রাজস্ব বাড়ানোর উদ্দেশ্যে ১৯৯৬ সালের নভেম্বরে ঢাকা ওয়াসা ও ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের মধ্যে চুক্তি সই হয়। চুক্তি অনুযায়ী পিপিআই (প্রোগ্রাম ফর পারফরমেন্স ইমপ্রুভমেন্ট) কার্যক্রমের আওতায় ঢাকা ওয়াসার বিলিং ও মিটার কার্যক্রম শুরু হয়।

চুক্তি অনুযায়ী সমিতির অনুকূলে কর্মচারীরা বিলিং বাবদ ৬ থেকে ১০ শতাংশ কমিশন পান। কমিশনের ওই টাকা জমা হতো সমিতির নিজস্ব ব্যাংক অ্যাকাউন্টে। অনেক আগেই সেই টাকা নয়ছয়ের অভিযোগ উঠে। এবার দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে প্রায় ২৬০ কোটি টাকা লুটপাটের তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে।

যে কারণে দুদকের প্রধান কার্যালয়ে কমিশন থেকে মামলার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। শিগগিরই মামলা দায়ের করা হবে বলে সংস্থাটির উপ-পরিচালক (জনসংযোগ) মুহাম্মদ আরিফ সাদেক ঢাকা পোস্টকে নিশ্চিত করেছেন।

আর অনুমোদিত মামলায় যাদের আসামি করা হচ্ছে তারা হলেন– ঢাকা ওয়াসার সাবেক রাজস্ব পরিদর্শক ও পিপিআই প্রকল্প পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান মিঞা মো. মিজানুর রহমান, ওয়াসার সাবেক রাজস্ব পরিদর্শক ও পিপিআই পরিচালনা পর্ষদের মো. হাবিব উল্লাহ ভূইয়া এবং ঢাকা ওয়াসার রাজস্ব জোন-৬ এর কম্পিউটার অপারেটর মো. নাঈমুল হাসান।

মামলা অনুমোদন হলেও আসামি তালিকা নিয়ে এরই মধ্যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। কারণ হিসেবে ওয়াসা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সমবায় অফিসের নিরীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী অন্তর্বর্তীকালীন পিপিআই পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান মো. আক্তারুজ্জামান ও কো-চেয়ারম্যান মিঞা মো. মিজানুর রহমান। তাদের যৌথ স্বাক্ষরে সমিতির/পিপিআই প্রকল্পের ব্যাংক হিসাব পরিচালিত হয়েছে। কিন্তু দুদকের অনুমোদিত মামলায় কো-চেয়ারম্যান মিজানুর রহমানকে আসামি করা হলেও অজ্ঞাত কারণে মো. আক্তারুজ্জামানকে আসামি করা হয়নি। বিষয়টি যৌক্তিক নয় বলে দাবি করেছেন ওয়াসার কর্মচারী বহুমুখী সমিতির এক নেতা।

আরও পড়ুন : এবার মেজর মান্নানের স্ত্রী ও দুই মেয়ের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা

যদিও এ বিষয়ে দুদকের সংশ্লিষ্ট অনুসন্ধান কর্মকর্তাদের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। অনুসন্ধানের দায়িত্বে আছেন দুদক উপ-পরিচালক এস এম এম আখতার হামিদ ভূঞা ও সহকারী পরিচালক মো. আশিকুর রহমান।

জানতে চাইলে দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, অনুসন্ধান ও তদন্ত শেষে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা যাবে।

ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতির ১৩২ কোটি চার লাখ ১৭ হাজার ৪৬০ টাকা ছয়টি ব্যাংক হিসাব থেকে বিভিন্ন চেকের মাধ্যমে ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খানের প্রত্যক্ষ মদদ ও নির্দেশে তুলে আত্মসাৎ করা হয়েছে— এমন অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধানে নামে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা দুদক। যদিও অনুসন্ধানে আত্মসাৎ করা টাকার পরিমাণ বেড়েছে।

জেলা সমবায় অফিসের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে যা ছিল

তেজগাঁও মেট্রোপলিটন থানা সমবায় কর্মকর্তা মো. রেজাউল বারী ও ঢাকা জেলা সমবায় কার্যালয়ের কর্মকর্তা মঞ্জুরুল কবীরের নেতৃত্বাধীন নিরীক্ষা দল প্রতিবেদন তৈরি করে জমা দেন ২০২১ সালের ৩০ জুন। প্রতিবেদনে সমিতির হিসাব নয়ছয় করাসহ ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে সরকারি সম্পত্তির অবৈধ ভোগ-দখলের অভিযোগ আনা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ওয়াসার সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী প্রথম পর্যায়ে বিলিং বাবদ বাস্তবায়নকারী সংস্থার অনুকূলে প্রদত্ত কমিশনের হার ছিল ৬ শতাংশ, যা পরে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়। এ কার্যক্রমে নিয়োজিত ওয়াসার কর্মচারীরা বেতন-ভাতার পাশাপাশি তাদের পারফরমেন্সের ভিত্তিতে অতিরিক্ত ভাতা পান। প্রথম পর্যায়ে পিপিআই প্রকল্পের আওতায় সমবায় সমিতির নামে একটি জোন বরাদ্দ নেওয়া হয়। পর্যায়ক্রমে আরও কয়েকটি জোন বরাদ্দ দেওয়া হয়। এসব কার্যক্রমের জন্য ঢাকা ওয়াসা থেকে একজন পিডি (প্রকল্প পরিচালক) ও দুজন কো-পিডি, অন্যদিকে সমবায় সমিতির মাধ্যমে শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ থেকে একজন চেয়ারম্যান, তিন জন কো-চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নিয়োগ দেওয়া হয়।

