ঈদ মানে আনন্দ, দীর্ঘসময় দেখা না দেখা আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু, পরিবারের সঙ্গে মিলনমেলা। ঈদযাত্রায় শত ভোগান্তি নিয়ে বাড়ি ফিরলেও কাছের মানুষগুলোর মুখ দেখলেই সে কষ্ট নিমিষে মিলিয়ে যায়। ঈদের সময়ে সবচেয়ে বেশি মানুষ গ্রামে ফেরেন সড়কপথে। তবে করোনাকাল ছাড়া এবারের ঈদযাত্রার মতো এতো কম যাত্রী কবে দেখেছেন তা মনে করতে পারছেন না পরিবহন সংশ্লিষ্টরা।

জানা যায়, এবার ঈদুল ফিতর উপলক্ষ্যে গত ৭ এপ্রিল থেকে বেসরকারি বাস কোম্পানিগুলো অগ্রিম টিকিট বিক্রি করে। এ সময় গত ১৬ এপ্রিল ও এর পরের তারিখের টিকিট বিক্রি করা হয় কাউন্টারগুলো থেকে।

তবে বুধবার (১৯ এপ্রিল) সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সরেজমিন রাজধানীর কল্যাণপুর, টেকনিক্যাল ও গাবতলী গিয়ে জানা যায়, ঈদযাত্রায় যাত্রী কম। শিডিউল মেনেই সময়মতো গন্তব্যের বাস ছেড়ে যাচ্ছে। বাড়তি চাপ নেই বাস কাউন্টারগুলোতে, নেই যাত্রীদের ভিড়। দূরপাল্লার গন্তব্যে ভোগান্তি কিংবা যানজটেরও খবর মেলেনি। 

অন্যদিকে গাবতলী আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল ও রজব আলী মার্কেটের বাস কাউন্টারগুলোতে দেখা যায়, কাউন্টারে টিকিটপ্রত্যাশীর চাপ নেই বললেই চলে। অলস সময় পার করছেন টিকিট বিক্রেতারা। ব্যাগসহ কোনো যাত্রী দেখলে শুরু হচ্ছে হাঁকডাক।

টিকিট বিক্রেতারা বলছেন, এমন দৃশ্য আগে কখনো দেখেননি তারা। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার যাত্রী অর্ধেকেরও কম। অনেক যাত্রী টিকিট মোবাইল ফোনে বুকিং দিলেও পরে যাত্রা বাতিল করছেন।

ঈদযাত্রায় এখন পর্যন্ত যাত্রী কম থাকার বিষয়ে পরিবহন কর্তৃপক্ষ, বাস কাউন্টার ও টিকিট বিক্রেতারা বেশ কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছেন।

সেগুলো হলো

১. এবারের ঈদযাত্রায় মহাসড়ক ও পদ্মা সেতুতে মোটরসাইকেল চলাচলে অনুমতি দেওয়ায় এর ব্যবহার বেড়েছে। ঈদ করতে গন্তব্যে ফিরতে অনেকে বাহন হিসেবে বেছে নিয়েছেন নিজের মোটরসাইকেল। অনেকে মোটরসাইকেলে সহকর্মীদের সঙ্গে শেয়ার করে গ্রামে ফিরছেন।

২. ঈদের ছুটি শেষ হতে না হতেই এসএসসি পরীক্ষা, তাই অনেকে পরিবার-সন্তানদের নিয়ে যাচ্ছেন না গ্রামের বাড়ি।

৩. দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলোর যাত্রীরা যাচ্ছেন পদ্মাসেতু হয়ে।

৪. প্রচণ্ড গরমে অনেকে দূরপাল্লার জার্নি করতে সাহস করেননি, তারা টিকিট বাতিল করছেন।

৫. প্রচণ্ড গরমের মধ্যে গ্রামে ঘনঘন বিদ্যুৎ বিভ্রাটের খবরেও বাতিল হচ্ছে ঈদযাত্রা। অনেক যাত্রীই বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে ঈদযাত্রার টিকিট বাতিল করলেও এটা বড় হিসেবে উঠে এসেছে।

৬. গার্মেন্টস ছুটি হয়নি, গার্মেন্টসসহ অনেক প্রতিষ্ঠানে এখনো হয়নি বেতন-বোনাস। যার প্রভাব পড়েছে ঈদযাত্রায়।

