২০০১ সালে রাজধানীর রমনার বটমূলে ছায়ানটের বৈশাখ বরণের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা চালিয়েছিল জঙ্গিরা। ওই হামলায় ১০ জন নিহত হয়েছিলেন। পরবর্তীতে তদন্তে বেরিয়ে আসে, অসাম্প্রদায়িক চেতনার মূলে আঘাত হানতেই হামলা চালিয়েছিল মৌলবাদী জঙ্গিগোষ্ঠী।

এবার চিরকুট পাঠিয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রায় হামলার হুমকি দেওয়া হয়েছে। তবে ঠিক হামলার হুমকি নয়, আতঙ্ক ছড়াতেই ওই চিরকুট পাঠানো হয়েছে বলে দাবি করেছেন র‌্যাব মহাপরিচালক ও ডিএমপি কমিশনার।

তবে উড়ো চিরকুটকে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে না। অধিক গুরুত্ব দিয়ে এটি তদন্ত করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। যেকোনো ধরনের নাশকতা এড়াতে ব্যাপক নিরাপত্তা প্রস্তুতির কথা জানানো হয়েছে বাহিনীগুলোর পক্ষ থেকে। খোঁজা হচ্ছে মঙ্গল শোভাযাত্রায় হামলার হুমকি দেওয়া চিরকুট প্রেরণকারীকে। খতিয়ে দেখা হচ্ছে সংশ্লিষ্ট এলাকার সিসিটিভি ফুটেজ।

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের আবতাহী রহমান (২৫) নামে এক শিক্ষার্থী পয়লা বৈশাখে মঙ্গল শোভাযাত্রায় হামলার হুমকি দিয়ে চিরকুট পাঠানো হয়েছে বলে অভিযোগ তুলে শাহবাগ থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন। জিডি নং ১৫২৭।

আরও পড়ুন>>বন্ধের মধ্যেও পয়লা বৈশাখ উদযাপন করতে হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে

জিডিতে উল্লেখ করা হয়েছে, অভিযোগকারী আবতাহী রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা অনুষদের মঙ্গল শোভাযাত্রা উপলক্ষ্যে গঠিত অর্থ ও নিরাপত্তা কমিটির সদস্য। মঙ্গলবার (১১ এপ্রিল) রাত পৌনে ১০টার দিকে চারুকলা অনুষদ পশ্চিম পার্শ্বের দেয়ালে রঙের কাজে তদারকির সময় একটি প্লাস্টিক চেয়ারের ওপর একটি সাদা কাগজে তিনি একটি পঞ্চাশ টাকার নোট পান। ওই কাগজে লেখা ছিল ‘শোভাযাত্রা কাজটা শিরক, এখানে এসে নিজেদের ক্ষতি করো না। যেকোনো সময় হামলা হতে পারে। ওইদিনের দাজ্জালি বাহিনী মোদের টের পাবে না’।

এদিকে মঙ্গল শোভাযাত্রায় হামলার হুমকির সঙ্গে জঙ্গি সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। তবে অতীত বিবেচনায় তদন্ত ও ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে বলে সিটিটিসির ইন্টেলিজেন্স এনালাইসিস বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মাহমুদুল হাসান।

তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন ‘হুমকিকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। নিরাপত্তা নিয়ে আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই। যদিও আমরা এখন পর্যন্ত মঙ্গল শোভাযাত্রায় হামলার হুমকি কেন্দ্রিক জঙ্গি সম্পৃক্ততা পাইনি।’

‘কে বা কারা চিরকুটটি পাঠাল তা গুরুত্বপূর্ণ। তা খুঁজে বের করা হবে। তবে আপাতত তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা। আমরা সেটি করছি। ইতোমধ্যে পুরো রমনা, শাহবাগ ও চারুকলা এলাকা সিসি ক্যামেরা মনিটরিংয়ের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। পাশাপাশি আমরা সন্দেহজনকদের আনাগোনা, সংশ্লিষ্ট দিনের চিরকুট প্রাপ্তির স্থানের সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করছি। চিরকুট প্রেরণকারীকে খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে।’

এর আগে বই মেলাতেও হামলার হুমকি দিয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছিল উল্লেখ করে এ সিটিটিসি কর্মকর্তা বলেন, ‘অমর একুশে বইমেলায় বোমা হামলার হুমকি দিয়ে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের পক্ষ থেকে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মো. নুরুল হুদাকে চিঠি দেওয়া হয়েছিল।’

