বঙ্গবাজার অগ্নিকাণ্ডে যখন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা জীবন বাজি রেখে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছিলেন, তখনই একদল লোক ঝাঁপিয়ে পড়েন ফায়ার সদর দপ্তরে। বঙ্গবাজারের আগুনের ঘটনায় সবচেয়ে দ্রুত সময়ে সাড়া দেওয়া ও ইতিহাসের সব থেকে বেশি ইউনিট নিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা সত্ত্বেও সেখানে হামলা করা হয়।

ফায়ার সার্ভিসের সদর দপ্তরে হামলায় সরকারি সম্পত্তির ব্যাপক ক্ষতি সাধন হয়। অতর্কিত এই হামলায় ভাঙচুর করা হয় ফায়ার সার্ভিসের বিভিন্ন মডেলের ১৪টি গাড়ি, মেইন গেটের সেন্ট্রি পোস্ট, প্রশাসনিক ভবন ও সিনিয়র স্টেশন অফিসারের অফিস। এ হামলায় আনুমানিক ক্ষতির পরিমাণ ৩৯ লাখ ৯৩ হাজার ৫০০ টাকা। শুধু তাই নয়, হামলায় সিনিয়র কর্মকর্তাসহ আহত হন ফায়ার সার্ভিসের চার সদস্য।

মঙ্গলবার (৪ এপ্রিল) বঙ্গবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের দিন পার্শ্ববর্তী ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরে হামলা চালানো হয়। এ ঘটনায় অজ্ঞাত ২৫০-৩০০ জনকে আসামি করে ডিএমপির বংশাল থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়।

বৃহস্পতিবার (৬ এপ্রিল) ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টেশন অফিসার মো. শাহিন আলম বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন।

মামলায় বেআইনিভাবে সংঘবদ্ধ হয়ে ফায়ার সার্ভিসের অফিসার এবং সদস্যদের সরকারি কাজে পরিকল্পিতভাবে বাধা দিয়ে হত্যার উদ্দেশ্যে পিটিয়ে আহত ও সরকারি সম্পত্তি ভাঙচুর করে ক্ষতির সাধনের অভিযোগ আনা হয়।

মামলার এজাহারে বাদী অভিযোগ করে বলেন, গত ৪ এপ্রিল আনুমানিক সকাল ৬টা ১০ মিনিটে ৯৯৯ থেকে অগ্নিকাণ্ডের সংবাদ পেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে অফিসার ও ফায়ার ফাইটারদের সঙ্গে নিয়ে গাড়ি, পাম্প ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদিসহ ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নেভানোর কাজ শুরু করি। আগুনের ভয়াবহতা দেখে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানাই। এছাড়া কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষে জানমাল রক্ষার জন্য সব বাহিনীর সহযোগিতা চাই।

ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অনুযায়ী বিভিন্ন স্টেশনের ফায়ার সার্ভিসের ৫০টি ইউনিট, পুলিশ, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, র‌্যাব, বিজিবি, আনসার ও স্বেচ্ছাসেবক টিমের সহায়তায় আগুন নেভানোর কাজ চলছিল। সকাল আনুমানিক ৯টা ২৫ মিনিটে সিদ্দিক বাজারে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরে হামলার ঘটনা ঘটে। অজ্ঞাতনামা ২৫০-৩০০ জন হাতে লোহার রড, লাঠিসোঁটা ও ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের ওপর অতর্কিত হামলা করে অফিসের মধ্যে প্রবেশ করে।

উশৃঙ্খল জনতা একযোগে অফিসে প্রবেশ করে সরকারি কাজে বাধা দেয়। সেসময় তারা ধারালো অস্ত্র ও লাঠিসোঁটা নিয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের বিভিন্ন সদস্যকে মারধর শুরু করে। পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) মো. ওয়াহিদুল ইসলাম ও পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মেইনটেনেন্স) লে. কর্নেল তাজুল ইসলাম চৌধুরী জনতাকে থামাতে গেলে তারা তাদেরকেও হত্যার উদ্দেশ্যে ধাওয়া করে। তারা জীবন রক্ষার্থে দৌড়ে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের অভ্যন্তরে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেন।

