খাল উদ্ধারের পর সৌন্দর্য বাড়াতে চলছে কার্যক্রম/ ফাইল ছবি

ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব (খাল ও ড্রেনেজ) আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে দুই সিটি করপোরেশনকে হস্তান্তরের তিন মাসও হয়নি। কিন্তু এরই মধ্যে খালগুলোকে কেন্দ্র করে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন অনেক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, সে অনুযায়ী কাজও চলমান রেখেছে সংস্থা দুটি। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ঢাকার খালগুলোর দিকেই বেশি নজর দিয়েছে দুই সিটি কর্তৃপক্ষ। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাভুক্ত খাল দখলমুক্ত করে ঢেলে সাজানোর কাজ শুরু হয়েছে। প্রথমে এসব খালে স্বচ্ছ পানির প্রবাহ ফিরিয়ে আনা হবে। পরে সৌন্দর্য বাড়ানোর মাধ্যমে আনা হবে নান্দনিকতা।

পরিকল্পনা অনুযায়ী, খালের কাঙ্ক্ষিত কাজগুলো বাস্তবায়ন করা গেলে বর্ষাকালে সামান্য বৃষ্টিতেই আর ডুবে যাবে না রাজধানী ঢাকা। মুষলধারে বৃষ্টি হলেও কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পানি খাল ও ড্রেন দিয়ে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ, বালু নদীতে নেমে যাবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

জলাবদ্ধতা নিরসনের অংশ হিসেবে ঢাকা ওয়াসা শহরের খালগুলো এবং প্রায় ৩৮৫ কিলোমিটারের নালা ও চারটি পাম্পস্টেশন এতদিন রক্ষণাবেক্ষণ করে আসছিল। এছাড়া দুই সিটি করপোরেশন দেখভাল করত প্রায় ২ হাজার ২১১ কিলোমিটার নালা। গত ৩১ ডিসেম্বর থেকে ওয়াসার দায়িত্বে থাকা সব নালা ও খাল দুই সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। জানা গেছে, ঢাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের হাতে ছিল। এরপর পৌরসভা এ দায়িত্ব পালন করত। ১৯৮৮ সালে এটি ঢাকা ওয়াসাকে হস্তান্তর করা হয়।

জানা গেছে, খালের দায়িত্ব পাওয়ার পর খাল ও নালার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সরকারের কাছে ২৬১ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছে দুই সিটি করপোরেশন। আগে খাল রক্ষণাবেক্ষণে ঢাকা ওয়াসার নিজস্ব বরাদ্দ ছিল না। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে ওয়াসা এ খাতে বছরে ৪০ থেকে ৬০ কোটি টাকা পেত।

ডিএসসিসির খাল দৃষ্টিনন্দন করতে ৯৮১ কোটি টাকার প্রকল্প 
রাজধানীর চারটি খাল উদ্ধার করে সেগুলোকে দৃষ্টিনন্দন করে গড়ে তুলতে ৯৮১ কোটি টাকার প্রকল্প নিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। ডিএসসিসির কালুনগর, জিরানি, মান্ডা ও শ্যামপুর খালের জন্য প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়েছে। এই খালগুলো উদ্ধার করে দুই পাড়ে বানানো হবে ওয়াকওয়ে, থাকবে বাইসাইকেল লেন, মাছ ধরার শেড, বাগান, ফোয়ারা, ফুটওভার ব্রিজ, ইকোপার্ক, পাবলিক টয়লেট, খেলার মাঠসহ আরও নানা আয়োজন। এছাড়া ধোলাইখাল বক্স কালভার্ট, পান্থপথ বক্স কালভার্ট ও সেগুনবাগিচা বক্স কালভার্ট পরিষ্কারে ৩০ কোটি টাকার আরেকটি প্রকল্প নিতে যাচ্ছে ডিএসসিসি।

বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেলের হারানো ঐতিহ্য ফেরাতে উদ্যোগ
বুড়িগঙ্গা নদীর আদি চ্যানেলের হারানো ঐতিহ্য ফেরাতে উদ্যোগ নিয়েছে ডিএসসিসি। উদ্যোগটির মাধ্যমে বুড়িগঙ্গা আদি চ্যানেল খনন, অবকাঠামো উন্নয়ন করার পরিকল্পনা করেছে দক্ষিণ সিটি কর্তৃপক্ষ। প্রায় সাড়ে সাত কিলোমিটার দীর্ঘ এই চ্যানেল পুনরুদ্ধার করলে ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা অনেকাংশেই কমে যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। রাজধানীর লালবাগ, কামরাঙ্গীরচর, হাজারীবাগ এলাকার বিভিন্ন মৌজা ঘিরে বুড়িগঙ্গা নদীর আদি চ্যানেলের হারানো ঐতিহ্য ফেরাতে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা।

খালের রূপ বদলে দিতে ডিএনসিসির কার্যক্রম
খাল উদ্ধার করে এর পানি প্রবাহ ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি নান্দনিকতায় খালের রূপ বদলে দিতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। সেই অনুযায়ী কাজ করছে সংস্থাটি। জানা গেছে সাগুফতা খাল, রামচন্দ্রপুর খাল, ইব্রাহিমপুর খাল, গোদাগাড়ি খাল, রূপনগর খালসহ ১৪টি খাল থেকে প্রথম দুই মাসে ৯ হাজার ৩০০ টন বর্জ্য অপসারণ করেছে ডিএনসিসি। চারটি নদীর সঙ্গে এসবের সংযোগ স্থাপন করতে চায় ডিএনসিসি। এছাড়া হাতিরঝিল থেকে কালাচাঁদপুর, বনানী কবরস্থান, কড়াইল বস্তিতে যেন নৌপথে যাওয়া যায় সেই ব্যবস্থার পাশাপাশি কয়েকটি ব্রিজ উঁচু করার জন্য একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে তারা। প্রকল্পটি স্থানীয় সরকার বিভাগে প্রক্রিয়াধীন আছে বলে জানা গেছে।

অন্যদিকে জলাবদ্ধতা নিরসনে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনে ঢাকা ওয়াসা থেকে দুই সিটি করপোরেশনকে দায়িত্ব দেওয়ার পর উত্তর সিটি করপোরেশনের অধিক্ষেত্রভুক্ত খাল, কালভার্ট, স্টম ওয়াটার ড্রেন ব্যবস্থাপনা ও পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম পরিচালনায় বিভিন্ন কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি সমন্বয় সেল গঠন করেছে ডিএনসিসি।

ডিএনসিসির সচিব রবীন্দ্র শ্রী বড়ুয়া জানিয়েছেন, উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তাকে সমন্বয় সেল কমিটির সভাপতি এবং অতিরিক্ত প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তাকে সদস্য সচিব করে এই সমন্বয় সেল গঠন করা হয়। সমন্বয় সেলের অন্য সদস্যরা হলেন- উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী, মহাব্যবস্থাপক (পরিবহন), তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (পুর), তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (যান্ত্রিক), নগর পরিকল্পনাবিদ, সম্পত্তি কর্মকর্তা, নির্বাহী প্রকৌশলী পরিবেশ, জলবায়ু ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সার্কেল এবং নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।

খালকে ভিন্ন রূপ দিতে তিন ধাপে কাজ করবে ডিএনসিসি
খাল দখলমুক্ত ও সীমানা নির্ধারণ করে সৌন্দর্য বর্ধনে তিন ধাপে কাজ করবে ডিএনসিসি। সেক্ষেত্রে স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি- এই তিনটি ধাপে কাজ করা হবে। প্রথম ধাপে খাল দখলমুক্ত করে বর্জ্য অপসারণ করার পর পানির প্রবাহ ফেরানো হবে। এরপর খালের পাড়ে গাছ লাগানো, ওয়াকওয়ে ও সাইকেল লেনের কাজ দুই ধাপের মাধ্যমে করবে সংস্থাটি। কাগজে-কলমে ডিএনসিসি এলাকার মধ্যে ২৬টি খাল রয়েছে। এই খালগুলোর দুই পাড়ের সীমানা নির্ধারণ করা এবং অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে খালের জায়গাগুলো উন্মুক্ত করতে প্রথমে কাজ করছে উত্তর সিটি কর্তৃপক্ষ।

