জমি সংক্রান্ত একটি বিরোধের জেরে ‘মারামারি’ হয়েছে উল্লেখ করে গত মাসে আনোয়ারা থানায় দুটি মামলা হয়। এর একটিতে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ এনে সংশ্লিষ্ট ধারা উল্লেখ করা হয়। আরেকটিতে অন্য ধারা রাখা হয়। অভিযোগ উঠেছে, ‘উপর মহলের ফোনে ক্ষুব্ধ হয়ে’ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষককে ফাঁসাতে ইচ্ছা করে হত্যাচেষ্টার ধারা যুক্ত করেছেন থানার ওসি। এতে অপরাধ না করেও ‘ক্যারিয়ারে’ দাগ লাগার আশঙ্কায় ভুগছেন সংশ্লিষ্ট শিক্ষক। 

গুলি বা ধারালো অস্ত্রের আঘাতে কেউ মুমূর্ষু অবস্থায় চলে গেলে বা গুরুতর আহত হলে দণ্ডবিধি আইনের ৩২৬ ধারায় মামলা নেওয়ার বিধান আছে। কিন্তু চট্টগ্রামের আনোয়ারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মির্জা মোহাম্মদ হাছান ৩২৬ ধারায় এমন একটি ঘটনায় মামলা নিয়েছেন যেখানে বাদী গুরুতর আহত তো হনইনি বরং তার গায়ে আঘাতের কারণে কোনো সেলাই বা এ ধরনের কোনো চিকিৎসা দেওয়ার প্রয়োজন হয়নি। যে চিকিৎসাপত্রের ভিত্তিতে তিনি মামলা নিয়েছেন সেখানে কেবল একটি ব্যাথানাশক ওষুধ দেওয়া হয়েছে।

এ ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন চট্টগ্রামের কয়েকজন আইনজীবী। তারা বলছেন, যে ঘটনায় গুরুতর কোনো আঘাত নেই সে ঘটনায় ৩২৬ ধারায় মামলা নিতে পারেন না ওসি। এখানে নিশ্চয়ই অন্য কোনো ঘটনা প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে।

যদিও জাহিদ হাসান মামলার এজাহারে উল্লেখ করেন, ৮ জন আসামি তার উপর ধারালো অস্ত্র, লোহার রড, হকিস্টিক হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. তারেক ধারালো ছোরা দিয়ে তার মাথায় কোপ দেন।

যার বিরুদ্ধে মামলায় হত্যাচেষ্টার অভিযোগ আনা হয়েছে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. তারেক চৌধুরী। তিনিসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে ওই মামলা করা হয়।

মামলার বাদীর নাম জাহিদ হাসান চৌধুরী। আনোয়ারা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের রেজিস্টার খাতা যাচাই করে দেখা গেছে, এজাহারে উল্লেখ করা ঘটনার দিন ২৭ মে রাত ৯টায় জাহিদ হাসান চৌধুরী হাসপাতালের জরুরি বিভাগে যান। কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে ব্যবস্থাপত্রে দুটি ওষুধ লিখে দেন। একটি ব্যাথানাশক এবং আরেকটি অ্যাসিডিটি সমস্যার জন্য। এছাড়া একটি এক্সরে করানোর পরামর্শ দেওয়া হয়। তাকে হাসপাতালে ভর্তি নেওয়া হয়নি। 

অর্থাৎ ব্যবস্থাপত্রে পরিষ্কার বোঝা যায় বাদী জাহিদ হাসানের গায়ে কোনো গুরুতর আঘাত, কাটা-ছেড়া বা রক্তপাতের ঘটনা ঘটেনি, ফলে তাকে সে ধরনের কোনো চিকিৎসাও দিতে হয়নি।

যদিও জাহিদ হাসান মামলার এজাহারে উল্লেখ করেন, ৮ জন আসামি তার উপর ধারালো অস্ত্র, লোহার রড, হকিস্টিক হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. তারেক ধারালো ছোরা দিয়ে তার মাথায় কোপ দেন।

জাহিদ হাসান চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমার ওপর হামলা করেছে তারা। আমি ওই দিন চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরেছি। ডাক্তার একটি এক্সরে করাতে বলেছিলেন। কিন্তু আমি সেটি করিনি।’

ঘটনার পেছনে অন্য ঘটনা?

