সাঈদ ওসমান রিজভী

সাঈদ ওসমান রিজভী। জন্ম দ্বীপ জেলা ভোলার লালমোহনে। শৈশবে কেটেছে ঢাকায়। ঢাকার উত্তরা মডেল স্কুল থেকে এসএসসি, মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। ২০১৩ সালে স্বপরিবারে পাড়ি জমান স্বপ্নের দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে গিয়ে মিশিগানের ওয়েন কাউন্টি কমিউনিটি কলেজে দুই বছর ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা করেন। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে মন না বসায় ফেরিস স্টেট ইউনিভার্সিটিতে আইনে ভর্তি হন। সেখান থেকে ব্যাচেলর অব ক্রিমিনাল জাস্টিস সাবজেক্টে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেন।

মানুষের সেবা করার স্বপ্ন নিয়ে মিশিগানের  ওক পার্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্টে ক্যাডেট পুলিশ অফিসার হিসেবে যোগদান করেন। এখন তিনি মিশিগানের একজন পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।  ওক পার্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্টে একমাত্র বাঙালি পুলিশ অফিসার তিনি। অন্যদিকে আইনে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করা তার স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস খেয়া প্রগ্রেসিভ ইনসুরেন্স কোম্পানির লিগ্যাল ডিপার্টমেন্টে চাকরি করছেন। রিজভী পুলিশ অফিসার হিসেবে অনেকদূর যেতে চান। বাংলাদেশ-বাঙালির পরিচয় যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের কাছে তুলে ধরতে চান। 

পুলিশ অফিসার রিজভী তার জীবনের গল্প ঢাকা পোস্টের কাছে তুলে ধরেছেন। অনলাইনে তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ঢাকা পোস্টে জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেদী হাসান ডালিম

ঢাকা পোস্ট : ছোটবেলা কোথায় কেটেছে, প্রথমে সেই গল্প জানতে চাই

সাঈদ ওসমান রিজভী : জন্ম ভোলা জেলার লালমোহনে। আমার দাদা ইউনুস মিয়া ৪০ বছর ধরে লালমোহন হাই স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন। বাবা ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে পলিটিক্যাল সায়েন্সের ওপর মাস্টার্স করে দেশে ব্যবসা করতেন। মা গৃহিণী। আমরা তিন ভাই। আমি মেজো। আমার বড় ভাই আমেরিকার মিশিগান শহরে একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করছেন। ছোট ভাই হাই স্কুলে পড়ছে। আমরা সপরিবারে আমেরিকার মিশিগান শহরে থাকি। আমার ছোটবেলা কেটেছে ঢাকায়। ছোটবেলা থেকে বেশ শান্ত স্বভাবের ছিলাম। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডাবাজি, পড়াশোনা, খেলাধুলার মাঝেই শৈশব কেটেছে আমার। খেলাধুলার প্রতি ভীষণ আগ্রহ ছিল। ছোটবেলায় ইচ্ছা ছিল একজন স্পোর্টসম্যান হওয়ার। ঢাকার উত্তরা মডেল স্কুল থেকে এসএসসি এবং মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি সম্পন্ন করেছি।

ঢাকা পোস্ট : যুক্তরাষ্ট্রে কোথায় পড়াশোনা করেছেন?

