সুপরিকল্পিত উন্নয়ন ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে জলাধার ও সবুজ অঞ্চল সংরক্ষণই ঢাকাকে বাঁচিয়ে রাখার একমাত্র উপায় বলে উল্লেখ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

শনিবার (৩ জুন) রাজধানীর বাংলামটরে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) উদ্যোগে এবং নগর উন্নয়ন সাংবাদিক ফোরামের সহযোগিতায় আয়োজিত এক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা এ কথা বলেন।

বক্তারা বলেন, ঢাকা শহরের জলাধার ভরাট ও সবুজ নিধনের পেছনে খাল-নালা-জলাশয় ও নিম্নভূমি দখল এবং ভরাট, সবুজ এলাকা নষ্ট করে অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণ, বনায়ন না করাসহ বহুবিধ কারণ রয়েছে। একই সঙ্গে জনসাধারণের জন্য পার্ক ও খেলার মাঠ তৈরি করা, জলাশয় ও নদীর যথাযথ প্রবাহ ও সীমানা নির্ধারণ নিশ্চিত করা, জলাধার ও সবুজ এলাকা সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে প্রণীত সকল আইনের সফল বাস্তবায়ন এবং রক্ষণাবেক্ষণ এর মাধ্যমে ঢাকার জলাধার ও সবুজ নিধন সমস্যা দূর করা সম্ভব।  

বিআইপির সাধারণ সম্পাদক পরিকল্পনাবিদ শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান বলেন, যে শহরটি বসবাসযোগ্যতার তালিকায় নিচের দিক থেকে সপ্তম স্থানে, তা নগরীর সকলের জন্য হুমকিস্বরূপ। ২৮ বছরব্যাপী নগরীর সবুজ এলাকা ও জলাধারের স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায় যে, ঢাকার সবুজ এলাকা ২০২৩ সালে ৭.০৯ শতাংশে এ নেমে এসেছে, যা ১৯৯৫ সালে প্রায় ১৩.৪৫% ছিল এবং জলাধার ২০.৫৮% থেকে নেমে এসেছে ২.৯১% এ। যেখানে একটি শহরের জন্য আদর্শ সবুজ এলাকার পরিমাণ হলো ১৫% ও জলাধারের ১০-১২ শতাংশ। 

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) সভাপতি সুলতানা কামাল বলেন, জলাধার সবুজ নিধন ও সংরক্ষণ বিষয়টি শুধু টেকনিক্যাল, সাংস্কৃতিক নয়, রাজনৈতিকও। এ দ্বায়িত্ব আমাদের সকলের হলেও মূল দ্বায়িত্ব সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে পালন করতে হবে। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে এ দ্বায়িত্ব পালনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অবহেলা দেখা যায়। 

বুয়েটের স্থাপত্য ও পরিকল্পনা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. ইশরাত ইসলাম বলেন, সবুজ ভূমি এবং জলাভূমির সঠিক সংজ্ঞায়ন প্রয়োজন। কারণ ছাদবাগানের জন্য স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণে সবুজায়নের পরিমাণ বেশি পাওয়া যায় কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা কংক্রিট আচ্ছাদিত এলাকা। অপরদিকে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে জলাধার ভরাট করে উন্নয়ন করার জন্য রাজউক থেকে অনুমোদন নেওয়া হয়, কিন্তু এখানে উল্লেখ্য যে, রেইনওয়াটার হার্ভেস্টিং কখনও জলাধার ভরাটের সমাধান হতে পারে না।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, পূর্বাচলের পরিকল্পনার ৪ নম্বর সংশোধিত পরিকল্পনায় যে ১৯% বনভূমি সংরক্ষণের কথা বলেছে, তা পর্যায়ক্রমে রাতের আধারে ধীরে ধীরে পুড়িয়ে উজাড় করা হয়েছে। একটি মানুষের টেকসই জীবনযাত্রার জন্য শুধু বসবাসের স্থানই যথেষ্ট নয় বরং জলাভূমি ও সবুজভূমির ও প্রয়োজন রয়েছে এপ্রেক্ষিতে ঢাকার এতো জনসংখ্যা ধারণের ক্ষমতা নেই। 

স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের ডিন ও সভাপতি অধ্যাপক ড. আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন,  ঢাকার বায়ুমান ও তাপমাত্রা বিদ্যমান সবুজভূমি ও জলাধারের সাথে বিশেষ ভাবে সম্পর্কিত। ঢাকায় সবুজভূমি ও জলাধারের তুলনায় কংক্রিট আচ্ছাদিত এলাকার তাপমাত্রা স্থানভেদে ৩-৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। এজন্য গাছ যদি প্রকল্প বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়ায় তাহলে তা নিধন না করে স্থানান্তর পদ্ধতি  অবলম্বন করতে হবে।

নগর উন্নয়ন সাংবাদিক ফোরামের সভাপতি অমিতোষ পাল বলেন, নগর পরিকল্পনাবিদদের মোতাবেকে একটি পার্কে ৫ শতাংশের অধিক কনক্রিট আচ্ছাদিত এলাকা থাকা যাবে না, কিন্তু গুলশানের সাহাবউদ্দিন পার্ক, ওসমানী উদ্যান এর বর্তমান অবস্থা এবং উন্নয়নের নামে সেখানকার জলাধারের সংকোচন ভিন্ন চিত্র প্রদান করছে। 

বিআইপির প্রেসিডেন্ট পরিকল্পনাবিদ ফজলে রেজা সুমন বলেন, ঢাকাকে টেকসই ও বাসযোগ্য করার জন্য ১৪৭ বর্গমিটারের ঢাকার কেন্দ্রীয় নগর অঞ্চলের বাইরে যে বর্ধিঞ্চু এলাকা রয়েছে, সেখানে বিদ্যমান পার্ক বা খেলার মাঠ ও জলাভূমিসমূহ ল্যান্ড ব্যাংকিং এর দখল হওয়ার পূর্বেই সিল করতে হবে। কারণ উক্ত সবুজ ও জলাভূমি একবার দখল বা ভরাট হয়ে গেলে তা পুনরুদ্ধার করা কঠিন, সময় ও অর্থসাপেক্ষ।

এএসএস/এমএ