সিরাজগঞ্জ জেলার শাহাজাদপুরে দাঁড়িয়ে আছে ব্রিজ/ ছবি- ঢাকা পোস্ট

প্রকল্প সময় মতো শেষ হবে না- এ যেন অলিখিত নিয়ম। সেতু আছে নদী নেই- এমন চিত্রও চোখসওয়া। ফলে গত জুনে যে সেতুর কাজ শেষ হওয়ার কথা, তা যদি ইতোমধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ শেষ হয়ে থাকে তাহলে খুশিই হওয়ার কথা। কিন্তু খুশি হতে পারছেন না শাহাজাদপুরের পুটিয়া গ্রামের মানুষ।

• চার বছরের প্রকল্প শেষ হচ্ছে ছয় বছরে
• অধিগ্রহণ না করেই জোড়পূর্বক জমি নেওয়ার চেষ্টা : জমির মালিক
• জোরপূর্বক জমি নিয়েছি কেউ বললে নিউজ করতে পারেন : প্রকল্প পরিচালক
• বাংলাদেশে কোনো প্রকল্পই সময়মতো শেষ হয় না : মির্জ্জা আজিজ

তারা বলছেন, ব্রিজ হলে হবেটা কী? ব্রিজ হবে, তবে মিলবে না রাস্তায়। কেননা, ব্রিজের কাজ প্রায় শেষ হলেও যে রাস্তায় এটি মিলবে, সেই রাস্তা নির্মাণে ভূমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন হয়নি। রাস্তা হলেও চিন্তার বলিরেখা রয়ে যাবে গ্রামবাসীর মুখে। নিজ চোখেই দেখছি, সংযোগ সড়কের জন্য মাটি ফেলা হচ্ছে। সেই মাটি কাটা হচ্ছে ব্রিজের কম্বাইন্ড ফুটিং বেজের গোড়া থেকেই।  

বেজ বা পিয়ারের গোড়া থেকে মাটি কাটার ফলে ব্রিজটি নিয়ে শঙ্কা রয়েছে জানান সিভিল ইঞ্জিনিয়ার মো. সুমন মিয়া। তিনি বলেন, ‘যদি ব্রিজটির পাইলিংয়ের ওপর কম্বাইন্ড ফুটিং বেজটি করা হয়, তাহলে কোনো সমস্যা নেই। আর যদি শুধু কম্বাইন্ড ফুটিং বেজের ওপর ব্রিজটি নির্মাণ করা হয়, তাহলে এভাবে মাটি কাটার ফলে ব্রিজে ফাটল দেখা দিতে পারে। কারণ, বেজের নিচে যদি মাটি না থাকে তাহলে পিয়ারগুলো ব্রিজের লোড নিতে পারবে না। আর লোড নিতে না পারলে এক সময় ব্রিজটি ফাটল ধরা থেকে ভেঙেও যেতে পারে।’

পুটিয়া গ্রামের বাসিন্দা মো. আজিমুল ইসলাম। তার জমির ওপর দিয়ে সংযোগ সড়ক গিয়ে মিলবে ব্রিজে। কিন্তু তিনি বলছেন, ‘রাস্তা গিয়ে ব্রিজে মিলুক, গ্রামের উন্নয়ন হোক- সেটা আমিও চাই। কিন্তু আমার জমি অধিগ্রহণের কোনো কথা হয়নি।’

তিনি বলেন, ‘তারা আমার জমি অধিগ্রহণ না করেই রাস্তার জন্য মাটি ফেলতে শুরু করেছে। জোড়পূর্বক জমি নেওয়ার চেষ্টা করছে। আমরা রাস্তার কাজে বাধা দেইনি।’

তবে কয়েকজন এলাকাবাসী জানান তাদের জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। আজিমুল ইসলাম বলেন, ‘আশপাশে সবাইকে টাকা দিয়ে জমি নিয়েছে। আমাকেও টাকা দিতে চেয়েছিল, কিন্তু সেটা অনেকটা আমার কাছ থেকে ব্যক্তি পর্যায়ে ক্রয় করার মতো ব্যাপার। সরকারের অধিগ্রহণ নয়। আমি বলেছি আমাকে যাই দেন, একবারে সব টাকা পরিশোধ করে দিলে জায়গা দেবো।’

তিনি বলেন, ‘আমার একই জমির ওপরে সরকারি দুটি প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে। এর আগে একই জমির একপাশে অধিগ্রহণ করে খাল খনন করা হয়েছে। এখন ভূমি অফিস থেকে বলছে, জমির ওই মাথা এলজিইডি অধিগ্রহণ করছে কিন্তু এইপাশে রাস্তার জন্য অধিগ্রহণ করা আছে।’

