চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তথ্যগত ভুল দেখিয়ে জমা দেওয়া প্রতিবেদনে মামলার আট আসামির সবাইকে অব্যাহতি দিতে আবেদন জানান তদন্ত কর্মকর্তা। যদিও চূড়ান্ত প্রতিবেদনের তীব্র সমালোচনা করেছেন বিশিষ্টজনরা। পুলিশ প্রভাবিত হয়ে প্রতিবেদন তৈরি করেছেন জানিয়ে তারা পুনরায় স্বাধীন কোনো সংস্থা দ্বারা মামলাটি পুনরায় তদন্তের দাবি জানিয়েছেন তারা। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ১০ এপ্রিল অনেকটা গোপনে আলোচিত মামলাটির প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। যদিও প্রতিবেদনের বিষয়ে জানা যায় শুক্রবার (৫ মে)। 

এদিন রাতে জেলা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বিশেষ শাখা) আবু তৈয়ব মো. আরিফ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, মামলার তদন্তে কারও দায় পাওয়া যায়নি। এ কারণে চূড়ান্ত প্রতিবেদন (তথ্যগত ভুল) জমা দেওয়া হয়েছে। 

জানা গেছে, গত বছরের ৪ জুন রাতে সীতাকুণ্ডের কদমরসুল এলাকায় অবস্থিত বিএম ডিপোতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। আগুন লাগার ঘণ্টা খানেকের মধ্যে সেখানে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হয়। এরপর টানা ৮৬ ঘণ্টা আগুন জ্বলতে থাকে। একপর্যায়ে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে।

আরও পড়ুন : দিনের আলোয় ফুটে উঠছে আগুনের ক্ষত

ওই দুর্ঘটনায় আশপাশে থাকা ফায়ার সার্ভিসকর্মী ও শ্রমিকসহ ৫১ জন নিহত হন। এছাড়া আহত হন দুই শতাধিক মানুষ। পাশাপাশি ১৫৬টি আমদানি-রপ্তানি কনটেইনার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দুর্ঘটনার পরপরই বন্ধ করে দেওয়া হয় ডিপোর কার্যক্রম। এরপর আলাদাভাবে ঘটনাটি নিয়ে তদন্ত শুরু করে প্রশাসন, বন্দর কর্তৃপক্ষ, ফায়ার সার্ভিস ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। একই সঙ্গে সীতাকুণ্ড থানায় ডিপোর আট কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করে একটি মামলা দায়ের করা হয়।

পুলিশের পক্ষ থেকে বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন সীতাকুণ্ড থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আশরাফ সিদ্দিকী। ওই মামলায় ডিপোর জিএম (সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং) নাজমুল আকতার খান, ডিজিএম (অপারেশন) নুরুল আকতার, ম্যানেজার (অ্যাডমিন) খালেদুর রহমান, সহকারী অ্যাডমিন অফিসার আব্বাস উল্লাহ, সিনিয়র এক্সিকিউটিভ মো. নাসির উদ্দিন, সহকারী ব্যবস্থাপক (ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো) আবদুল আজিজ, কন্টেইনার ফ্রেইট স্টেশনের ইনচার্জ সাইফুল ইসলাম ও সহকারী ডিপো ইনচার্জ নজরুল ইসলামকে আসামি করা হয়।

মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, ডিপোটিতে অন্যান্য সাধারণ কনটেইনারের পাশাপাশি ড্রামভর্তি কেমিক্যাল ছিল। অগ্নিকাণ্ডের কিছুক্ষণের মধ্যেই কেমিক্যালের কারণে বিস্ফোরণ হয় এবং আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেওয়া হলেও তাদের কেমিক্যালের বিষয়টি জানানো হয়নি। এতে সাধারণ আগুন ভেবে পানি দিয়ে তা নেভানোর চেষ্টা করেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। যার কারণে আগুন নেভেনি এবং উল্টো বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। বিস্ফোরণে আশপাশের দুই-তিন কিলোমিটারের মধ্যে থাকা অনেক ভবনের কাচ টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ে। আগুন নেভাতে যথেষ্ট সময় লাগে, এমনকি প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতিও বাড়ে। এছাড়া ডিপোর দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও কর্তব্যরতদের দায়িত্বে অবহেলার কারণে দুর্ঘটনাটি সংঘটিত হয়।

