গৃহকর্ত্রী সাথীর বাচ্চার খাবার খেয়ে ফেলায় রাজধানীর কলাবাগানে শিশু গৃহকর্মী হেনাকে (১০) নির্যাতন করে হত্যা করা হয়।

রোববার (৩ সেপ্টেম্বর) বেলা সাড়ে ১২ টায় ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান ডিএমপির রমনা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার আশরাফ হোসেন।

আশরাফ হোসেন বলেন, রাজধানীর কলাবাগানে শিশু গৃহকর্মী হেনা গৃহকর্ত্রী সাথীর বাচ্চার খাবার মাঝে মধ্যে খেয়ে ফেলতো। আর এর জন্য নির্যাতন করে শিশু গৃহকর্মী হেনাকে হত্যা করে গৃহকর্ত্রী মোছা. সাথী পারভীন ডলি। 

আরও পড়ুন- নির্যাতনে গৃহকর্মীর মৃত্যু : গ্রেপ্তার গৃহকর্ত্রীকে আনা হলো ঢাকায়

তিনি জানান, শিশুটির মৃত্যুর পর মোবাইল ফোন রেখে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ঘুরাফেরা করতে থাকে গৃহকর্ত্রী সাথী। পরে একসময় যশোরে চলে যায় সাথী।

আরও পড়ুন- কলাবাগানে শিশু গৃহকর্মী হেনা হত্যার ঘটনায় দোষীদের শাস্তির দাবি

পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, গত ২৬ আগস্ট সকালে রাজধানীর কলাবাগানের একটি বাসার দরজা ভেঙে বিছানায় একটি কাজের মেয়ে লাশ দেখতে পায়। পরে লাশটি শনাক্ত করে জানা যায়- এটি একটি এতিম শিশু ও গৃহকর্মী মোছা. হেনা। সে মোছা. সাথী পারভীন ডলির বাসায় কাজ করতো। ২০১৯ সাল থেকে সাথী ওই বাসায় থাকেন। ২০২০ সালে হেনাকে নিয়ে এসে কাজের মেয়ে হিসেবে রাখা হয়। তার শরীরে অনেক নতুন ও পুরনো আঘাতের চিহ্ন, মুখে ফেনা, শরীর ফোলা দেখতে পায়।

বাসার সিসি ফুটেজ থেকে আমরা আরও দেখতে পাই- এই শিশুটির গলায় পা দিয়ে গৃহকর্ত্রী হেনা তাকে নির্যাতন করছে। সাথী ঘটনার পরপর তার বাচ্চা নিয়ে বাসা থেকে বেরিয়েছে। বাসা থেকে আমরা তিনটি মোবাইল ফোন জব্দ করি, যা সাথী ব্যবহার করতো।

তিনি বলেন, কলাবাগান থানা পুলিশসহ পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট এটা নিয়ে কাজ করেছেন। ঘটনার চারদিনের মাথায় আমরা আসামিকে গ্রেপ্তার করি। কলাবাগান থানা পুলিশ বিভিন্ন স্থানের ৪০০ সিসি ফুটেজ সংগ্রহ করে। কারণ, আসামি তার মোবাইল ফোন রেখে গিয়েছিল। ফলে গতানুগতিক ধারায় আমাদের তদন্ত করতে হয়েছে। সিসি ফুটেজে তাকে বিভিন্ন স্থানে পথচারী হিসেবে ঘুরতে দেখা যায়। কখনো মুদির দোকানে বা বিভিন্ন মানুষের ফোন থেকে তার আত্মীয়স্বজনকে ফোন করে সে পালিয়ে থাকার চেষ্টা করে। একপর্যায়ে আমরা সংবাদ পাই সে যশোরে আছে। পরে কলাবাগান থানা পুলিশ সেখান থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে এ পুলিশ কর্মকর্তা জানান, দা-বটি দিয়ে শিশুটিকে নির্যাতন করে সাথী। কখনো লাঠি দিয়ে নির্যাতন করেছে। হেনার অপরাধ হলো- তার বাচ্চার জন্য রাখা খাবার খেয়ে ফেলতো। তার বাচ্চার খেলার সাথী হিসেবে একজন আরেকজনকে মারে এমন ছোটখাটো বিষয়ে এই হত্যাকারী তাকে নির্যাতন করে। এই নির্যাতনের ফলে বাচ্চাটি মৃত্যুবরণ করে। বাচ্চাটি বিছানায় মল ত্যাগ পর্যন্ত করে ফেলে।

আসামির বিষয়ে তিনি বলেন, অভিযুক্ত এলজিইডি মন্ত্রণালয়ের একজন সার্ভেয়ার। তবে, ২০০৩ সালে তিনি প্রথমে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে যোগ দেয়। পরে ডিপ্লোমা করে ২০১১ সালে সার্ভেয়ার হিসেবে চাকরি পায়। ২০১৬ সালে বিএসসি করে নিজেকে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে পরিচিত দেয়। তার রাজনৈতিক কী পরিচয়, সেগুলো আমরা বিবেচনায় আনতে চাই না। আমরা তাকে শুধু একজন আসামি হিসেবেই দেখছি।

তিনি বলেন, তার দ্বিতীয় স্বামী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ডাক্তার ছিলেন। ২০২০ সালে তাদের মধ্যে ডিভোর্স হয়। আর তার প্রথম স্বামী ছিল একজন ড্রাইভার। এলজিইডিতে চাকরি করা অবস্থায় তার সঙ্গে বিয়ে হয়। পরে সার্ভেয়ার হিসেবে চাকরি হলে তাকে ডিভোর্স দেয়। ১২ বছর তার স্বামী ছিল না। ২০১৯ সালে এসে দ্বিতীয় স্বামীর সঙ্গে বিয়ে হয়। এসময় তাদের দুটি জমজ বাচ্চার জন্ম হয়। একটি বাচ্চা মারা যায় আরেকটি বাচ্চা জীবিত রয়েছে। সেই বাচ্চাকে লালনপালন করার জন্যই হেনাকে আনা হয়। 

জানা যায়, হেনা ময়মনসিংহ মুক্তগাছা উপজেলা নন্দীবাড়ি গ্রামের মৃত হক মিয়া ও মৃত হাসিনা বেগমের মেয়ে। তিন বছর আগে গৃহকর্ত্রী সাথী আক্তার পারভীন ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায় একটি ট্রেনিংয়ে যান। সেখানে হেনাকে দেখেন। তখন তার স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে তাকে ঢাকায় নিয়ে আসেন সাথী আক্তার। সেসময় হেনার স্বজনদের গৃহকর্ত্রী সাথী বলেছিলেন- হেনাকে তার নিজের সন্তানের মতো করে রাখবেন।

এরপর মাস শেষে ২ হাজার টাকা করে হেনার ফুফুর কাছে পাঠাবেন। চার মাস এভাবে টাকা পাঠালেও এরপর থেকে আর কোনো টাকা পাঠাননি। হেনার জন্য টাকা আলাদাভাবে জমিয়ে রাখছেন বলে তখন তাদেরকে জানান। গত ২৬ আগস্ট দুপুরে কলাবাগানের ভূতের গলির একটি বাসা থেকে শিশু গৃহকর্মী হেনার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। লাশের সুরতহাল দেখে ধারণা করা হয়- তাকে নির্মমভাবে নির্যাতন ও শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে।

এ ঘটনায় কলাবাগান থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করে পুলিশ। এতে সাথী আক্তার পারভীনকে আসামি করা হয়েছে।

এমএসি/এমজে