জোরপূর্বক জমি দখল করে রাস্তার জন্য মাটি ফেলার অভিযোগ প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক নাজনীন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘জোরপূর্বক জমি নিয়েছি এরকম কেউ বলে থাকলে আপনি নিউজ করতে পারেন।’ 

সেতুর কাজের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি সম্প্রতি ফিল্ড ভিজিট করেছি। ব্রিজের কাজ মানসম্পন্ন হয়েছে। আর সংযোগ সড়ক হয়নি বিষয়টি তা নয়। সড়কটি হবে এবং দ্রুতই কাজ শেষ হয়ে যাবে।’

এতক্ষণ যে সেতু ও সংযোগ সড়ক নিয়ে কথা হচ্ছে সেটি সিরাজগঞ্জ জেলার শাহাজাদপুরে। উপজেলার ইউজেডআর-ফরিদ পাঙ্গাসী ভায়া পুটিয়া রাস্তার ৫০০ মিটার চেইনেজে ৩৬ মিটার দীর্ঘ আরসিসি ব্রিজ নির্মাণ করছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশলী অধিদফতর। ‘বৃহত্তর পাবনা ও বগুড়া জেলার গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন (২য় সংশোধিত)’ প্রকল্পের আওতায় ব্রিজ নির্মাণের এই কাজ করা হচ্ছে। প্রকল্পটির গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত বাস্তব অগ্রগতি হয়েছে প্রায় ৯০ শতাংশ।

চুক্তি অনুযায়ী এই ব্রিজটির কাজ গত বছরের জুনে শেষ হওয়ার কথা ছিল। চুক্তি সম্পাদনের তারিখ ছিল ২০১৮ সালের জুলাইয়ে। এখন পর্যন্ত ব্রিজটি নির্মাণে আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে এক কোটি ৯০ লাখ ৮ হাজার ৮৯৯ টাকার। যা ব্রিজের মোট বরাদ্দের ৭৬ দশমিক ৩২ শতাংশ। ব্রিজটি নির্মাণের এই প্যাকেজে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ২ কোটি ৪৯ লাখ ৩ হাজার ৭৫৬ টাকা। 

উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি)-এর তথ্যানুযায়ী, গত ২০১৫ সালের অক্টোবরে ৪৬৮ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন পায়। প্রথমে প্রকল্পটি জুলাই ২০১৫ থেকে জুন ২০১৯ সালে বাস্তবায়নের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। এরপর প্রথম সংশোধনীর মাধ্যমে ৪০ কোটি টাকা ব্যয় বাড়িয়ে মেয়াদ ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। গত বছর ব্যয় না বাড়িয়ে আরও এক বছর মেয়াদ বাড়িয়ে প্রকল্পটি দ্বিতীয় সংশোধন করা হয়।

মাটি কাটা হচ্ছে ব্রিজের কম্বাইন্ড ফুটিং বেজের গোড়া থেকে

প্রকল্পের উদ্দেশ্য
গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ করে ও কৃষি উৎপাদন বাড়াতে সহায়তা দিতে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এ সেতু ও সড়ক কৃষিপণ্যের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করতে পরোক্ষ ভূমিকা রাখবে। পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পরিবেশের উন্নয়ন করা এবং গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করাও প্রকল্পটির উদ্দেশ্য।

প্রকল্পের ধীরগতি সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ কী বলেন?
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. এ. বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বাংলাদেশে কোনো প্রকল্পই সময় মতো শেষ হয় না। দুই-তিন বছর আগে বিশ্ব ব্যাংক আমাদের এডিপি বাস্তবায়নের ওপরে একটি প্রতিবেদন দিয়েছিল, সেখানে ৩০ থেকে ৩২টি প্রকল্প চিহ্নিত করেছিল, যেগুলো আগামী ১০০ বছর লাগবে শেষ করতে। প্রকল্প সঠিক সময়ে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। এক্ষেত্রে আইএমইডির পরিদর্শনের রিপোর্ট ভালোভাবে বিশ্লেষণ করে যারা দায়ী বলে চিহ্নিত হবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রকল্প বাস্তবায়নে শুধু দক্ষতা থাকলে হবে না, এখানে সমন্বয় থাকতে হবে। যারা প্রকল্প বাস্তবায়নে ফেল করে তাদেরকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। জবাবদিহিতার আওতায় না আনতে পারলে কাজ হবে না। মোট কথা জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।’  

প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন ঢাকা পোস্টের সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি শুভ কুমার ঘোষ। 

এসআর/এইচকে