‘বর্তমান মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করে বেতন-ভাতা বাড়ানোর প্রস্তাব আসবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে। থাকবে বেতন-ভাতা বৃদ্ধিসহ আরও কিছু ঘোষণা।’ এমন আশায় ছিলেন দেশের সরকারি-আধা সরকারি ও স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা। সেজন্য দীর্ঘদিন আন্দোলনও করছিলেন তারা। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে তাদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধির কোনও ঘোষণা দেননি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এতে চরম হতাশা ও অসন্তোষ জানিয়েছেন সরকারি কর্মচারীরা তারা। আবারও আন্দোলনে যাওয়া ছাড়াও আর কোনও পথ খোলা নেই, এমন হুমকিও দিয়েছেন তারা।

বৃহস্পতিবার (১ জুন) বিকেল ৩টায় জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন করেন। যা চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ১ লাখ ১ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা বেশি। এটি স্বাধীন বাংলাদেশের ৫২তম বাজেট। এছাড়া আওয়ামী লীগ সরকারের তিন মেয়াদের ১৫তম বাজেট এটি।

সরকারি কর্মচারীরা বলছেন, বাজেটে ঘোষণা না থাকলেও সংশোধিত বাজেটে সরকার চাইলে বেতন-ভাতা বৃদ্ধি করতে পারে। সরকারি কর্মচারীদের নিয়ে গঠিত বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা বলছেন, বাজেট চূড়ান্ত হওয়ার আগে সরকারের পদক্ষেপ দেখার অপেক্ষায় থাকব। তারপরও কোনো ঘোষণা না এলে নতুন কর্মসূচি দেওয়া হবে।

বাজেটের আগে যেসব আশ্বাস ছিল 

২০১৫ সালে পে-স্কেল দেওয়ার পর আট বছরে নতুন কোনও পে-স্কেল দেওয়া হয়নি। এছাড়া মহার্ঘ ভাতা বা অন্যান্য কোনো সুযোগ-সুবিধাও দেওয়া হয়নি। এদিকে, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধসহ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার কারণে দ্রব্যমূল্যের দাম বেড়েছে ক্ষেত্রবিশেষে ১৫০ শতাংশ। ৫ শতাংশের মুদ্রাস্ফীতি এখন ৯.২৪ শতাংশ। এ অবস্থায় নতুন পে-স্কেল, ৫০ শতাংশ মহার্ঘ ভাতাসহ সাত দফা দাবিতে ফের আন্দোলনে নামার ঘোষণা দেন সরকারি কর্মচারীরা। কয়েক দফা তারিখ দিয়ে গত ২৬ মে রাজধানীর জাতীয় শহীদ মিনারে মহাসমাবেশের ডাক দেয় বাংলাদেশ সরকারি কর্মচারী দাবি আদায় ঐক্য পরিষদ। কিন্তু সরকারের অনুমতি না মেলায় সেই মহাসমাবেশ করতে পারেননি তারা।

এবারের বাজেটের আগে সরকারি কর্মচারীদের নানা ধরনের আশ্বাস দেওয়া হয়। এর মধ্যে ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণা। তিনি সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিলেন, নতুন কোনও পে-স্কেল বা মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার কোনও চিন্তা সরকারের নেই। মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য করে সরকারি কর্মচারীদের বেতন বাড়ানোর চিন্তা করা হচ্ছে। যেহেতু এখন মূল্যস্ফীতি একটু বৃদ্ধি পেয়েছে, তাই সেই জায়গাটা আবার নতুনভাবে কতটুকু পর্যন্ত সুযোগ দেওয়া যায়, সেটা চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে। এরপর অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়, সরকারি কর্মচারীদের বেতন ২০-২৫ শতাংশ বাড়ানো হতে পারে।

চিকিৎসা, শিক্ষা ও টিফিন ভাতারও ঘোষণা আসেনি

চলতি বছর জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলনে সরকারি কর্মচারীদের শিক্ষা, চিকিৎসা ও টিফিন ভাতা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়। ডিসিদের এ প্রস্তাব আমলে নিয়ে এ তিনটি ভাতা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে বলে জানিয়েছিলেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। তিনি জানান, গ্রেড অনুযায়ী চিকিৎসা ভাতা ১৫০০ থেকে ২৫০০ টাকা, শিক্ষা ভাতা এক সন্তানদের জন্য ৫০০ টাকা এবং দুই সন্তানের জন্য এক হাজার টাকা বৃদ্ধি পেয়ে সর্বোচ্চ দুই হাজার টাকা, টিফিন ভাতা গ্রেড অনুসারে ২০০ টাকা থেকে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হতে পারে। অর্থ  ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, নতুন পে-স্কেল কিংবা মহার্ঘ ভাতা না দিলেও এই তিনটি ভাতা দেওয়া হবে এটা মোটামুটি নিশ্চিত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এসব ভাতারও ঘোষণা আসেনি।

