গত শুক্রবার দুদিনের সফরে ঢাকা আসেন মাহিন্দা রাজাপাকসে

বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার মধ্যকার ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ানো নিয়ে আলোচনা হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরেই। কিন্তু বাস্তব অগ্রগতি দৃশ্যমান হচ্ছিল না। সম্প্রতি শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসের ঢাকা সফর দুই দেশের আন্তঃবাণিজ্যে নতুন ক্ষেত্র উন্মোচনের আভাস দিচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রীর এ সফর ঢাকা-কলম্বোর ভৌগোলিক অবস্থান বিশেষ করে সামুদ্রিক যোগাযোগ ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নতুন আশার আলো দেখাচ্ছে। পাশাপাশি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে শ্রীলঙ্কার সমর্থন ও দেশটির সঙ্গে ঢাকার অভিজ্ঞতা বিনিময়ের বিষয়টিও বাংলাদেশকে সামনের দিনে এগিয়ে রাখবে।

কানেক্টিভিটি থিম ধারণ করে দক্ষিণ এশিয়ায় নিজেদের সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি অন্য বিদেশি দেশগুলোর সঙ্গে পণ্য আমদানি-রফতানির জন্য যেন তাকিয়ে থাকতে না হয়, সেই লক্ষ্যে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি, অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ), কোস্টাল শিপিং চুক্তিসহ আইসিটি ও কারিগরি খাতে অভিজ্ঞতা বিনিময় ও সহযোগিতা বাড়াতে মতৈক্যে পৌঁছেছে ঢাকা-কলম্বো।

জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা শেষে পরিদর্শন বইয়ে স্বাক্ষর করেন শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে

 

কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার বার্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ১৬ কোটি ডলার। এর মধ্যে বাংলাদেশ দেশটিতে পণ্য রফতানি করে ৪ কোটি ডলার, আর শ্রীলঙ্কা বাংলাদেশে রফতানি করে ১২ কোটি ডলার।

উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে দুই দিনের সফরে গত শুক্রবার (১৯ মার্চ) সকালে ঢাকায় আসেন শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর এটাই তার প্রথম বিদেশ সফর। সফরে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে ছয়টি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করেন রাজাপাকসে। এছাড়া বাণিজ্য, বিনিয়োগ, কৃষি, উপকূলীয় জাহাজ চলাচল, শিক্ষা ও তথ্যপ্রযুক্তি, দ্বৈত কর পরিহার ও  কাস্টমস সহযোগিতা ও ওষুধ খাতে উভয়ের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। মৎস্য, কৃষি; বিশেষ করে ধান উৎপাদন, জলবায়ু অভিযোজন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও আইটি সেক্টরে শ্রীলংকাকে স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণে সহযোগিতা দিতে আগ্রহ প্রকাশ করে ঢাকা। অন্যদিকে সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ ও নার্সিং সেক্টরে কলম্বোর সহযোগিতা চেয়েছে ঢাকা।

বিশ্লেষকরা বলছেন, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে শুধু বাণিজ্য বা বিনিয়োগের পরিমাণ বিবেচনা করলে হবে না। বিবেচনায় নিতে হবে কূটনৈতিক সম্পর্ক এবং নেতৃত্বের বিষয়টিও। অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব বাড়ানো নিয়ে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে দীর্ঘ দিন ধরে আলোচনা চলমান থাকলে সেটা গতি পাচ্ছিল না। তবে রাজাপাকসের ঢাকা সফরের মধ্য দিয়ে বিষয়টি গতি পাবে। 

এদিকে বাংলাদেশ সফরকালে প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বৈঠক করেন মাহিন্দা রাজাপাকসে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে ঢাকা ও কলম্বোর মধ্যে বিভিন্ন খাতে সহযোগিতার সম্পর্ক জোরদারে ছয়টি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হয়।

