে পড়েন।

আ. আহাদ বলেন, বাসায় প্রবেশের আগে কিছু তথ্য সংগ্রহ করে চক্রটি। সেসব তথ্যের সঙ্গে মিল রেখে পরিচয় দেয়। নারী ডাক্তার বা নার্স পরিচয় দেওয়া, ডাক্তার বা নার্সের অ্যাপ্রন, মুখে মাস্ক এবং গলায় আইডি কার্ড পরা দেখে বাসার দারোয়ানরা সাধারণত সন্দেহ কমই করেন। এই সুযোগটাই ব্যবহার করে চুরি করে আসছে তারা।

তিনি বলেন, মিমসহ গ্রেপ্তারদের বিরুদ্ধে গুলশান থানাসহ বিভিন্ন থানায় মোট ১৪টি নিয়মিত মামলা ও ২টি সাজা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে। গুলশান, নিউমার্কেট, মোহাম্মদপুর ও তেজগাঁও থানায় একবার করে মোট চারবার গ্রেপ্তারও হয়েছিল মিম। এছাড়া  মোখলেছুর রহমান তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় একবার গ্রেপ্তার হয়েছিল।

রাজধানীবাসীকে সতর্ক করে দিয়ে আ. আহাদ বলেন, কোনো বাসায় ডাক্তার বা নার্স পরিচয়ে কেউ ঢুকতে চাইলে প্রবেশ করতে দেবেন না। যে কেউ আসুক না কেন, পরিচয় নিশ্চিত হয়েই প্রবেশে অনুমতি দেওয়া উচিত। বাসা বা ভবন মালিকদের সেটা নিশ্চিত করতে হবে, দারোয়ানদের তা জানাতে হবে।

ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী জাহেদুল ইসলাম বলেন, তাজ্জব হয়ে গেছি, এভাবেও চুরি হতে পারে। আমার বাসা অনেক নিরাপত্তাবেষ্টিত। বাসার দারোয়ান, সিসিটিভি, সবই ছিল। আমার মা অসুস্থ। তাকে মাঝেমধ্যে থেরাপি দিতে হয়। সেই তথ্য বলে ফিজিওথেরাপিস্ট পরিচয়ে বাসায় ঢোকে চোর মিম। মাত্র তিন মিনিট বাসায় ছিলাম না। এরমধ্যে মোবাইল ল্যাপটপ নিয়ে লাপাত্তা হয়ে যায় চোর।

জেইউ/জেডএস