বেতন-ভাতা নয়, আবাসনে সুখবর দিলেন অর্থমন্ত্রী

২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরকারি কর্মচারীদের জন্য আবাসন খাতে সুখবর দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। তিনি জানান, সরকারি কর্মচারীদের আবাসন সুবিধা বাড়ানোর প্রস্তাব এসেছে প্রস্তাবিত বাজেটে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী, সরকারি কর্মচারীদের জন্য আবাসন সুবিধা ৮ শতাংশ থেকে ৪০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য অর্জনে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। তিনি বলেন, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ৬ হাজার ৫০৮টি ফ্ল্যাট নির্মাণ করা হবে ও ৫ হাজার ২১১টি ফ্ল্যাট নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। এছাড়া আরও ৮ হাজার ৮৩৫টি ফ্ল্যাট নির্মাণ ও ৬৪ জেলায় সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য ডরমিটরি ভবন নির্মাণে পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে চলমান প্রকল্পগুলো শেষ হলে সরকারি কর্মচারীদের আবাসন সুবিধা ১৫ শতাংশে উন্নীত হবে।

ফের আন্দোলনে যাওয়ার হুমকি

নবম পে-স্কেল ঘোষণা, বিদ্যমান পে-স্কেলের বৈষম্য দূর করা ও ৫০ শতাংশ মহার্ঘ ভাতাসহ সাত দফা দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছেন সরকারি কর্মচারীরা। ১১ থেকে ২০তম গ্রেডের কর্মচারীদের আশা ছিল যে, প্রস্তাবিত বাজেটে সরকারি কর্মচারীদের বেতন বাড়ানোর ঘোষণা থাকবে। কিন্তু এ বিষয়ে কোনও ঘোষণা না থাকায় নিরাশ হয়েছেন তারা।

কর্মচারী নেতারা বলছেন, একাধিকবার আন্দোলনে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়া হলেও সরকারের তরফ থেকে বাজেট পর্যন্ত অপেক্ষার জন্য আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। প্রস্তাবিত বাজেটে এ সংক্রান্ত কিছু না থাকায় তারা হতবাক। তবে আশা ছাড়তে রাজি নন তারা। কেউ কেউ বলছেন, বাজেট চূড়ান্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত তারা অপেক্ষা করবেন। তারপরও কোনো ঘোষণা না এলে নতুন কর্মসূচির কথা ভাববেন।

ঘোষিত বাজেটের বিষয়ে জানতে চাইলে গভর্নমেন্ট এমপ্লয়িজ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব নজরুল ইসলাম বলেন, সরকার অমাাদের সঙ্গে এক ধরনের প্রতারণা করেছে। বাজেটে কর্মচারীদের জন্য কিছু না থাকায় আমরা হতাশ। জানি না বাজেট চূড়ান্ত হওয়ার আগে কোনও ঘোষণা আসবে কি না। তবে আমাদের মূল দাবি হলো বেতন বাড়ানোর আগে বৈষম্য বিলুপ্ত করা। কারণ বৈষম্য রেখে বেতন বাড়ালে বৈষম্য আরও বাড়বে। আমরা শেষ পর্যন্ত দেখতে চাই। না হয় আন্দোলনে যাওয়া ছাড়া কোনও বিকল্প নেই।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ সরকারি কর্মচারী দাবি আদায় ঐক্য পরিষদের নির্বাহী কমিটির সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, অমাাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করে বেতন বাড়ানোর যে কথা বলেছেন তার কোনও প্রতিফলন নেই। অর্থমন্ত্রী সরকারি কর্মচারীদের জন্য কিছুই বলেননি। বৈষম্যের দূরীকরণের ব্যাপারেও কিছুই বলেননি।

তিনি বলেন, সরকার বার বার আশ্বাস দিচ্ছে ও তা ভঙ্গ করছে। এসব আশ্বাসে আমাদের আন্দোলন স্থগিত করানো হচ্ছে। এতে কর্মচারী নেতারা সাধারণ কর্মীদের তোপের মুখে পড়ছি। কারণ বার বার আন্দোলনের ডাক দিয়েও সেটা আমরাই স্থগিত করছি। বাজেট চূড়ান্ত হওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুখ থেকে নিশ্চয়ই কোনও না কোনও ঘোষণা পাব। তেমনটা না হলে আমাদের দাবি আদায়ে ফের আন্দোলনে যাওয়া ছাড়া কোনও উপায় নেই।

এনএম/কেএ