শিক্ষক তারেক ঢাকা পোস্টের কাছে দাবি করেন, তিনি কথিত মারামারির ঘটনার সময় গ্রামের বাড়িতে ছিলেন না। তিনি তখন চট্টগ্রাম শহরে অবস্থান করছিলেন।

তার অভিযোগ, জেলা পুলিশের সঙ্গে যোগোযোগ করায় ক্ষুব্ধ হয়ে ওসি হাছান বাদীকে ডেকে নিয়ে তার বিরুদ্ধে মামলা করিয়েছেন।

গত ২৭ মে রাত ৮টার দিকে শিক্ষক তারেক চৌধুরীর বাড়িতে হামলা করে প্রতিপক্ষের লোকজন। ওই হামলায় নেতৃত্ব দেন জাহিদ হাসান চৌধুরী। একপর্যায়ে স্থানীয় অনেকে বাড়ি থেকে বের হয়ে এলে হামলাকারীরা বসতবাড়িতে ভাঙচুর করে এবং তিনটি গাছ কেটে চলে যায়।

তিনি বলেন, ‘একই ঘটনায় প্রথমে মামলা করতে থানায় যাই আমি। কিন্তু ওসি হাছান আমার মামলা নিতে গড়িমসি করছিলেন। পরে আমি জেলা পুলিশ সুপারের কাছে বিষয়টি জানালে তিনি মামলা নিতে বলেন।’

তিনি বলেন, ওইদিন হামলা হয়েছিল আমার বাড়িতে। আইনি প্রতিকার পেতে আমি থানায় গিয়েছিলাম। এখন উল্টো আমিই আসামি হয়ে গেলাম। ঘটনার সময় আমি যে বাড়িতে ছিলাম না তা ওসি এবং সার্কেল সহকারী পুলিশ সুপার দুজনই জানেন। দুজনের সঙ্গেই মামলার আগে আমার কথা হয়েছে। তারপরও আমার বিরুদ্ধে তারা মামলা নিয়েছেন।

তারেক বলেন, আমি পড়াশোনা করে অনেক কষ্ট করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছি। সামনে উচ্চ শিক্ষার জন্য বিদেশ যাব। এই মামলার কারণে পুলিশ ক্লিয়ারেন্স পেতে আমার সমস্যা হয়ে যাবে।

আসলে কী ঘটেছিল?

চবি শিক্ষক তারেকের বাড়িতে আসলে কী ঘটেছিল তা স্থানীয়দের মাধ্যমে জানার চেষ্টা করে ঢাকা পোস্ট। স্থানীয় বেশ কয়েকজন জানান, দীর্ঘদিন ধরে সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ চলছে আনোয়ারা উপজেলার হাইলধর ইউনিয়নের খাসখামা গ্রামের উজির আলী চৌধুরী বাড়ির দুই পরিবারের মধ্যে। এর জের ধরে গত ২৭ মে রাত ৮টার দিকে শিক্ষক তারেক চৌধুরীর বাড়িতে হামলা করে প্রতিপক্ষের লোকজন। ওই হামলায় নেতৃত্ব দেন জাহিদ হাসান চৌধুরী। একপর্যায়ে স্থানীয় অনেকে বাড়ি থেকে বের হয়ে এলে হামলাকারীরা বসতবাড়িতে ভাঙচুর করে এবং তিনটি গাছ কেটে চলে যায়।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় বাসিন্দা তাহেরুল ইসলাম সাদ্দাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ওই দিন রাত ৮টার দিকে চবি শিক্ষকের বাড়িতে জাহিদরা কিছু লোকজনসহ এসে হামলা করে। আমরা বের হয়ে তাদের কাছে হামলার বিষয়ে জানতে চাই। জাহিদ উত্তর দেন, এটা তাদের দীর্ঘদিনের সমস্যা। আমরা বিষয়টি তাদের স্থানীয়ভাবে সমাধান করতে বলি। পরে স্থানীয় লোকজন সবাই বের হলে তারা চলে যায়।