২০১৭-১৮, ২০১৮-১৯ ও ২০১৯-২০ অর্থবছরে ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের ব্যাংক হিসাবে দফায় দফায় ১৭৮ কোটি ৫৪ লাখ দুই হাজার ছয় টাকা কমিশন হিসেবে জমা হয়। এর মধ্যে ২০১৭ সালের ১৬ জুলাই থেকে ২০১৮ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সমিতির নামে মোট ৯৯ কোটি ৬৫ লাখ ১৯ হাজার ১৭৩ টাকা এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৩৪ কোটি ১৮ লাখ ৫৭ হাজার ৭৯০ টাকা কমিশন বাবদ ব্যাংক হিসাবে জমা হওয়ার কথা। কিন্তু ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ওয়াসা থেকে ৯৯ কোটি ৬৫ লাখ ১৯ হাজার ১৭৩ টাকা কমিশন পেলেও সমিতির নিরীক্ষা প্রতিবেদনের হিসাব বিবরণীতে মাত্র এক কোটি ৭৯ লাখ ৫৯ হাজার ৫০৩ টাকা দেখানো হয়। অর্থাৎ নিরীক্ষা দল ৯৭ কোটি ৮৫ লাখ ৫৯ হাজার ৬৭০ টাকা এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ঢাকা ওয়াসা থেকে প্রাপ্ত ৩৪ কোটি ১৮ লাখ ৫৭ হাজার ৭৯০ টাকার হদিস পাননি। এ অর্থ কোথায় এবং কীভাবে ব্যয় হয়েছে তার কোনো ব্যাখ্যা ব্যবস্থাপনা কমিটির কাছ থেকে পাওয়া যায়নি।

আরও পড়ুন : বাফুফের ঊর্ধ্বতনদের দুর্নীতির তদন্ত চেয়ে দুদকে ব্যারিস্টার সুমন

প্রতিবেদনে বলা হয়, সমিতির সভাপতি ও পিপিআই প্রকল্প পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে মো. হাফিজ উদ্দিন ও প্রকল্প পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান মিঞা মো. মিজানুর রহমানের যৌথ স্বাক্ষরে পিপিআই প্রকল্পের সব ব্যাংক হিসাব পরিচালিত হতো। কিন্তু পিপিআই পরিচালনা কমিটির তৎকালীন চেয়ারম্যান হাফিজ উদ্দিন অসুস্থ থাকায় সমিতির ব্যবস্থাপনা কমিটির ২০১৮ সালের ৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত সভায় সর্বসম্মতিতে সমিতির সদস্য ও ঢাকা ওয়াসার অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আক্তারুজ্জামানকে অন্তর্বর্তীকালীন পিপিআই পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তাদের যৌথ স্বাক্ষরেই পিপিআই প্রকল্পের ব্যাংক হিসাব পরিচালিত হয়। এ বিষয়ে আক্তারুজ্জামানের সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু নিরীক্ষা দলকে কোনো তথ্য দেননি তিনি।

নিরীক্ষার সময় সমিতির নামে থাকা ছয়টি ব্যাংক হিসাবের লেনদেন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৬ সালের ১০ মার্চ নির্বাচিত ব্যবস্থাপনা কমিটি ও ২০২০ সালের ২৬ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনের আগে দায়িত্বপালনকারী সমিতির ব্যবস্থাপনা কমিটি ব্যাংক লেনদেন করেছে। ওই ব্যাংক হিসাব থেকে ৪৪ কোটি ২১ লাখ ৬৫ হাজার ৪৩ টাকা তোলা হলেও ওই টাকার হিসাব নিরীক্ষার সময় পাওয়া যায়নি। নিরীক্ষা দলের কাছে ওই ব্যবস্থাপনা কমিটি সমুদয় অর্থ আত্মসাৎ করেছে বলে প্রমাণিত হয়েছে।

নিরীক্ষা প্রতিবেদনে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী তাকসিম এ খানের বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ আনা না হলেও সমিতির অধিকাংশ সদস্যদের মতে এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির পেছনের কারিগর ‘এমডি’ সিন্ডিকেট। যে কারণে ২০২২ সালের ২৩ জুন ১৩২ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ঢাকা ওয়াসার এমডি প্রকৌশলী তাকসিমসহ নয় জনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলার আবেদন করে ঢাকা ওয়াসা কর্মচারী বহুমুখী সমবায় সমিতির সম্পাদক মো. শাহাব উদ্দিন সরকার। কিন্তু বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ না করে মামলার আবেদনটি ফেরত দেন আদালত। একই সঙ্গে দুদকের এখতিয়ারভুক্ত হওয়ায় সেখানে দাখিল করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। যার ভিত্তিতে দুদক অনুসন্ধান করছে।

আরএম/এসএসএইচ/