কয়েকজন কর্মকর্তার হাতঘুরে সবশেষ মামলাটি তদন্ত করছেন চট্টগ্রাম জেলা ডিবির পরিদর্শক মোস্তাক আহমেদ চৌধুরী। তিনি আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেন।

এদিকে, পুলিশ চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিলেও দুর্ঘটনার মাত্র কয়েক দিনের মাথায় তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক) গঠিত তদন্ত কমিটি। জুন মাসের শেষ সপ্তাহে দাখিল করা ওই প্রতিবেদনে দায়িত্বে অবহেলার জন্য ডিপো কর্তৃপক্ষকে দায়ী করা হয়। চবকের টার্মিনাল ম্যানেজার কুদরত-ই-খুদার নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের কমিটি ২৪ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনটি তৈরি করেন। প্রতিবেদনে ডিপোতে ফায়ার হাইড্রেন্ট না থাকা, বিপজ্জনক ও রাসায়নিক দ্রব্য হ্যান্ডলিং ব্যবস্থাপনা দুর্বল এবং ডিপোর কর্মীরা যথাযথভাবে প্রশিক্ষিত ছিলেন না বলে উল্লেখ করা হয়।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)-এর চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিএম ডিপোর ঘটনায় বিভাগীয় কমিশনার, ফায়ার সার্ভিস ও বন্দর কর্তৃপক্ষ তদন্ত করেছেন। তারা ডিপো কর্তৃপক্ষকে দায়ী করেছেন। এখন পুলিশ বলছে কেউ দায়ী না। তার মানে হয় পুলিশ ভুল করেছে, না হয় বাকি তিন সংস্থা ভুল করেছে। এমনিতে যাদের অবহেলায় অগ্নিকাণ্ড হয়েছে তাদের কাউকে আসামি করা হয়নি। মামলার নামে এক ধরনের ‘আইওয়াশ’ করা হয়েছে। ডিপোতে কেমিক্যাল থাকায় তাতে হতাহতের ঘটনা অবধারিত ছিল। যারা কেমিক্যাল রেখেছেন অর্থাৎ ডিপোর নিয়ন্ত্রকদের কাউকে মামলার আসামি করা হয়নি। কারণ, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে তাদের হাত রয়েছে।

পুলিশের তদন্ত প্রভাবিত হয়ে করা হয়েছে বলে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, এখনও সময় আছে। মামলাটি পুনরায় স্বাধীন কোনো সংস্থা দ্বারা দরকার। এতো বড় দুর্ঘটনায় কারও দায় নেই? অথচ বিএম ডিপোর মালিক জেনেশুনে কেমিক্যাল রেখেছিলেন। এটি কি কেমিক্যাল রাখার জায়গা? 

অগ্নিকাণ্ডের পর বন্ধ হয়ে যাওয়া বিএম ডিপোর নানা সংস্কার করে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। সংস্কার কার্যক্রম শেষে গত বছরের ২২ আগস্ট ডিপোটিতে শুধুমাত্র খালি কনটেইনার সংরক্ষণের অনুমোদন দেওয়া হয়। ২৫ অক্টোবর নয়টি শর্তারোপ করে সেখানে রপ্তানি কার্যক্রম পরিচালনার অনুমোদন দেয় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। এর কয়েক দিনের মাথায় ১৩ ডিসেম্বর ডিপোতে ফের আগুনের ঘটনা ঘটে। তবে, সেবার কোনো হতাহত ছাড়াই দুই ঘণ্টার মধ্যে আগুন নেভাতে সক্ষম হয় ফায়ার সার্ভিস।

এমআর/এসকেডি