রাজধানীর উত্তরায় মাদ্রাসারাতুল হিকমা ইসলামিয়ার ছাত্র মুত্তাকী হক। সম্প্রতি বাসায় যাওয়ার জন্য মাদ্রাসা থেকে বের হওয়ার পর তার সঙ্গে এসে কথা বলা শুরু করেন এক ব্যক্তি। বলেন, ‘তোমার আব্বার নাম কি বাহার? তোমার বাবা আমার কাছে টাকা পায়। চলো তোমাকে কিছু কেনাকাটা করে দিই।’

কথা বলতে বলতে মুত্তাকীর মায়ের নাম্বার চান তিনি। মুত্তাকী জানায়, পরিচিত মনে করে আমি ওই লোককে আম্মুর মোবাইল নাম্বার দিই। এরপর তিনি ফোন করে আমাকে ধরিয়ে দেন। বলেন, তোমার আম্মুকে বলো কবির আঙ্কেল কথা বলবে। এরপর তিনি কথা বলে ফোন কেটে দেন। তিনি বলেন, তোমার আম্মুর সঙ্গে কথা হয়েছে। তোমাকে বাজার করে দিতে বলেছে।

এরপর শিশু মুত্তাকীকে টঙ্গী বাজারে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে একটি হোটেলে খাবার খাওয়ানোর জন্য বসিয়ে রেখে সটকে পড়েন ওই ব্যক্তি।

মুত্তাকী বলেন, অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও ওই লোকের সন্ধান না পেয়ে হোটেলের ম্যানেজারের মোবাইল ফোন থেকে মায়ের নাম্বারে কল করি।

এরপর মুত্তাকীর মা টঙ্গী এসে শিশু মুত্তাকীকে বাসায় নিয়ে যান। এর মাঝে দুই দফায় ওই ব্যক্তির বিকাশ নাম্বারে ১০ হাজার টাকা দেন তিনি।

শিশু মুত্তাকীর মা পুলিশকে জানিয়েছেন, অপরিচিত ওই ব্যক্তি তাকে বলেছেন মুত্তাকীকে অপহরণ করা হয়েছে, তাকে ফিরে পেতে হলে বিকাশে টাকা দিতে হবে। তিনি নিজের কাছে থাকা ৫ হাজার এবং আরেকজনের কাছ থেকে নিয়ে ৫ হাজার টাকাসহ ২ দফায় মোট ১০ হাজার টাকা বিকাশ করেন। তারপর মুত্তাকী কোথায় আছে সে ঠিকানা তাকে দেওয়া হয়।

সম্প্রতি অভিনব পন্থায় শিশু অপহরণকারী এমন একটি চক্রের সন্ধান পেয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উত্তরা বিভাগ।

অপহরণকারী চক্রের ৩ সদস্যকে গ্রেপ্তারও করেছে পুলিশ। গ্রেপ্তারকৃতরা হলো- চক্রের মূল হোতা মো. মিল্টন মাসুদ (৪৫), শাহীনুর রহমান (৩৮) ও সুফিয়া বেগম (৪৮)।

গতকাল শুক্রবার (৫ মে) গাজীপুরের সালনা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।

পুলিশ বলছে, এই অপহরণকারী চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের সামনে ঘোরাফেরা করে। তাদের টার্গেট আট থেকে ১৬ বছরের শিশু। যারা মোবাইল ফোন ব্যবহার করে না। তবে বাবা কিংবা মায়ের মোবাইল নাম্বার মুখস্থ। কিছু সময় শিশুদের সঙ্গে গল্প করতে করতে ওই শিশুর পরিবারের কাছে টাকা দাবি করা হয়। ৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত দাবি করা হয়। এভাবে গত ৫/৬ বছরে অন্তত আড়াই থেকে তিনশ’ শিশুকে অপহরণ করে কৌশলে মুক্তিপণ আদায়ের পর আবার ছেড়ে দেওয়া হয়।

চক্রটির অপহরণের শিকার হয়েছিল রাজউক উত্তরা মডেল স্কুলের ক্লাস এইটের শিক্ষার্থী মাহির আশরাফ। তার বাবা মহিউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ বিমানে কর্মরত।

ওই শিশু জানায়, গত ৩ মে স্কুল থেকে ফেরার সময় মিল্টন নামক ওই আঙ্কেলটা বলে তোমার নাম কী, বাবার নাম কী, মা কেমন আছে? নানা সাধারণ কথা বলে। এরপর বাবার নাম্বার নিয়ে আমাকে ধরিয়ে দেয়। আমাকে বলে, বলো কবির আঙ্কেল কথা বলবে। এরপর ফোনটা কেটে দেয়। এরপর আমি স্কুল থেকে কোচিং-এ চলে যাই। বাসায় ফিরে শুনি আমাকে নাকি অপহরণ করা হয়েছিল। বাবা ভয় পেয়ে তাক ২৫ হাজার টাকা বিকাশ করে দিয়েছে।

অপহরণকারী চক্রের কৌশল সম্পর্কে আরেক শিশু মুত্তাকীর বাবা বাহার উদ্দিন বলেন, গত ২৪ রমজান আমি ইতিকাফে বসা ছিলাম। মাদ্রাসা থেকে ফোন আসে, ঈদের ছুটি শুরু হয়েছে বাচ্চাকে কি বাসায় পাঠায় দেবো? আমি পাঠাতে বলি। কিন্তু আধা ঘণ্টা পার হলেও মুত্তাকী বাসায় পৌঁছেনি। বাসার দারোয়ান ফোন করে জানায় মুত্তাকী এখনো আসেনি। এর কিছুক্ষণ পরই ফোন করে মুত্তাকীকে অপহরণের কথা জানায়। আর টাকা পাঠাতে বলে। এরপর দিশেহারা হয়ে যায় মুত্তাকীর মা। টাকা পাওয়ার পর টঙ্গি বাজারে একটি হোটেলের ঠিকানা দিয়ে অপহরণকারী বলে- সেখানে আছে মুত্তাকী।

