মাদকের ভয়াল গ্রাস থেকে দেশের তরুণ প্রজন্মকে রক্ষা করা দিনদিন কঠিন হয়ে উঠছে। নানাভাবে নানা উপায়ে ভয়ংকর সব মাদক দেশে প্রবেশ করছে। এসব মাদকের নেশায় আসক্ত হয়ে দেশের তরুণ প্রজন্ম বিপথগামী হয়ে উঠছে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রের অপতৎপরতায় দেশে মাদকের সরবরাহ বাড়ছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) তথ্য বলছে, চলতি বছরে শুধু মার্চ মাসেই তারা প্রায় তিন লাখ ৭০ হাজার পিস ইয়াবা ট্যাবলেট জব্দ করেছে। এছাড়া ২০২২ সালের ড্রাগ রিপোর্ট অনুযায়ী, গেল পাঁচ বছরে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে জব্দ হয়েছে প্রায় ২১ কোটি ৬৬ লাখ ইয়াবা ট্যাবলেট।

এদিকে যেমন মাদক সেবনকারীদের সংখ্যা বাড়ছে, তেমনি সহজে অর্থলাভের আশায় মাদক পাচারে জড়িয়ে পড়ছেন অনেকে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা যায়, দেশে মাদক প্রবেশের অন্যতম রুট হচ্ছে মিয়ানমার থেকে টেকনাফ ও কক্সবাজার সড়ক। এ সড়ক দিয়ে দেশের অধিকাংশ মাদকের চালান আসে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হারে আসে ইয়াবা ও আইস। এসব মাদক টেকনাফ কিংবা কক্সবাজার থেকে বিভিন্ন উপায়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় পৌঁছে দিচ্ছেন দেশীয় মাদককারবারিরা। তবে, সম্প্রতি মাদক পাচারের পুরাতন একটি পদ্ধতি নতুন করে চিন্তার ভাঁজ ফেলে দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীদের কপালে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, কক্সবাজার কিংবা টেকনাফ থেকে সড়কে পথে ইয়াবার চালান ঢাকায় আসা নতুন কোনো বিষয় নয়। তবে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় এ পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে ছিল। কিন্তু সম্প্রতি লক্ষ্য করা গেছে কক্সবাজার থেকে যাত্রীবাহী বাসে বিশেষ করে রাজধানীতে মাদকের চোরাচালান বেড়ে গেছে। অল্প পরিশ্রমে অধিক অর্থ আয়ের লোভে এক শ্রেণির বাসচালক ও হেলপার মাদক পাচারে আগ্রহী হয়ে উঠছেন। মাদক পাচারে তাদের প্রবণতা দিনদিন আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

সম্প্রতি ডিএনসির বেশ কয়েকটি অভিযানে এমন প্রবণতার সত্যতাও মিলছে। গেল কয়েক মাসে ডিএনসির কয়েকটি অভিযানে দেখা যায়, বিভিন্ন পরিবহনের চালকরা কক্সবাজার থেকে ইয়াবার চালান সুকৌশলে ঢাকার বিভিন্ন আন্তঃজেলা বাস টার্মিনালে নিয়ে আসছেন। পরে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে অভিযুক্ত বাসচালকদের ইয়াবাসহ গ্রেপ্তারও করেছে ডিএনসি।

ডিএনসি সূত্রে জানা যায়, সম্প্রতি ঢাকা থেকে কক্সবাজার রোডে চলাচলকারী বিভিন্ন পরিবহনের বাসচালক ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার হয়েছেন। ইদানিং বাসচালকরা মাদক পরিবহনের সঙ্গে আশঙ্কাজনক হারে জড়িয়ে পড়ছেন বলে ডিএনসির কাছে তথ্য রয়েছে। এ বিষয়ে ডিএনসির নজরদারি আরও বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিশেষ করে সৌদিয়া পরিবহনসহ আরও বেশ কয়েকটি পরিবহনের চালকদের মধ্যে এ প্রবণতা বেশি দেখা গেছে।

অধিক লাভের আশায় ইয়াবা পাচারে ঝুঁকছে বাসচালকরা

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে কাজ করে এমন কয়েকটি সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাদক পাচারে মোটা অঙ্কের টাকা পান পাচারকারীরা। টাকার লোভ সামলানো অনেকের পক্ষে সম্ভব হয় না। আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য অনেকে মাদক পরিবহনে যুক্ত হয়ে পড়ছেন। দেখা গেছে, কক্সবাজার থেকে একজন গাড়িচালক একটি ট্রিপ নিয়ে ঢাকায় আসলে যে পরিমাণ টাকা পান, তার থেকে কয়েক গুণ বেশি টাকা তারা পান ঢাকায় একটি ইয়াবার চালান নিয়ে আসলে। এই লোভে পড়ে দিনদিন মাদক পরিবহনে যুক্ত হওয়া বাসচালকদের সংখ্যা বাড়ছে। এটি কাজে লাগিয়ে মাদককারবারিরা চালকদের নিজেদের পাতা জালে ফেলছেন।

রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থেকে ৭৩০০ পিস ইয়াবাসহ সৌদিয়া পরিবহনের একটি বাসের চালককে আটক করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর / ছবি- সংগৃহীত

ঢাকা-কক্সবাজারে চলাচলকারী একটি পরিবহনের চালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা পোস্টকে বলেন, আগে শোনা যেত হাতে গোনা কয়েকজন মাদকাসক্ত বাসচালক কক্সবাজার থেকে ঢাকায় ইয়াবা নিয়ে আসতেন। এখন দেখা যায় যারা কোনো দিন মাদক কিংবা সিগারেট পান করেননি, এমন চালকরাও ইয়াবাসহ ধরা পড়ছেন। আসলে কক্সবাজারের ইয়াবাকারবারিরা মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে চালকদের লোভে ফেলছেন। দেখা যায়, কক্সবাজার থেকে একটি ট্রিপ নিয়ে আসলে যদি তিনি তিন হাজার টাকা পান, একটা ইয়াবার চালান নিয়ে আসলে পান ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা। এই লোভে পড়ে অনেক চালক বেআইনি কাজে জড়িয়ে পড়ছেন।

সতর্ক করা হচ্ছে পরিবহন-মালিকদের

ডিএনসি সূত্রে জানা যায়, সম্প্রতি কক্সবাজার থেকে বাসচালকদের ইয়াবা নিয়ে আসার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় নড়েচড়ে বসেছে ডিএনসি। এ বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নিতে একদিকে যেমন বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা নজরদারি, তেমনি আলোচনা হচ্ছে মালিকপক্ষের সঙ্গে। পরিবহন সংশ্লিষ্টদের ডিএনসি জানিয়েছে যে তাদের হেলপার ও চালকদের প্রতি বিশেষ নজর দিতে। তাদের কাছে কোনো চালকের গতিবিধি সন্দেহজনক মনে হলে তারা যেন দ্রুত এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানায়।

ঢাকা-কক্সবাজারে চলাচলকারী একটি পরিবহনের ম্যানেজার নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা পোস্টকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকজন আমাদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। তারা এ রুটে চলাচলকারী গাড়ির চালকদের বিষয়ে খোঁজ নিতে বলেছেন। আমাদের পক্ষ থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বলা হয়েছে, কোনো চালকের বিষয়ে সন্দেহ হলে দ্রুত আমরা তাদের জানাব।

এ বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. মেহেদী হাসান বলেন, বাসচালকরা মাদক পাচারে জরিয়ে পড়ছেন— এমন তথ্য আমরা অনেক দিন ধরে পাচ্ছিলাম। গোয়েন্দা নজরদারির মাধ্যমে মাদকসহ চালকদের গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। এছাড়া বাসও জব্দ করা হয়েছে। এ বিষয়ে আমরা মালিকপক্ষকে জানিয়েছি, তারা যেন মাদক পাচারকারী চালকদের বিষয়ে আমাদের তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করে। কারণ, সবার সহযোগিতা ছাড়া মাদক নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।

বাসচালকরা মাদক পাচারে জড়িয়ে পড়ছেন— এ বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের অতিরিক্ত পরিচালক মো. জাফরুল্ল্যাহ কাজল বলেন, ইদানীং প্রায়শই বিভিন্ন পরিবহনের চালকরা মাদকদ্রব্য ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হচ্ছে বলে আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা-কক্সবাজারগামী বিভিন্ন পরিবহনের বেশ কয়েকজন চালককে ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কয়েকটি ক্ষেত্রে বাসও জব্দ করা হয়েছে। এ বিষয়ে আমাদের নজরদারি অব্যাহত আছে।

‘পরিবহন-মালিকদের নিশ্চিত হতে হবে যে তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন চালকগণ মাদক কারবারের সঙ্গে জড়িত নন। পরিবহনগুলোতে চালক, সুপারভাইজার কোনো মাদক পরিবহন করছে কি না, এ বিষয়ে মালিকদের নজরদারি ও সচেতনতা বাড়ানো দরকার।’

এমএসি