চট্টগ্রাম-৮ (চান্দগাঁও-বোয়ালখালী) আসনের উপ নির্বাচনে একেবারেই নির্ভার আওয়ামী লীগ প্রার্থী নোমান আল মাহমুদ। কারণ এই উপ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না বিএনপি ও জাতীয় পার্টির মত কোনো প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল। এক প্রকার খালি মাঠে গোল দেওয়ার মতো করেই নির্বাচনী বৈতরণি পার করতে যাচ্ছেন নৌকার প্রার্থী। জয় নিশ্চিত জেনে ভোটার কাছে গিয়ে তেমন গণসংযোগ করেননি নোমান আল মাহমুদ। দলীয় মনোনয়ন পেয়েই নেতাকর্মীদের অভিনন্দনের পোস্টার-ব্যানারে ভাসছেন তিনি।

এই আসনে গত ২০২০ সালের ১৩ জানুয়ারির উপ-নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মতো বড় রাজনৈতিক দল অংশ গ্রহণ করার পরও মাত্র ২২ দশমিক ৯৪ শতাংশ ভোটার অংশ নেয়। ফলে এবার একপ্রকার একচেটিয়া নির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিতি নিয়েও তৈরি হয়েছে নেতিবাচক শঙ্কা। ৫ লাখ ১৭ হাজারের বেশি ভোটারের এই আসনে ভোটারদের কেন্দ্রে টানতে নোমান আল মাহমুদের পক্ষে কোনো প্রচারণায় দেখা যায়নি তেমন কৌশলী চমকও।

চট্টগ্রাম-৮ আসনের উপ নির্বাচনের ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে আগামী ২৭ এপ্রিল। ইতোমধ্যে মঙ্গলবার (২৫ এপ্রিল) দিবাগত রাত ১২টায় শেষ হয়েছে নির্বাচনী প্রচারণা। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, ন্যাশনাল পিপলস পার্টি- এনপিপি ও স্বতন্ত্র মিলিয়ে পাঁচ প্রার্থী অংশ নিয়েছে। তবে কোনো প্রার্থীর পক্ষ থেকে তেমন প্রচারণা চালাতে দেখা যায়নি। কোনো কোনো জায়গায় তাদের ব্যানার ও পোস্টার দেখা গেছে।

এদিকে, চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নোমান আল মাহমুদকে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা দেওয়ার পরপরই প্রভাবপ্রতিপত্তির রাজনীতিতে কিছুটা কোণঠাসা চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আজম নাছির উদ্দিনের শিবিরে দেখা দিয়েছে প্রাণচাঞ্চল্য। তারা নোমান আল মাহমুদকে গ্রুপিং রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবেই দেখছেন। অভিনন্দন জানিয়ে নোমান আল মাহমুদের সঙ্গে ছবি দিয়ে নগরের বিভিন্ন স্থানে ঝুলানো হয়েছে পোস্টার। এসব পোস্টারে আ জ ম নাছির উদ্দিনকেও দেখা গেছে।

এছাড়া বোয়ালখালী উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদেরও নোমান আল মাহমুদকে অভিনন্দন জানিয়ে পোস্টার, ব্যানার ঝুলাতে দেখা গেছে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে। 

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, উপ নির্বাচনে ভোটারদের তেমন আগ্রহ নেই। দলীয়ভাবে কিংবা প্রার্থীর উদ্যোগেও তেমন প্রচারণা দেখা যায়নি। অনেকটা জয় নিশ্চিত বিধায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নির্ভার, দলীয় প্রার্থীও নির্ভার। তবে যেটুকু না করলেই নয় সেটুকু প্রচারণা চালানো হয়েছে। শক্ত প্রতিপক্ষ না থাকায় মাঠে কোনো নির্বাচনী উত্তাপ নেই।

বোয়ালখালী উপজেলার বাসিন্দা আজহার উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, সাধারণত নির্বাচন এলে এলাকায় জমজমাট পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। তবে এবারের নির্বাচনে আমাদের মধ্যে কোনো ধরনের আমেজ নেই। প্রচার-প্রচারণাও দেখা যায়নি। অন্য সময়ে প্রার্থী এবং তাদের লোকজন ভোট দেওয়ার জন্য অনুনয়বিনয় করলে এবার কেউ আসেননি। কেউ এক কাপ চা-ও খাওয়াননি। তাই ভোট দিতেও যাব না।

জানা গেছে, মহাজোটের শরিক হিসেবে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) নেতা মইন উদ্দিন খান বাদল এই আসন থেকে ২০১৮ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৯ সালের ৭ নভেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এরপর পরে ২০২০ সালের ১৩ জানুয়ারির উপ-নির্বাচনে জয়ী হয়ে সংসদে এসেছিলেন দক্ষিণ জেলা আওয়ালী লীগের সভাপতি মোছলেম উদ্দিন আহমদ। এই নির্বাচনেও ৪ লাখ ৭৫ হাজার ৯৮৮ ভোটারের মধ্যে মাত্র ২২ দশমিক ৯৪ শতাংশ ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন। এবারে উপ নির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিতি কেমন হবে তা দেখতে অপেক্ষা করতে হবে ২৭ এপ্রিল ভোট গ্রহণ হওয়া পর্যন্ত। 

