বাংলাদেশে প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় অনেক মানুষ আহত-নিহত হয়। এসবের অল্পকিছু গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। অর্থাৎ অসংখ্য দুর্ঘটনা প্রতিদিন অপ্রকাশিত থাকে। শুধু ভুক্তভোগী পরিবার-পরিজন এবং স্থানীয় মানুষ ছাড়া অন্যরা জানতে পারেন না এসব দুর্ঘটনার তথ্য।

সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য প্রকাশ নিয়ে দেশে বিতর্ক চলছে। বিতর্কের মূল কারণ সরকারি এবং বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার প্রতিবেদনে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যাগত পার্থক্য। বাস্তবতা হলো, সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কারও কাছেই সড়ক দুর্ঘটনার বস্তুনিষ্ঠ তথ্য নেই। কিন্তু থাকা জরুরি। এজন্য সরকারি উদ্যোগে বা সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে সড়ক দুর্ঘটনার একটি তথ্যব্যাংক তৈরি করা প্রয়োজন।

সোমবার (২৯ মে) দুপুরে সংবাদ মাধ্যমে পাঠানো রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমানের একটি নিবন্ধে তিনি এ প্রয়োজনীয়তার কথা জানান।

প্রবন্ধে সাইদুর রহমান বলেন, ‘সারা দেশে ২২ হাজার ৪৭৬ কিলোমিটার আঞ্চলিক সড়ক ও জাতীয় মহাসড়ক এবং ২ লাখ ১৭ হাজার কিলোমিটার গ্রামীণ সড়ক রয়েছে। এসব সড়কে চলাচল করে ৫৬ লাখ নিবন্ধিত মোটরযান (বর্তমান সময় পর্যন্ত)। এর বাইরে লাখ লাখ অটোরিকশা-অটোভ্যান ও নসিমন-করিমন-ভটভটিসহ নানা রকমের অনিরাপদ যানবাহন ঝুঁকিপূর্ণভাবে চলাচল করে এই সড়ক-মহাসড়কে। এসব যানবাহনের চালকরা যেমন অপ্রশিক্ষিত, যাত্রী ও পথচারীরাও তেমনি নিরাপদে চলাচল বিষয়ে অনভ্যস্ত ও অনভিজ্ঞ। দেশের মোটরসাইকেল চালকদের একটি বড় অংশ কিশোর ও যুবক। এরা বেপরোয়াভাবে মোটরসাইকেল চালিয়ে প্রতিনিয়ত নিজেরা দুর্ঘটনায় পতিত হচ্ছে এবং অন্যদের আক্রান্ত করছে।’

‘২০২১ সালে পুলিশের রিপোর্ট অনুযায়ী সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৫৪৭২টি। আহত ৪৭১৩ জন এবং নিহত হয়েছে ৫০৮৪ জন। এই রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, দুর্ঘটনার সংখ্যার চেয়ে আহত এবং নিহতের সংখ্যা কম। যেটা অস্বাভাবিক। কারণ পুলিশ যে ধরনের দুর্ঘটনা তালিকাভুক্ত করে সেসব দুর্ঘটনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনেক বেশি আহতের ঘটনা ঘটে। তাই পুলিশের সড়ক দুর্ঘটনার রিপোর্টে দুর্ঘটনার সংখ্যার চেয়ে নিহত বা আহতের সংখ্যা কম হওয়ার কথা নয়। উল্লেখ্য, ঐ একই বছরে গণমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি করা রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে দেখা যায়, সারা দেশে ৫৩৭১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬২৮৪ জন নিহত এবং ৭৪৬৮ জন আহত হয়েছে। এখানে পুলিশের তথ্যের সঙ্গে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যের বিরাট পার্থক্য দৃশ্যমান। অন্যান্য সংগঠনের তথ্যের সঙ্গে পার্থক্য আরও বেশি। তবে এক্ষেত্রে আমরা কোনো রিপোর্টকেই বস্তুনিষ্ঠ বলছি না।’