বৈঠকের বিষয়ে পরে সংবাদ সম্মেলন করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন। মোমেন বলেন, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বৃদ্ধির বিপুল সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে দুই নেতা গুরুত্বারোপ করেন। কলম্বোর সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি সম্পাদনে আগ্রহ দেখায় বাংলাদেশ। এর প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে একটি অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (পিটিএ) স্বাক্ষর প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যেতে দুই পক্ষ সম্মত হয়েছে। বাণিজ্য সম্প্রসারণের লক্ষ্যে শিপিং কানেক্টিভিটির প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করে বৈঠকে চট্টগ্রাম-কলম্বো ফিডার সার্ভিস পরিচালনা এবং উপকূলীয় জাহাজ চলাচল সংক্রান্ত চুক্তি সম্পাদনের বিষয়ে দুই দেশ একমত হয়েছে।

জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা শেষে সেখানে গাছের চারা রোপণ করেন শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে

চার বছর আগে শ্রীলঙ্কার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনার সফরে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ প্রসারে ঢাকা-কলম্বোর মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির (এফটিএ) করতে সম্মত হয়েছিল। কিন্তু দেশটির রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে সেটি আর আশার আলো দেখেনি।

এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন বলেন, আমরা বলেছি ফ্রিট্রেড এগ্রিমেন্টে রাজি। তবে এই মুহূর্তে যদি এফটিএ বাস্তবায়ন করতে সময় লাগে, তাহলে আমরা অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তিতে (পিটিএ) যেতেও রাজি আছি। তারা এটা গ্রহণ করেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে শুধু বাণিজ্য বা বিনিয়োগের পরিমাণ বিবেচনা করলে হবে না। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে কূটনীতি। কারণ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

তিনি বলেন,  শ্রীলঙ্কার সঙ্গে যে ধরনের সমঝোতা স্বাক্ষর হয়েছে এর মধ্য দিয়ে তাদের কাছ থেকে অনেক বেশি প্রশিক্ষণ নেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এটা আমাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে সাফল্যের জায়গায় তারা অনেক আগেই দক্ষতা অর্জন করেছে। সেটার অভিজ্ঞতা আমাদের জন্য খুব ভালো কাজে দেবে।

বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ কী ধরনের সুবিধা পেতে পারে- এমন প্রশ্নের জবাবে দেলোয়ার হোসেন বলেন, বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন থেকে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে আমাদের মুক্তবাণিজ্য চুক্তির আলাপ-আলোচনা হচ্ছে, সেটি বাস্তবায়ন হলে অনেক ভালো হবে। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাণিজ্য আরও শক্তিশালী হলে বাংলাদেশ নানা দিক থেকে লাভবান হবে। দেশটিতে আমাদের রফতানি বৃদ্ধি পাবে আবার সেখান থেকে সহজেই আমরা আমদানি করতে পারব।

সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অর্থনীতিবিদ মোস্তাফিজুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, রাজাপাকসের সফরের মধ্য দিয়ে চলমান যেসব চুক্তি আছে সেগুলো আরও একটু বেশি গতি ও গুরুত্ব পাবে। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে কমপ্রিহেনসিভ অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব নিয়ে অনেক দিন থেকে আলাপ-আলোচনা চলছে। কিন্তু এখনও সেটার পরিপূর্ণতা পায়নি। এই সফরে কেবল বাণিজ্য বা বিনিয়োগ নয়, প্রযুক্তি বিনিময় ও কোস্টাল শিপিংয়ে একসঙ্গে কাজ করতে রাজি রয়েছে দুই দেশ। সব মিলিয়ে এটা একটা ভালো উদ্যোগ হবে। এটাকে কেবলমাত্র শুল্ক সুবিধার মধ্যে না রেখে কীভাবে সার্ভিসেস সেক্টরে সহযোগিতায় আনা যাবে সেই চিন্তা করতে হবে।

এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ২০২৬-এর পর কিন্তু আমরা অনেক দেশে শূন্য শুল্ক সুবিধা পাব না। এক্ষেত্রে আমাদের বিনিয়োগ, যোগাযোগ ও বাণিজ্যের ওপর জোর দিতে হবে। রাজাপাকসের এই সফরে আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক কানেক্টিভিটিতে সুবিধা পাওয়া যাবে।

এনআই/এসকেডি/এমএমজে