আওয়ামী লীগের নৌকার প্রার্থী নোমান ছাড়াও এ নির্বাচনে চেয়ার প্রতীকে ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশের সৈয়দ মুহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন, মোমবাতি প্রতীকে বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের সেহাব উদ্দিন মুহাম্মদ আব্দুস সামাদ, আম প্রতীকে ন্যাশনাল পিপলস পার্টি- এনপিপি’র কামাল পাশা এবং একতারা প্রতীকে স্বতন্ত্র প্রার্থী রমজান আলী ভোটের মাঠে রয়েছেন।

এর আগে মঙ্গলবার দুপুরে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে ‘পরিকল্পনা ও ভাবনা’ শীর্ষক ১৯ দফা পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন নৌকা প্রতীকের প্রার্থী নোমান আল মাহমুদ। নির্বাচিত হলে স্বল্প সময়ে তিনি কালুরঘাট সেতু বাস্তবায়নের চেষ্টা করবেন বলে আশ্বাস দেন। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ, বহদ্দারহাট বাস টার্মিনাল শাহ আমানত সেতুর কাছে স্থানান্তর, মসজিদ-মন্দির বা অন্য উপাসনালয় সংস্কার, নির্বাচনী এলাকার সবচেয়ে বড় সমস্যা মাদকদ্রব্যের বিস্তার ঠেকানো ও কিশোর গ্যাং নির্মূলের করার অঙ্গীকার করেন তিনি।

নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, এবারের নির্বাচনে পাঁচ লাখ ১৭ হাজার ৬৫২ জন ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পাবেন। এদের মধ্যে পুরুষ ভোটার দুই লাখ ৬৩ হাজার ৫৪৩ জন ও নারী ভোটার দুই লাখ ৫৪ হাজার ১০৯ জন।

২৬ এপ্রিল দিবাগত মধ্যরাত ১২টা থেকে ২৭ এপ্রিল দিবাগত মধ্যরাত ১২টা পর্যন্ত ওই এলাকায় ট্রাক, পিকআপ চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। এছাড়া ২৫ এপ্রিল দিবাগত মধ্যরাত ১২টা থেকে ২৮ এপ্রিল মধ্যরাত পর্যন্ত মোটরসাইকেল চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে।

তবে রিটার্নিং অফিসারের অনুমতি সাপেক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী বা তাদের নির্বাচনী এজেন্ট, দেশিবিদেশি পর্যবেক্ষকদের (পরিচয়পত্র থাকতে হবে) ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা শিথিলযোগ্য হবে। আবার নির্বাচনের সংবাদ সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত দেশিবিদেশি সাংবাদিক (পরিচয়পত্র থাকতে হবে), নির্বাচনের কাজে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, নির্বাচনের বৈধ পরিদর্শক এবং কিছু জরুরি কাজ যেমন– অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিস, বিদ্যুৎ, গ্যাস, ডাক ও টেলিযোগাযোগ ইত্যাদি কার্যক্রমে ব্যবহারের জন্য যানবাহন চলাচলের ক্ষেত্রে ওই নিষেধাজ্ঞা প্রযোজ্য হবে না।

চট্টগ্রাম আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা ও রিটার্নিং কর্মকর্তা মুহাম্মদ হাসানুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যাবতীয় প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। নির্বাচন ঘিরে এখনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। কোনো ধরনের অভিযোগও আসেনি। তার মানে শান্তিপূর্ণভাবে প্রচার-প্রচারণা শেষ হয়েছে। নির্বাচনের ভোটগ্রহণের পর্যাপ্ত পুলিশ, আনসার ও র‍্যাব মোতায়েন থাকবে। একই সঙ্গে জুডিশিয়াল এবং নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দায়িত্ব পালন করবেন। আশা করি শান্তিপূর্ণ উপায়ে নির্বাচন শেষ হবে।

চট্টগ্রাম নগর পুলিশ উত্তর জোনের উপ-কমিশনার (ডিসি) মোখলেছুর রহমান বলেন, নির্বাচন উপলক্ষে এলাকায় কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা হয়নি। আশা করি ভোটগ্রহণের সময়ও বিশৃঙ্খলা হবে না। ভোটের দিন কয়েক স্তরে পুলিশ মোতায়েন থাকবে।

গত ৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর একটি হাসপাতালে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সংসদ সদস্য মোছলেম উদ্দিন আহমদ মৃত্যুবরণ করেন। এরপর আসনটি শূন্য ঘোষণা করে সংসদ সচিবালয়। পরে আসনশূন্য ঘোষণার গেজেট ইসিতে এলে নির্বাচনের দিনক্ষণ ঠিক করে কমিশন।

এ আসনটি এর আগেও একবার শূন্য হয়েছে ২০১৯ সালে। মহাজোটের শরিক হিসেবে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) নেতা মইন উদ্দিন খান বাদল ২০১৮ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ২০১৯ সালের ৭ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। পরে ২০২০ সালের ১৩ জানুয়ারির উপ-নির্বাচনে জয়ী হয়ে সংসদে এসেছিলেন মোছলেম উদ্দিন আহমদ।

এমআর/এমজে