‘মানবতাবিরোধী অপরাধীদের সংগঠন’ হিসেবে জামায়াতকে নিয়ে বিএনপিকে দেশে-বিদেশে অনেক ভুগতে হয়েছে। বিএনপি সম্পর্কে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়েছে কূটনৈতিক মহলে।

এক সময়ের সবচেয়ে কাছের জোটসঙ্গী জামায়াতের সঙ্গে গত কয়েক বছর ধরে বিএনপির দূরত্ব বেড়ে চলেছে। রাজনৈতিক কর্মসূচি তো বটেই, সামাজিক অনুষ্ঠানেও একে-অপরকে এড়িয়ে চলছে। 

সর্বশেষ রাজনৈতিক নেতাদের সম্মানে আয়োজিত বিএনপির ইফতার অনুষ্ঠানে নতুন-পুরাতন জোটসঙ্গীদের পাশাপাশি জাতীয় পার্টিও অংশ নেয়। কিন্তু জামায়াতের কাউকে সেখানে দেখা যায়নি। 

ফলে, রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে আলোচনা উঠেছে- বিএনপি-জামায়াতের সম্পর্কে কি সত্যিই ভাটা পড়েছে নাকি এটি নির্বাচনী কৌশলের অংশ?

বিএনপি নেতারা বলছেন, ‘মানবতাবিরোধী অপরাধীদের সংগঠন’ হিসেবে জামায়াতকে নিয়ে বিএনপিকে দেশে-বিদেশে অনেক ভুগতে হয়েছে। বিএনপি সম্পর্কে অনেক নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়েছে কূটনৈতিক মহলে।

২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটে জামায়াত থাকার ইস্যুকে সামনে রেখে বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হতে অনেক দল আপত্তি জানিয়েছিল। এ কারণে ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপি আলাদা জোট করে। শুধু তাই নয়, জামায়াত জোটে থাকার কারণে আওয়ামী লীগ ‘স্বাধীনতাবিরোধী’ হিসেবে বিএনপিকে নিয়ে দেশে-বিদেশে প্রচারণা চালিয়েছে। এসব কারণে এবার ২০ দলীয় জোট ভেঙে দিয়ে বিএনপি যুগপৎ আন্দোলনে নেমেছে। এর মাধ্যমে জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্কে তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে শিথিলতা আসে। তারপরও যোগাযোগ ছিল দুই পক্ষে। সেই ধারাবাহিকতায় গত ২৪ ডিসেম্বর থেকে বিএনপির নেতৃত্বে যুগপৎ আন্দোলনে শুরু হলে সেখানে জামায়াতও অংশ নেয়। কিন্তু যুগপৎ আন্দোলনের দ্বিতীয় কর্মসূচি পালনের সময় গত ৩০ ডিসেম্বর মালিবাগে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় জামায়াত, যা বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ে পছন্দ হয়নি। এরপর থেকে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। 

গত ৩ এপ্রিল রাজনীতিবিদদের সম্মানে দেওয়া বিএনপির ইফতার অনুষ্ঠানে সাবেক ও বর্তমান জোটসঙ্গীদের দাওয়াত দেওয়া হলেও জামায়াতকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।

সূত্র বলছে, জামায়াতের সঙ্গে এখনো বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ২০দলীয় জোটের সাবেক সমন্বয়ক নজরুল ইসলাম খানের যোগাযোগ এখনো রয়েছে। যদিও তিনি বলছেন, নেই। আর লন্ডন-কেন্দ্রিক বিএনপি-জামায়াত সম্পর্ক কেমন আছে, সেটা কেউ জানে না। 

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নজরুল ইসলাম খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০ দলীয় জোটের সমন্বয়ক হিসেবে জামায়াতের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল। এখন জোট নেই, তাদের সঙ্গে আমার সম্পর্কও নেই। কেন তাদের দাওয়াত দেওয়া হয়নি, সেটা আমি জানি না। কারণ কাউকে দাওয়াত দেওয়ার দায়িত্বে আমি ছিলাম না।

জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা কোনো দাওয়াত পাইনি, তাই বিএনপির ইফতারে অংশ নিইনি।

বিএনপি নেতারা বলছেন, রাজনীতিতে কেউ স্থায়ী শত্রু নয়, আবার কেউ চিরদিনের বন্ধুও নয়। এই মুহূর্তে কাউকে শত্রু কিংবা মিত্র বানানো বিএনপির লক্ষ্য নয়। বিএনপির লক্ষ্য হচ্ছে সরকারবিরোধী আন্দোলনকে জোরদার করা। আর এখানে যত পারা যায় রাজনৈতিক দলগুলোকে যুক্ত করা। সরকারবিরোধী দলগুলোর মধ্যে জামায়াতকে নিয়ে বিভিন্ন পক্ষের আপত্তি ছিল, তাই অনেকটা আলোচনার ভিত্তিতে কৌশলগত কারণে তাদের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে চলা হচ্ছে।

জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির দীর্ঘদিনের মৈত্রী ছিল। কীভাবে তার পরিসমাপ্তি হবে সেটা এখন প্রশ্ন।

বিএনপি কৌশলগত কারণে দূরত্ব বজায় রাখলেও জামায়াত বিষয়টিকে কীভাবে নিচ্ছে তা বোঝা মুশকিল। কারণ তাদের অনেক কার্যক্রমে সন্দেহ তৈরি হয়। ফলে, বিএনপি-জামায়াতের এই দূরত্ব নিয়ে দলের মধ্যে এক ধরনের ধোঁয়াশা আছে বলে মনে করছেন বেএনপি নেতারা।

জামায়াত নেতা মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, বিএনপি একটা নীতি-আর্দশ নিয়ে রাজনীতি করে। আমরাও একটা নীতি আদর্শ নিয়ে রাজনীতি করি। ফলে, বিএনপি কার সঙ্গে জোট গঠন করবে কিংবা সম্পর্ক রাখবে সেটা তাদের বিষয়। তবে, জামায়াত সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক চায়। এটা গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য। কোনো দল যদি জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক না রাখতে চায় তাহলে জামায়াত কী করতে পারে?

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে এখন যে দূরত্ব সেটা একটা কৌশল। কিন্তু এই কৌশল দুই পক্ষের মধ্যে সততার নাকি চালাকির সেটা পরিষ্কার নয়। তবে, এটুকু বলতে পারি, এখানে যারা চালাকি করবে, তারা ঠকবে। কৌশলগতভাবে এই দূরত্ব বজায় থাকলেও নিশ্চয়ই নির্বাচন ঘনিয়ে আসলে আবারও সম্পর্কের উন্নয়ন হবে। আর চালাকির হলে সেটাও স্পষ্ট হবে।

এই নেতা আরও বলেন, জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির দীর্ঘদিনের মৈত্রী ছিল। কীভাবে তার পরিসমাপ্তি হবে সেটা এখন প্রশ্ন। আপনি জামায়াতের সঙ্গে ভেতরে-ভেতরে সম্পর্ক রাখবেন, আবার কোনো অনুষ্ঠানে দাওয়াত দেবেন না, এটা তো হতে পারে না। আবার জামায়াত মুখে যদি বলে, আমরা বিএনপির সঙ্গে থাকতে চাই, কিন্তু তাদের কর্মকাণ্ড যদি বিএনপির বিপক্ষে যায়, বিএনপির কর্মসূচিকে ক্ষতিগ্রস্ত করার পক্ষে হয় তাহলে সেটাও দ্বিমুখী আচরণ হয়ে গেল।

এএইচআর/এসএম/জেএস