৭. বড় কারণ হিসেবে উঠে এসেছে নিম্ন-আয়ের মানুষের পকেটে টান।

৮. ভোগান্তির ভয়ে পরিবার-পরিজনকে আগেই বাড়িতে রেখে এসেছেন অনেকেই।

জানতে চাইলে উত্তরবঙ্গের জনপ্রিয় গণপরিবহন আল হামরার জেনারেল ম্যানেজার দেলোয়ার হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার বাসের অনেক যাত্রী মধ্যবিত্ত, নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষ। এবার পরিবহনের ভাড়া বাড়েনি। কিন্তু নিম্নআয়ের মানুষের পকেটে যেন টান পড়েছে। দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে এই গণপরিবহনের সঙ্গে আছি। কখনো এমন দৃশ্য দেখিনি। ঈদযাত্রা মানে কাউন্টারে ঠাসা মানুষ, টিকিটের জন্য হাহাকার, রিকোয়েস্ট, তদবির।

কিন্তু এবার উল্টো চিত্র। অনেকেই ফোন করে ঈদযাত্রা বাতিল করছেন। বুকিং টিকিট বাতিল করছেন। বিশেষ করে পরিচিত যারা প্রতিবছর টিকিট চান, যেভাবেই হোক গ্রামে ফেরেন, তাদের একটা বড় অংশ এবার ঈদে বাড়িই যাচ্ছে না।

ঝিনাইদহ, শৈলকুপা রুটে চলাচলকারী এসডি সুমন ডিলাক্স বাসে টিকিট বিক্রেতা বলেন, ১৫ বছর ধরে বাস লাইনে আছি। এমন ঈদ আগে দেখিনি, কাউন্টারে দেখেন যাত্রীই নাই। ৪২ সিটের বাসের অধিকাংশ সিটই খালি।

পূর্ব অভিজ্ঞতা কী বলে? এবারের ঈদযাত্রায় যাত্রী কমার কারণ কি হতে পারে? জানতে চাইলে দিগন্ত পরিবহনের টিকিট বিক্রেতা আ. আজিজ বলেন, 'দেখেন সাতক্ষীরার বাস এখন পদ্মা সেতু হয়ে যায়। আমার রুটটা প্রায় অচল। ঈদযাত্রায় আশা করছিলাম টিকিট বেচা-বিক্রি বাড়বে। কিন্তু না, যাত্রী তো ডাইকাও পাইতাছি না। মানুষ কম যাইতাছে বাড়ি। ঈদের পরই তো এএসসি পরীক্ষা; এরমধ্যে তীব্র গরম, বিদ্যুৎ সমস্যা কারণ হইবার পারে।' মোটরসাইকেলকে অনুমতি দেওয়াকে বড় কারণ হিসেবে দেখছেন তিনি।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, এবারের ঈদে ঢাকা থেকে ১ কোটি ২০ লাখের বেশি মানুষ দেশের বিভিন্ন জেলায় যাতায়াত করবে। এছাড়াও এক জেলা থেকে অপর জেলায় আরো প্রায় ৫ কোটি মানুষ ঈদে বাড়ি যাবে। ১৬ এপ্রিল থেকে ঈদযাত্রা শুরু হলেও প্রধানত ১৮ এপ্রিল বেতন-বোনাস পাওয়ার পর ১৯ এপ্রিল থেকে প্রতিদিন প্রায় ৪০ থেকে ৫০ লাখ হারে মানুষ রাজধানী ছাড়বে। কিন্তু আমাদের গণপরিবহনে সড়কপথে ৬ থেকে ১০ লাখ যাতায়াত করতে পারে।

মোজাম্মেল হক বলেন, ঈদযাত্রা মানে যাত্রী ভোগান্তি। মোটরসাইকেল কোনো গণপরিবহন নয়, তবে যাত্রী ভোগান্তি বিবেচনায় আমরা মোটরসাইকেল চলাচলে অনুমতি দেওয়ার অনুরোধ করেছিলাম। সরকার সেটি বাস্তবতার আলোকে করেছেও। যেটার প্রভাব পড়েছে সড়ক পথে।

তিনি বলেন, সড়কে বাস সংকট। ঈদযাত্রা সামাল দেওয়ার মতো বাস নেই। যেটার সুযোগ নিয়ে ভাড়া বাণিজ্য হতো। তবে এবার মোটরসাইকেলকে ঈদযাত্রার সুযোগ দেওয়ায় রাজধানীর ৫ থেকে ৬ লাখ বাইকার দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যাচ্ছে। এতে এই পরিবহনের মধ্যমে প্রায় ১০ থেকে ১২ লাখ যাত্রীর ঈদযাত্রা হচ্ছে।

জেইউ/জেডএস