এক সময়ের সেই ছিটবাসীরা এখন রাস্তা, ব্রিজ, স্কুল, হাসপাতাল পেয়েছেন।

৬৮ বছর তাদের কোনো রাষ্ট্র ছিল না, কোনো পরিচয় ছিল না, ছিল না নাগরিক কোনো সুবিধা নেওয়ার সুযোগ। ছিটবাসী নামেই তারা পরিচিত হয়েছিলেন। ২০১৫ সালের ৩১ জুলাইয়ের পর সেই ছিটবাসীদের ভাগ্য পরিবর্তন হয়েছে। এক সময়ের সেই ছিটবাসীরা এখন রাস্তা, ব্রিজ, স্কুল, হাসপাতাল পেয়েছেন। সন্তানরা সরকারি চাকরি করবে- সেই স্বপ্নও দেখছেন তারা। 

বাংলাদেশের মধ্যে ভারতের যে ১১১টি ছিটমহল ছিল তার একটি পঞ্চগড়ের গারাতি ছিটমহল। বিলুপ্ত এ ছিটমহলের বর্তমান নাম রাজমহল। এখন এই রাজমহলেই থাকেন একসময়ের ছিটবাসী জমির উদ্দিন। তার চার ছেলে। এই চার ছেলের তিন ছেলে শিক্ষার কোনো সুযোগ পাননি। কিন্তু ছিটমহল বিনিময়ের পর শিক্ষার সুযোগ পেয়েছেন তার ছোট ছেলে জাকির হোসেন। আর জমির উদ্দিনের স্বপ্ন তার এই ছেলে একদিন সরকারি চাকরি পাবে। 

জমির উদ্দিনের মতো এমন স্বপ্ন দেখছেন রাজমহলের বহু মানুষ।  

জাকিরকে নিয়ে জমির উদ্দিনের চোখে রঙিন স্বপ্ন থাকলেও বাকি তিন ছেলের জন্য আক্ষেপ রয়েছে। কারণ, চার ছেলের তিন ছেলে লেখাপড়ার সুযোগ পাননি। 

জমির উদ্দিনের এক ছেলে রবিউল ইসলাম বলেন, আগে তো পড়ালেখা হতো না। ছিটমহলের ছেলে-মেয়েদের বই দেওয়া হতো না। পড়ালেখা করতে পারলে অনেক কিছু করতে পারতাম। 

তবে বর্তমান নিয়ে সন্তুষ্ট জমির উদ্দিন। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, আগে দিন অনেক খারাপ যেত। আমরা কোনো নাগরিক সুযোগ-সুবিধা পাইনি। বাংলাদেশের সরকারের কোনো অনুদান পাইনি। এখন আমরা অনেক শান্তিতে আছি। সরকারের সকল সুবিধা পাচ্ছি, ভোটারও হয়েছি। আগে অসুস্থ হলে কোথাও যাওয়া যেত না। এখন ঢাকাতে গিয়েও চিকিৎসা করাতে পারি। 

এখন পড়ালেখারও সুযোগ পাচ্ছেন বিলুপ্ত ছিটমহলের ছেলেমেয়েরা

বিলুপ্ত ছিটমহলের আরেক বাসিন্দা মোখলেছুর রহমান বলেন, আমাদের জীবনে কিছু করার আর সুযোগ নেই, তবে আমাদের সন্তানরা বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে সরকারি চাকরি পাবে, সেই স্বপ্ন বুনছি। 

মোখলেছুর আরও বলেন, আমার ছেলে মমিন রাজমহল উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ে। শেখ হাসিনা আমাদের নাগরিকের অধিকার দিয়েছে, তার কারণে আমরা সন্তানদের নিয়ে স্বপ্ন দেখতে পারছি। আমরা দীর্ঘদিন দাবি করেছিলাম। কিন্তু কোনো সরকার এগিয়ে আসেনি। বঙ্গবন্ধু কন্যা আমাদের দুঃখ অনুধাবন করে ছিটমহল থেকে আমাদের মুক্তি দিয়েছেন। তার প্রচেষ্টায় আমরা ছিটমহলের বেড়াজাল থেকে মুক্ত।

২০১৫ সালের ৩১ জুলাই মধ্যরাতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ছিটমহল বিনিময় চুক্তি কার্যকর হয়। ঐতিহাসিক দিনটিতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ভারতীয় ১১১টি ছিটমহল বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত হয়। এতে বাংলাদেশি ভূখণ্ডে যোগ হয় ১৭ হাজার ১৬০ দশমিক ৬৩ একর জমি। ৬৮ বছরের অবরুদ্ধ জীবন থেকে মুক্তি ঘটে লাখো মানুষের।  

ছিটমহলগুলোর অবস্থান ছিল পঞ্চগড়, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও নীলফামারী জেলায়। এর মধ্যে পঞ্চগড়ে পড়েছিল ৩৬টি ছিটমহল। ৩৬টি
ছিটমহলের ১১,৯৩২.৭৮ একর জমিতে মোট জনসংখ্যা ছিল ১৯ হাজার ২৪৩ জন। 

ছিটমহল বিনিময়ের পর ইতোমধ্যে পঞ্চগড় জেলার সাবেক ছিটমহলগুলোতে ৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১৩টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ৩টি মহাবিদ্যালয় ও ১টি মাদরাসা স্থাপন করা হয়েছে। ৫টি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করা হয়েছে। ৬৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ১০২ কি.মি. পাকা রাস্তা, ১১ কোটি ৭২ লাখ টাকা ব্যয়ে ১০টি ব্রিজ-কালভার্ট এবং ১১টি মসজিদ, ৪টি মন্দির, ৫টি বাজার, ১টি কবরস্থান এবং ২টি নদীর ঘাটলা নির্মাণ করা হয়েছে। 

জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের তথ্য মতে, পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি কর্তৃক ২৩৮ কি.মি. বৈদ্যুতিক লাইন স্থাপন এবং ৮০০০ গ্রাহককে বিদ্যুৎ সংযোগ প্রদান করা হয়েছে এবং ৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ভাউলাগঞ্জে  একটি সাব স্টেশন নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। পঞ্চগড় সদর উপজেলার বিলুপ্ত গাড়াতি ছিটমহলে অত্যাধুনিক ডিজিটাল সার্ভিস ইমপ্লয়মেন্ট এন্ড ট্রেইনিং (ডি-সেট) সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়াও ভূমিহীনদের পুনর্বাসনের লক্ষ্যে এ জেলার বিলুপ্ত ছিটমহলগুলোতে ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের মাঝে মোট ৩৪৯ টি ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে।

এমএসআই/এনএফ