ঘটনার সময়ে চবি শিক্ষক তারেক ঘটনাস্থলে ছিলেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা তাকে ওই সময় ঘটনাস্থলে দেখিনি।

যা বলছেন আইনজীবীরা

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ৩২৬ ধারা প্রয়োগের ক্ষেত্রে ওসিদের সতর্ক থাকা দরকার। এটি মৃত্যুর আগে সর্বোচ্চ আঘাতের ক্ষেত্রে দেওয়া হয়ে থাকে। যে আঘাতের ঘটনায় কেবল একটি ব্যথানাশক ওষুধ দিতে হয়েছে সে ঘটনায় ৩২৬ ধারা আনা অযৌক্তিক। এ ধরনের ধারা ঢুকিয়ে এবং একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের নামে মিথ্যা মামলা নিয়ে ওসি অপেশাদার আচরণ করেছেন। জামিন-অযোগ্য (৩২৬) ধারা দিয়ে ওসি হয়ত আসামিদের প্রাথমিকভাবে জেল খাটানোর আয়োজন করেছেন।  

কেবল এজাহারের ভিত্তিতে মামলা নেওয়ার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট এস এম দিদার উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, কেউ একজন এজাহার নিয়ে আসল, আর এটির ভিত্তিতে মামলা হয়ে গেল? এজাহারের সত্যতা ওসিকে প্রাথমিকভাবে যাচাই করতে হবে। একই সঙ্গে ভুক্তভোগীর চিকিৎসাপত্রের বিষয়টি বিবেচনায় আনতে হবে। দৃশ্যমান গুরুতর আঘাত না থাকলে ওসি কোনোভাবেই ৩২৬ ধারায় মামলা নিতে পারেন না।

কী বলছে পুলিশ?

চট্টগ্রাম আনোয়ারা সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার কামরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, মামলার ধারা চিকিৎসার ব্যবস্থাপত্রের ভিত্তিতে নয়, এজাহারের ভিত্তিতে দেওয়া হয়। ঘটনার দিন দুই পক্ষ মারামারি করেছে এবং দুই পক্ষই এজাহার দিয়েছে। তাদের বর্ণনা অনুযায়ী ধারা বসিয়ে মামলা রুজু করা হয়েছে। দুটি মামলারই তদন্ত কার্যক্রম চলছে। তদন্তে চিকিৎসা সনদ নেওয়া হবে। সে অনুযায়ী আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ঘটনাস্থলে না থাকার পরও শিক্ষক তারেককে আসামি করা হয়েছে এমন অভিযোগ উঠেছে, এ বিষয়ে কী বলবেন? জবাবে তিনি বলেন, বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে।

আনোয়ারা থানার ওসি মির্জা মোহাম্মদ হাছান ঢাকা পোস্টকে বলেন, দুই পক্ষ এজাহার দিয়েছে। এজাহারের ভিত্তিতে মামলা নেওয়া হয়েছে। এখানে অন্য কোনো বিষয় নেই। ঘটনা তদন্ত করা হচ্ছে।

দণ্ডবিধির ৩২৬-এ যা বলা আছে

৩২৬ ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি গুলিবর্ষণের, ছুরিকাঘাতের বা কাটার যন্ত্র বা হাতিয়ার দ্বারা গুরুতর আঘাত করে, অথবা যে হাতিয়ারটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার ফলে মৃত্যু ঘটতে পারে, সে হাতিয়ার দ্বারা গুরুতর আঘাত করে অথবা কোনো বিষ বা ক্ষয়কারী দ্রব্য কর্তৃক গুরুতর আঘাত করে, অথবা কোনো বিস্ফোরক দ্রব্য দ্বারা গুরুতরভাবে আহত করে, অথবা যে দ্রব্য শ্বাস কর্তৃক গ্রহণ করলে, উদরস্থ করলে বা রক্তে গ্রহণ করলে তা মানবদেহের পক্ষে ক্ষতিকর হয়, সে দ্রব্য দ্বারা গুরুতর আহত করে অথবা কোনো পশু দ্বারা গুরুতর আঘাত করে, তবে উক্ত ব্যক্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে অথবা ১০ বছর পর্যন্ত যেকোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে এবং তদুপরি অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবে।  

এমআর/এসকেডি/জেএস