বাহার বলেন, মূলত মুত্তাকীকে হোটেলে বসিয়ে রেখে আমার স্ত্রীর সঙ্গে মুক্তিপণের টাকার দর কষাকষি করেছে তারা। দুই দফায় ১০ হাজার টাকা নিয়ে সটকে পড়েছে। খবর পেয়ে আমি মসজিদ থেকে বেরিয়ে থানায় অভিযোগ করি।

এ বিষয়ে উত্তরা বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ মোর্শেদ আলম বলেন, গত ২৪ মার্চ উত্তরা ৪ নং সেক্টরের হলি ল্যাবের সামনে থেকে ৬ বছরের শিশু শাহিন শেখ হারিয়ে যায়। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও ছেলের সন্ধান না পেয়ে উত্তরা পূর্ব থানায় একটি জিডি করে পরিবার। ওই জিডির তদন্তের সূত্র ধরেই এই অপহরণকারী চক্রের সন্ধান পাওয়া যায়। এরপর বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব সহকারে দেখার নির্দেশনা দেয়া হয়।

পরবর্তীতে উত্তরার বিমানবন্দর জোনের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) মো. তৌহিদুল ইসলামের নেতৃত্বে উত্তরা পূর্ব থানার একটি টিম তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় আসামিদের শনাক্ত করে এবং অভিযান পরিচালনা করে গ্রেপ্তার করে।

মোর্শেদ আলম বলেন, সাধারণত অপহরণকারীরা অপহরণের পর নির্যাতন করে টাকা আদায় করে। কিন্তু এই চক্রটি অপহৃতদের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করে। শুধু তাই নয়, ভুক্তভোগী পরিবারের সামর্থ্যের উপর ভিত্তি করে মুক্তিপণ দাবি করা হয়। এমনও হয়েছে ৫০০ টাকা নিয়েও অপহৃত শিশুকে ছেড়ে দিয়েছে তারা। আবার কখনো টাকা না নিয়েও একদিন পর ছেড়ে দিয়েছে।

মোর্শেদ বলেন, অপহরণকারীরা কোনো ধরনের নির্যাতনমূলক বা হুমকি-ধামকি না দেওয়ার কারণে থানায় অভিযোগ করতেন না অনেকে। চক্রটি অল্প সময়ের জন্য অপহরণের কৌশল ব্যবহার করত। খুব কমই কাউকে আটকে রাখত তারা।

উদাহরণ দিয়ে ডিসি মোর্শেদ বলেন, কিছুদিন আগে উত্তরায় একটি হাসপাতালে বাবা ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে বলতে একটি শিশু হারিয়ে যায়। পরিবারের অভিযোগের প্রেক্ষিতে পুলিশ সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে জানতে পারে- চক্রের এক সদস্য ওই শিশু ছেলেটিকে কথা বলতে বলতে সামনে নিয়ে যায়। এরপর একটি বাসে উঠে রাজলক্ষ্মী থেকে চলে যায়। এরপর আমরা তার খোঁজ পাইনি। পরদিন একই হাসপাতালে নামিয়ে দিয়ে যায় অপহরণকারীরা। ওই শিশু জানিয়েছিল, খেয়েছে আর ঘুমিয়েছে। কোনো নির্যাতন করা হয়নি।

চক্রের মূল হোতা মিল্টন মাসুদ (৪৫) সম্পর্কে পুলিশ জানায়, মিল্টন মাসুদের বিরুদ্ধে পাঁচটি অপহরণ মামলা রয়েছে। এর মধ্যে গাজীপুরে তিনটি, ডিএমপি’তে দুটি। তিনি মাদকসেবী। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি একাধিক বিবাহিত। তার পেশাই হলো এটি, কৌশলে শিশুদের অপহরণ করা।

তার সহযোগী শাহীনুর রহমান (৩৮) নিজেকে সাংবাদিক পরিচয় দিলেও তিনিও গত ৬/৭ বছর ধরে এই অপহরণ চক্রে জড়িত। তিনি অপহরণের মুক্তিপণ বিকাশে সংগ্রহ করে দিতেন।

চক্রটি কত বছর ধরে অপহরণে জড়িত ও কতজন শিশুকে অপহরণ করেছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিগত ৬/৭ বছর যাবৎ ৫০০ থেকে ৬০০ শিশুকে অপহরণ ও অন্তত তিন'শ পরিবারে কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি।

অভিভাবকদের সচেতন হওয়ার অনুরোধ জানিয়ে উত্তরার ডিসি মোর্শেদ বলেন, আপনারা বাচ্চাদের অপহরণ সংক্রান্ত বিষয়ে সতর্ক করবেন। স্কুল ও কোচিং সেন্টারে যাওয়া আসার সময় অপরিচিত কারো সঙ্গে কথা না বলা, মোবাইল নাম্বার না দেওয়া ও কিছু খেতে দিলে না খাওয়ার জন্য সতর্ক করার অনুরোধ জানান তিনি।

জেইউ/এমজে