এছাড়া বাণিজ্যিক ভবন ও অন্যান্য স্থাপনায় সেপটিক ট্যাংক বসানো বাধ্যতামূলক করছে উত্তর সিটি করপোরেশন। আগামী ৩১ মার্চের মধ্যে নিজ উদ্যোগে ভবন মালিকদের সেপটিক ট্যাংক বসানোর কাজ শেষ করতে হবে। সময়সীমার মধ্যে সেপটিক ট্যাংক স্থাপন করা না হলে ১ এপ্রিল থেকে অভিযান পরিচালনা করা হবে বলে জানিয়েছেন ডিএনসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা এ এস এম মামুন।

খাল নিয়ে ঢাকার দুই মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস এবং আতিকুল ইসলাম ইতোমধ্যে শক্ত নির্দেশনা দিয়ে বলেছেন, যতই প্রভাবশালী হোক না কেন, কেউ খালের জায়গা দখলে রাখতে পারবে না। খালগুলোর সীমানা চিহ্নিত করে খালের পাড় থেকে অবৈধ সব স্থাপনা উচ্ছেদ করা হবে। পরে পাড় বাঁধাই, সবুজায়ন ও ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হবে। তারা বলেছেন, অনেক সময় দেখা যায় অবৈধ দখল উচ্ছেদের পর পুনরায় দখল হয়ে যায়। তাই কোথাও উচ্ছেদ অভিযানের পর আবার দখল হচ্ছে কি না সে বিষয়ে নজর রাখতে শক্ত নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

দুই সিটি করপোরেশনের খাল উদ্ধারের তৎপরতা নিয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাধারণ সম্পাদক ও নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, সিটি করপোরেশনের খাল ও বক্স কালভার্টগুলো থেকে বর্জ্য অপসারণ একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। সিটি করপোরেশনকে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও অনমনীয় দৃঢ়তার সঙ্গে খালগুলোকে দখল ও দূষণমুক্ত করতে হবে। ঢাকাকে জলজটমুক্ত রাখতে আন্তঃসংযোগ বৃদ্ধি কিংবা খালের কার্যকারিতা বৃদ্ধির পাশাপাশি জলাশয়, জলাভূমি, প্লাবন ভূমি ও বন্যা প্রবাহ এলাকা সংরক্ষণ করতে হবে। এছাড়া পুকুরগুলোকে জলাধার হিসেবে চিহ্নিত ও সংরক্ষণ করা, প্রকল্প প্রণয়নের সময় খাল ও জলাধার ভরাট করে কৃত্রিম ড্রেনেজ ব্যবস্থাকে নিরুৎসাহিত করে প্রকৃতিভিত্তিক নগর পরিকল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে।

ড. আদিল আরও বলেন, খাল-জলাশয় দূষণ পরিবেশ ও প্রতিবেশের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। খালকে দূষণমুক্ত রাখতে খালের সঙ্গে সংযুক্ত বসতবাড়ির পয়ঃবর্জ্যের এবং শিল্প কারখানার বর্জ্যের সংযোগ বন্ধ করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া ঢাকার খাল ও জলাশয়কে সুনির্দিষ্ট নেটওয়ার্কের মধ্যে আনতে যেসব খাল সিটি করপোরেশনের আওতার বাইরে রয়েছে সেগুলোকেও সিটি করপোরেশনের হাতে ন্যস্ত করা জরুরি। জলাশয়কে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে খাল ও জলাশয়কেন্দ্রিক নগর পরিকল্পনার ধারণাকে সন্নিবেশিত করে মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে, যেখানে জলাশয়কেন্দ্রিক গণপরিসর, হাটার স্থান, সবুজায়নের মাধ্যমে জনগণের অংশীদারিত্ব বাড়ানোর মাধ্যমে খালগুলোকে দখল ও দূষণ প্রতিরোধ সম্ভব হবে।

এএসএস/এসএসএইচ