সাঈদ ওসমান রিজভী : বিদেশে নতুন কেউ এলে প্রথমে হতভম্ব হয়ে পড়েন। কি পড়বেন, কোন সাবজেক্ট বেছে নেবেন, কোন ইউনিভার্সিটিতে পড়বেন, কোনটা পড়লে চাকরি ভালো পাওয়া যাবে– এমন হাজার প্রশ্ন মনের মাঝে উঁকি দেয়। আমার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ছিল না। আমার পড়াশোনার ঘটনা বেশ মজার। বাবার ইচ্ছা ছিল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে যেন পড়াশোনা করি। বাবার মন রক্ষায় আমি অ্যাসোসিয়েটস অব ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা শুরু করি ওয়েন কাউন্টি কমিউনিটি কলেজে। দুই বছর  পড়াশোনার পরও মন বসছিল না। আমি চাইতাম সমাজের উন্নয়নের  জন্য ঘরের বাইরে কাজ করতে। আমার কাজের দ্বারা মানুষ যেন উপকৃত হন।  আমার ক্লাসমেট ছিলেন জান্নাতুল ফেরদৌস খেয়া (এখন স্ত্রী), তখন আমরা ভালো বন্ধু ছিলাম। খেয়া তখন ফেরিস স্টেট  ইউনিভার্সিটিতে পড়ছিলেন এবং গেস্ট স্টুডেন্ট হয়ে এসেছিলেন আমার কলেজে। অল্প কিছু সময়েই আমরা ভালো বন্ধু হয়ে উঠি। যেহেতু আমি চ্যালেঞ্জিং কিছু করতে চাইতাম এ কারণে খেয়ার কাছে ব্যাপারটা শেয়ার করি। তার  পরামর্শে আমি আইনের ২-৩টা ক্লাস করলাম। বেশ ভালো লাগল। এটা খুবই চমৎকার আর ভিন্ন রকম একটা ফিল্ড। আমি বুঝে গিয়েছিলাম আমি এমন একটা ফিল্ডে ভালো করতে পারব যেখানে আমার আগ্রহ আছে। তারপর আমি ফেরিস স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে ব্যাচেলর অব ক্রিমিনাল জাস্টিস কমপ্লিট করি।

ওক পার্ক সিটি পুলিশ প্রধানের সঙ্গে স্বস্ত্রীক সাঈদ ওসমান রিজভী

ঢাকা পোস্ট : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার গল্পটা যদি বলতেন।

সাঈদ ওসমান রিজভী : সে এক লম্বা ঘটনা। ২০০১ সালে আমার ফুফু আমাদের সপরিবারে আমেরিকা আসার জন্যে আবেদন করেন। এই প্রক্রিয়াগুলো বেশ সময়সাপেক্ষ হয়ে থাকে। ২০১৩ সালে আমরা আমেরিকা আসার ডাক পাই এবং মিশিগান শহরে এসে স্থায়ী হই। দেখতে দেখতে আজ ১০টি বছর পেরিয়ে গেল।

ঢাকা পোস্ট : আপনি যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশ অফিসার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন, এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাই।

সাঈদ ওসমান রিজভী : ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে আমি ক্যাডেট পুলিশ অফিসার হিসেবে যোগদান করি। এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান শহরে ওক পার্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্টে আমি পুলিশ অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। নতুন পুলিশ অফিসারদের এফটিও (ফিল্ড ট্রেনিং অফিসার) হিসেবে এক বছর পর্যন্ত কাজ করতে হয়। এটা অনেক ভিন্ন রকমের কাজ। কখনো আপনি নিজেকে পাবেন অফিসে, কখনোবা রাস্তায়। এই ফিল্ডে শিক্ষার শেষ নেই। আজ দিন ভালো যাচ্ছে, হয়ত কাল এমন কিছু দেখব যেটা আমি কল্পনাতেও ভাবিনি। সব কিছুই অপ্রত্যাশিত। কিন্তু যে জবে আমি কমিউনিটির জন্য কিছু করতে পারব, এমন চাকরি আমার ভীষণ প্রিয়। আমি চার দেয়ালের ভেতরে না বসে থেকে, বাইরে বের হয়ে এমন কাজ করব যেটাতে আরও ১০ জন উপকৃত হন। যদিও জীবন মহান আল্লাহর হাতে। কিন্তু এটা বলতে পারি যে, আমরা পুলিশ অফিসাররা জীবন বাজি রেখে কাজে বের হই, এই আশায় যেন প্রত্যেকটি মানুষকে নিরাপদে রাখতে পারি।

ঢাকা পোস্ট : যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশ অফিসার হতে যোগ্যতা ও সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে জানতে চাই