আরও পড়ুন>>পয়লা বৈশাখে নিরাপত্তা হুমকি নেই : আইজিপি

‘গত ২৩ ফেব্রুয়ারি ডাকযোগে বাংলা একাডেমির অফিসে পাঠানো ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছিল, রাজধানীর দুটি হোটেলে অসামাজিক কার্যকলাপ চলে। এগুলো বন্ধ না হলে অমর একুশে বই মেলায় বোমা হামলা চালানো হবে। আমরা দীর্ঘদিন ওই জিডি তদন্ত করেছি। কিন্তু আনসার আল ইসলাম বা অন্য কোনো জঙ্গি সংশ্লিষ্ট কেউ ওই চিঠি পাঠায়নি মর্মে আমরা নিশ্চিত হয়েছি। তেমনি এটাও হতে পারে।’

নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে ও মঙ্গল শোভাযাত্রায় হামলার হুমকির চিরকুট সম্পর্কে জানতে চাইলে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) গোয়েন্দা শাখার প্রধান লে. কর্নেল মো. মশিউর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘বই মেলার সময় হুমকি সংক্রান্ত দুটি আলাদা জিডি হয়েছিল। তদন্তে আমরা জঙ্গি সম্পৃক্ততা পাইনি। এবার মঙ্গল শোভাযাত্রায় হামলার হুমকি দিয়ে চিরকুট এসেছে। বিষয়টি আমলে নিয়েছি। তদন্ত করা হচ্ছে। নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। হুমকিকে কম গুরুত্ব দেওয়ারও সুযোগ নেই। নিরাপত্তার চাদরেই পালিত হবে বৈশাখ বরণ।’

১৪৩০ বাংলা নববর্ষ উদযাপন উপলক্ষ্যে র‌্যাবের বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা সংক্রান্ত ব্রিফিংয়ে বৃহস্পতিবার (১৩ এপ্রিল) রাজধানীর রমনার বটমূলে র‌্যাব মহাপরিচালক এম খুরশীদ হোসেন বলেন, ‘পয়লা বৈশাখ উপলক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট জঙ্গি হামলার কোনো তথ্য নেই। মঙ্গল শোভাযাত্রা বন্ধে উড়ো চিঠিটি আসলে কোনো জঙ্গি সংগঠনের হুমকি নয়, বরং আতঙ্ক ছড়াতে তৃতীয় কোনো ব্যক্তি এটা করেছেন।’

র‌্যাব মহাপরিচালক বলেন, ‘চিরকুটটি আমি দেখেছি ও পড়েছি। মানুষের মনে আতঙ্ক তৈরি করার জন্য তৃতীয় কোনো পক্ষ এই কাজ করেছে। এটা আসলে কোনো জঙ্গির হুমকির ঘটনা নয়। তারপরও আমরা সতর্ক রয়েছি। এটা নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। এটা কোনো জঙ্গি সংগঠনের কাজ নয়।’

আরও পড়ুন>>নববর্ষের আনন্দ, নববর্ষের আয়োজন

তবে এবার নিরাপত্তা মহড়ায় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণের জানান দেওয়া হয়েছে। র‌্যাবের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সার্বিকভাবে অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা ও স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে র‌্যাব পয়লা বৈশাখে নিরাপত্তা জোরদার করেছে। নববর্ষের অনুষ্ঠান শেষ না হওয়া পর্যন্ত নিরাপত্তা জোরদারে র‌্যাবের সব ব্যাটালিয়ন নিজ নিজ দায়িত্বপূর্ণ এলাকায় পর্যাপ্ত সংখ্যক সদস্য মোতায়েন রাখবে।

টিএসসি, শাহবাগ, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও রমনা বটমূলসহ রাজধানীর যেসব স্থানে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, সেসব স্থানে নিরাপত্তা নিশ্চিতে র‌্যাব কর্তৃক পর্যাপ্ত পরীক্ষণ চেক পোস্ট, টহল ও অবজারভেশন পোস্ট স্থাপনসহ বিশেষ নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোকে র‌্যাবের বোম্ব ডিস্পোজাল ইউনিট ও ডগ স্কোয়াড দ্বারা সুইপিং সম্পন্ন করা হবে। এছাড়াও বিভিন্ন অনুষ্ঠানস্থল ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানে স্যুইপিং পরিচালনার পাশাপাশি র‌্যাবের বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট ও ডগ স্কোয়াড যেকোনো উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য সার্বক্ষণিকভাবে প্রস্তুত রয়েছে।