‘সড়ক দুর্ঘটনার বিষয়ে বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনে একটির সঙ্গে অপরটির সংখ্যাগত বিস্তর পার্থক্য হচ্ছে। বেসরকারি সংস্থাগুলোর চেয়ে পুলিশের প্রতিবেদনে দুর্ঘটনা ও আহত-নিহতের সংখ্যা অনেক কম থাকছে। সড়ক দুর্ঘটনার এই সংখ্যাগত পার্থক্যের বিতর্ক অবসানে বিআরটিএ গত জানুয়ারি মাস থেকে সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিবেদন প্রকাশ শুরু করেছে। কিন্তু বিআরটিএ’র প্রতিবেদনের সঙ্গে পুলিশের প্রতিবেদন মিলছে না। অথচ দুটিই সরকারি প্রতিষ্ঠান। ফলে বড় ধরনের বিতর্ক তৈরি হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘পুলিশ, বিআরটিএ এবং বেসরকারি সংস্থাগুলো যে পদ্ধতি ও প্রক্রিয়ায় সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য সংগ্রহ করে, তাতে সড়ক দুর্ঘটনার সঠিক চিত্র বা খুব কাছাকাছি চিত্র তুলে আনা সম্ভব নয়। আসলে প্রকৃত চিত্র অনেক বেশি ভয়াবহ। সড়ক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ হেনরিখের মতে, সড়কে যাতায়াতের সময় ৩ হাজার অনিরাপদ কাজ বা আচরণের ফলে ৩০০টি দুর্ঘটনা ঘটতে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটে। এই ৩০০ ঘটনা ২৯টি আহত হওয়ার ঘটনা বা সম্পদ নষ্ট হওয়ার মতো ঘটনা ঘটায়। আবার এই ২৯টি ঘটনা ১টি মারাত্মক আহত হওয়া বা নিহতের ঘটনা ঘটাতে ভূমিকা রাখে। অর্থাৎ একটি নিহতের ঘটনার পেছনে ৩ হাজার অনিরাপদ আচরণ, ৩০০ দুর্ঘটনা ঘটতে যাওয়ার মতো ঘটনা এবং ২৯টি আহত হওয়ার ঘটনা থাকে। তাই দুর্ঘটনা পরিমাপের এই বিশ্বমানের পদ্ধতি অনুযায়ী বলা যেতে পারে, দেশে সড়ক দুর্ঘটনা প্রকাশিত সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি ঘটে।’

‘এই উদ্বেগজনক প্রেক্ষাপটে প্রশিক্ষিত জনবল ও আধুনিক যোগাযোগ প্রযুক্তির মাধ্যমে মাঠপর্যায় থেকে এবং হাসপাতাল থেকে সরাসরি তথ্য সংগ্রহ করে সড়ক দুর্ঘটনার তথ্যব্যাংক তৈরি করতে হবে। এজন্য বড় ধরনের লজিস্টিক সাপোর্টের প্রয়োজন, যা বেসরকারি সংস্থার পক্ষে এখনই সম্ভব নয়। তবে সরকারের পক্ষে সম্ভব এবং করা উচিত।’

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘এই বাস্তবতায় সরকারের উচিত, সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যাগত পার্থক্য নিয়ে বিতর্কে না জড়িয়ে সমস্যাকে স্বীকার করে সরকারি উদ্যোগে বা সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে আধুনিক যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সড়ক দুর্ঘটনার একটি বস্তুনিষ্ঠ তথ্যব্যাংক তৈরি করা। কারণ সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে টেকসই ও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হলে সঠিক তথ্য থাকতে হবে। এটা রাষ্ট্রীয় নীতি-কৌশল ও নৈতিকতার বিষয় এবং সময়ের দাবি। মনে রাখতে হবে, সমস্যাকে অস্বীকার করে সমাধান করা যায় না, বরং সমস্যাকে স্বীকার করে দায়ভার কাঁধে নিয়ে সমাধানের পথ বের করাই বুদ্ধিমানের কাজ।’

এমএইচএন/কেএ