সাঈদ ওসমান রিজভী : মিশিগানের পুলিশ অফিসার হতে গেলে ডিপার্টমেন্ট টু ডিপার্টমেন্ট অনেক পার্থক্য আছে। এক এক ডিপার্টমেন্টের এক এক ধরনের রিকোয়ারমেন্ট থাকে। আমি যদি আমার ডিপার্টমেন্ট  সম্পর্কে বলি, ওক পার্ক সিটিতে আপনাকে যোগ দেওয়ার জন্য পুলিশ একাডেমি থেকে ট্রেনিং সম্পন্ন করে আসতে হবে। পুলিশ একাডেমিতে নিয়োগ দেওয়ার আগে আবার আপনাকে প্রাথমিক ফিটনেস এবং লিখিত পরীক্ষায় পাস করতে হবে। প্রাথমিক পরীক্ষা দুই ভাগে হয়ে থাকে। প্রথমত, ফিজিক্যাল ফিটনেস এক্সাম এবং দ্বিতীয় হচ্ছে, লিখিত আইন বিষয়ক পরীক্ষা। ফিটনেস টেস্টে তারা দেখে থাকে আপনি শারীরিকভাবে ফিট কি না পুলিশে যোগ দেওয়ার জন্য। বিভিন্ন রকমের ফিটনেস এক্সাম দিতে হয়। তাছাড়া সাইকোলজিকাল টেস্ট ও মেডিকেলের নানা রকম টেস্ট করানো হয়। ব্যাকগ্রাউন্ড চেকে ১০০ পার্সেন্ট পজিটিভ আসতে হবে।  একাডেমিতে অ্যাডমিশনের পর আরও অনেক কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে আপনাকে তৈরি করা হবে। একাডেমি থাকবে আরও ৬ মাস। একাডেমিতে মূলত ফায়ার আর্মস, ফার্স্ট এইড, সাবজেক্ট কন্ট্রোল, ইমার্জেন্সি ভেহিকল অপারেশন এবং নানা রকম ট্রেনিং দেওয়া হয়। আমেরিকার পুলিশ হওয়ার সুবিধা অনেক। সেটাও অন্যতম একটি কারণ, যার কারণে আমি পুলিশ হতে চেয়েছিলাম। সিটির বাজেটের ওপর নির্ভর করে অফিসারদের সুযোগ-সুবিধা নির্ধারণ করা হয়। ওক পার্ক সিটি তাদের অফিসারদের জন্য বেশ ভালো বাজেট নির্ধারিত করে। এটাকে মিশিগানের ওয়ান অব দ্য টপ পে ডিপার্টমেন্ট বলে গণ্য করা হয়। বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার মধ্যে সিটি থেকে নির্ধারিত লাইফ ইন্স্যুরেন্স, রিটায়ারমেন্ট পলিসি, ডিসকাউন্ট পাসেস, এবং সপরিবারে ফ্রি ফুল কাভারেজ মেডিকেল। তাছাড়াও থাকছে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা।

স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস খেয়ার সঙ্গে পুলিশ অফিসার সাঈদ ওসমান রিজভী

ঢাকা পোস্ট :  পুলিশ হিসেবে যোগদান করেছেন, আপনার অনুভূতি কেমন?

সাঈদ ওসমান রিজভী : অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। নিউইয়র্ক শহরে অনেক বাঙালি পুলিশ দেখা যায় কিন্তু আমাদের মিশিগান শহরে তেমন নেই। ম্যাকম পুলিশ একাডেমিতে আমি ছিলাম একমাত্র বাঙালি, এমনকি আমি একমাত্র এশিয়ান ছিলাম। ঠিক তেমনটা ঘটেছে ওক পার্ক পিডিতেও। আমি বাদে কোনো বাঙালি বা এশিয়ান নেই। একমাত্র বাঙালি হয়ে আমি গর্বিত। আমাদের বড় বাঙালি কমিউনিটি রয়েছে, আশা করছি আগামী বছরগুলোতে আরও বাঙালি অফিসারের দেখা মিলবে।