সার্বিক নিরাপত্তার জন্য থাকবে র‌্যাবের কন্ট্রোল রুম, স্ট্রাইকিং রিজার্ভ, পেট্রোল, মোটরসাইকেল পেট্রোল, ফুট পেট্রোল, বোট পেট্রোলিং, ভেহিক্যাল স্ক্যানার, চেকপোস্ট ও সিসিটিভি মনিটরিং। প্রস্তুত থাকবে রিজার্ভ ফোর্স। নাশকতা বা হামলা মোকাবিলায় র‌্যাব স্পেশাল ফোর্সের কমান্ডো টিম সার্বক্ষণিক প্রস্তুত থাকবে। পর্যাপ্ত সংখ্যক টহল মোতায়েন ও সাদা পোশাকে গোয়েন্দা নজরদারী থাকবে।

গোয়েন্দা তথ্য ও সাইবার মনিটরিংসহ অন্যান্য তথ্য বিশ্লেষণপূর্বক গুজব বা উস্কানিমূলক তথ্য ছড়িয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে না পারে সেজন্য র‌্যাব সাইবার মনিটরিং টিম অনলাইনে সার্বক্ষণিক নজরদারী অব্যাহত রাখছে।

অন্যদিকে বাংলা নববর্ষ বরণ উপলক্ষ্যে রমনার অনুষ্ঠান ঘিরে কোনো জঙ্গি হামলার আশঙ্কা নেই বলে জানিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক।

পয়লা বৈশাখের সার্বিক নিরাপত্তা নিয়ে আয়োজিত ব্রিফিংয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘জঙ্গি নয়, দুষ্টু ছেলেরা চিরকুট দিয়ে হুমকি দিয়েছে। তবে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় পুলিশ প্রস্তুত রয়েছে।’

আরও পড়ুন>>সবস্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পয়লা বৈশাখ উদযাপনের নির্দেশ

আদালত প্রাঙ্গণ থেকে দুই জঙ্গি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায় এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘দুই জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনায় জড়িত ১০ জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পলাতক জঙ্গিরা নজরদারীতে রয়েছে, তাদেরও গ্রেপ্তার করা হবে। পয়লা বৈশাখ উপলক্ষ্যে সরাসরি কোনো জঙ্গি থ্রেট বা হুমকি নেই।’

এবার বৈশাখ বরণ, মঙ্গল শোভাযাত্রা ও ছায়ানটে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান ঘিরে তিন স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে ডিএমপি। রমনার বটমূল ও আশপাশের এলাকায় ডিএমপির ডগ স্কোয়াড ও বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট দিয়ে সুইপিং করানো হচ্ছে। ডগ স্কোয়াড দিয়ে শনাক্ত করে সিটিটিসির আন্তর্জাতিক মানের রোবটিক সিস্টেমের মাধ্যমে জান-মালের ক্ষতি না করে বোমা নিষ্ক্রিয় করা ও অপরাধীকে কীভাবে গ্রেপ্তার করা হবে তার মহড়া সম্পন্ন হয়েছে।

পয়লা বৈশাখ উপলক্ষ্যে পোশাকধারী পুলিশের পাশাপাশি সাদা পোশাকেও দায়িত্ব পালন করবে ২ হাজার ৭০০ পুলিশ সদস্য। রমনার বটমূলে প্রবেশ ও বের হওয়ার জন্য নয়টি গেট থাকবে। তার মধ্যে চারটি গেট দিয়ে প্রবেশ করতে হবে। প্রতিটি গেটেই আর্চওয়ে থাকবে। ব্যাগ নিয়ে রমনায় প্রবেশ করা যাবে না। এছাড়া সকাল ৬টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত অবস্থান করা যাবে।

সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা ও বর্তমান প্রেক্ষাপটে মঙ্গল শোভাযাত্রায় হামলার হুমকি দিয়ে পাঠানো চিরকুটকে কম গুরুত্ব দেওয়ার সুযোগ নেই। যদিও জঙ্গিরা কখনো আগাম বার্তা দিয়ে হামলা করে না। সেই বিবেচনায় চিরকুট অন্য কোনো স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী পাঠাতে পারে। কারা করেছে সেটি খুঁজে বের করতে হবে। পাশাপাশি নিরাপত্তার কোনো ঘাটতি রাখা যাবে না। বৈশাখ বরণের অনুষ্ঠানে সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায় শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নয়। এই দায় সবার। যারা মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করবেন তাদের উচিত হবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ছাড়াও নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

জেইউ/কেএ