এজাহারে আরও বলা হয়, অজ্ঞাতনামা আসামিরা ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের ভেতরে প্রবেশ করে লোহার রড, লাঠি ও ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে মোট ১৪টি বিভিন্ন মডেলের গাড় ব্যাপক ভাঙচুর করে। তারা কইকা ভবন, মেইন গেইটের সেন্ট্রি পোস্ট, প্রশাসনিক ভবন ও সিনিয়র স্টেশন অফিসারের অফিস ব্যাপকভাবে ভাঙচুর করতে থাকে।

এসময় বাধা দিলে তারা ফায়ার ফাইটার ইসলাম অন্তরকে লোহার রড দিয়ে ডান পায়ে আঘাত করে মারাত্মক জখম করে। এছাড়া ফায়ার ফাইটার রবিউল আতিকুল ইসলামকে লাঠি দিয়ে কোমরে আঘাত করে গুরুতর জখম করে। উপ-পরিচালক বাবুল চক্রবর্তীকে হত্যার উদ্দেশ্যে লাঠি দিয়ে তার মাথায় ও ডান হাতে সজোরে আঘাত করে গুরুতর জখম করে। চালক ইমন হোসেনকেও লাঠি দিয়ে পিঠে আঘাত করে মারাত্মক জখম করা হয়। তারা সবাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নেন।

এজাহারে আরও উল্লেখ করা হয়, উত্তেজিত জনতা মোট ১৪টি সরকারি গাড়ি, কইকা ভবন, মেইন গেটের সেন্ট্রি পোস্ট, অভ্যর্থনা কক্ষ, প্রশাসনিক ভবন ও সিনিয়র স্টেশন অফিসারের কার্যালয় ভাঙচুর করে মোট আনুমানিক ৩৯ লাখ ৯৩ হাজার ৫০০ টাকার ক্ষতি করেছে। সেসময় পুলিশ অতি দ্রুততার সঙ্গে লাঠি চার্জ ও টিয়ার সেল নিক্ষেপ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনে বড় ধরনের ধ্বংসযজ্ঞ থেকে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরকে রক্ষা করে।

হামলার পুরো ঘটনা সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজে রয়েছে উল্লেখ করে বাদী এজাহারে বলেন, অজ্ঞাতনামা ২৫০-৩০০ জন আসামি ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের তথা সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে হামলা ও সরকারি সম্পত্তি ভাঙচুর করে। 

অগ্নিনির্বাপণ শেষ করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা, আহতরা চিকিৎসাধীন থাকা ও ঘটনায় জড়িত অজ্ঞাতনামা আসামিদের নাম-ঠিকানা সংগ্রহের চেষ্টা করে থানায় এজাহার দায়ের করতে বিলম্ব হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন ফায়ার সার্ভিসের এ কর্মকর্তা।

ডিএমপির লালবাগ বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) জাফর হোসেন জানান, বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডের দিন ফায়ার সার্ভিস সদস্যদের মারধর, গাড়ি ভাঙচুর ও সদর দপ্তরে হামলার অভিযোগে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে দায়ের করা এ মামলায় অজ্ঞাত ২৫০-৩০০ জনকে আসামি করা হয়েছে।

এর আগে পুলিশের ওপর হামলা ও কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে অজ্ঞাত ২৫০-৩০০ জনকে আসামি করে পুলিশের পক্ষ থেকে আরেকটি মামলা দায়ের করা হয়।

বঙ্গবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর ফায়ার সার্ভিসের সদর দপ্তর ও সদস্যদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। এ সময় পুলিশ বাধা দিতে গেলে তাদের ওপরও হামলা করা হয়। এ ঘটনায় পুলিশের ওপর হামলা ও সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে মামলাটি দায়ের করা হয়।

এমএসি/কেএ