ঢাকা পোস্ট : আপনার বিয়ে, স্ত্রী সম্পর্কে যদি বলতেন।

সাঈদ ওসমান রিজভী : আমার স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস খেয়া। ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন থেকে ব্যাচেলর অব ল’ ডিগ্রি সম্পন্ন করেছেন। তিনি ২০১৭ সাল থেকে আমেরিকাতে থাকছেন। আমেরিকাতে এসে তিনি আবার ব্যাচেলর অব ক্রিমিনাল জাস্টিস কমপ্লিট করেন ফেরিস স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে। আমাদের বিয়ে হয় ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। আমার জীবনে স্ত্রী অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। বলা যেতে পারে, যখন আমি জীবনের একটা বিশেষ পরিস্থিতিতে দিশেহারা ছিলাম তখন তিনি আমাকে ভীষণ সাপোর্ট করেছেন। যেমনটা বলেছিলাম, ইঞ্জিনিয়ারিং স্টুডেন্ট থেকে আজ আমি পুলিশ অফিসার। তার সাপোর্ট ও উৎসাহে  আজ আমি এ পর্যায়ে এসেছি।

ঢাকা পোস্ট: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানতে চাই।

সাঈদ ওসমান রিজভী : আমি চেষ্টা করব কোনো পর্যায়ে যদি এফবিআইয়ে ট্রান্সফার নিতে পারি। না হলে ডিটেকটিভ হব। তাছাড়া কয়েক বছর কাজ করার পর আপনি রিক্রুইটার হতে পারবেন। আমার এটা হওয়ার অনেক ইচ্ছা আছে। কারণ আমি চাই আমাদের বাঙালি কমিউনিটি থেকে যেন আরও মানুষ এই প্রফেশনটি বেছে নেন। বাঙালি হিসেবে আমাদের বাঙালি কমিউনিটির জন্য কিছু করতে চাই, এই পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছি।

ঢাকা পোস্ট : বাংলাদেশ সম্পর্কে কিছু বলুন।

সাঈদ ওসমান রিজভী : বাংলাদেশ আমার জন্মস্থান। শত ব্যস্ততার মধ্যেও বাংলাদেশের কথা মনে পড়ে। দেশে খুব একটা যাওয়া না হলেও ইচ্ছা আছে আগামীতে দেশে যাব। যেহেতু আমি আমার ডিপার্টমেন্টে একমাত্র বাঙালি। অনেকেই আছে যারা বাংলাদেশকে আমার দ্বারা চিনেছেন, আমি এ বিষয়টা নিয়ে অত্যন্ত গর্বিত। আমাদের দেশ এখন বিশ্বজুড়ে অনেক পরিচিতি লাভ করেছে। কিন্তু একজন হলেও যখন বাংলাদেশকে আমার মাধ্যমে চিনে থাকে, তখন সত্যি ভীষণ ভালো লাগে।

ঢাকা পোস্ট : শিক্ষার্থী বা তরুণদের কী পরামর্শ দেবেন?

সাঈদ ওসমান রিজভী : আমাদের মিশিগানে খুব অল্প হাতেগোনা কয়েকজন পুলিশ আছেন। বাঙালি নারী অফিসার একদমই নেই। যেহেতু আমেরিকার পুলিশিং একটু রিস্কি, অনেকেই এটাকে ক্যারিয়ার হিসেবে নিতে চান না কিন্তু আমি আশাবাদী বাঙালি কমিউনিটি থেকে আগামীতে আমরা আরও ক্যান্ডিডেট পাব। আমি উৎসাহিত করছি সেই সব তরুণ-তরুণীদের যারা কোনো চ্যালেঞ্জিং জব করতে চান। এটি এমন একটি ক্যারিয়ার যেটা আপনার জীবনের ধারা হয়ে উঠবে, আপনি সমাজে পরিবর্তন আনতে পারবেন।

এমএইচডি/এসএসএইচ/