জাতীয় পর্যায়ে আত্মহত্যাজনিত মৃত্যুর সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ২০১১ সালে আত্মহত্যার গড় হারে বাংলাদেশ ছিল বিশ্বে ৩৮তম। কিন্তু মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে ২০১৪ সালে বাংলাদেশ উঠে এসেছে ১০তম স্থানে। 

গবেষণায় দেখা গেছে, এখন বিশ্বে আত্মহত্যায় মৃত্যুহার প্রতি লাখে ১৬ জন। যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণাপত্রের তথ্য মতে, বাংলাদেশে এটি ৩৯.৬ শতাংশ, অর্থাৎ দ্বিগুণেরও বেশি।

ঢাকা আহছানিয়া মিশন ২০২১ সাল থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে নারী মাদকাসক্তি চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে আসা নারীদের তথ্য সংগ্রহে কাজ করেছে। ২০১১ সাল থেকে ২০২৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত সেবাগ্রহণকারী নারীদের তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, ৩২২ জন সেবাগ্রহণকারী নারীর মধ্যে ১৭৭ জনের আত্মহত্যার ভাবনা ছিল। ৯৮ জন কখনো না কখনো আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে এবং পাঁচ জন চিকিৎসা নেওয়ার পরও আত্মহত্যায় জীবনের সমাপ্তি টেনেছেন। ১৭৭ জন আত্মহত্যাপ্রবণ রোগীদের মধ্যে ১২২ জন মাদকাসক্ত ছিলেন। তাদের মধ্যে ১৬৩ জনের বয়স ১৫-২৯ বছরের মধ্যে। ৭৪ জন আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তির অন্তত একটি মানসিক রোগ ছিল।

বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষ্যে ‘আত্মহত্যা প্রতিরোধে সচেতনতা, মাদকনির্ভরশীল ব্যক্তি এবং আত্মহত্যার উচ্চঝুঁকি’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরেছে ঢাকা আহছানিয়া মিশন। শনিবার (৯ সেপ্টেম্বর) বেলা ১১টায় রাজধানীর শ্যামলীতে ঢাকা আহছানিয়া মিশন স্বাস্থ্য সেবা সেক্টরের সভাকক্ষে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।

১০ সেপ্টেম্বর সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস পালিত হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, আত্মহত্যা প্রবণতার ক্ষেত্রে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দশম। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘কর্মের মাধ্যমে আশা তৈরি করো’।

দিবসটি উপলক্ষ্যে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা আহছানিয়া মিশন নারী মাদকাসক্তি চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের কাউন্সিলর জান্নাতুল ফেরদৌস মজুমদার লিখিত বক্তব্যে বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে- নারী মাদকাসক্তরা পুরুষ মাদকাসক্তদের তুলনায় মানসিকভাবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ কারণে নারীরাই আত্মহত্যার জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে থাকে। ঝুঁকিপ্রবণ জনগোষ্ঠী হিসেবে মাদকগ্রহণকারীরা আত্মহত্যা প্রবণতার উচ্চঝুঁকির মধ্যে আছে। এর কারণ নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত মাদকগ্রহণ সংশ্লিষ্ট সংকট, বিষণ্নতা, অতিমাত্রায় মাদক গ্রহণের কারণে সিদ্ধান্তহীনতা বা সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে না পারা, চিকিৎসার পরও মাদকমুক্ত থাকতে ব্যর্থ হওয়া, পরিবারের অসহযোগিতা ও সন্দেহ এবং মাদকাসক্তির কারণে অন্যান্য মানসিক সমস্যা। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সাধারণ জনগণের তুলনায় অ্যালকোহল ব্যবহারকারীরা ১০ গুণ বেশি আত্মহত্যার ঝুঁকির মধ্যে এবং যারা শিরায় নেশাদ্রব্য গ্রহণ করে তারা ১৪ গুণ বেশি আত্মহত্যার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

বর্তমানে দেশের মাদক ব্যবহারের ধরন পরিবর্তন হয়েছে এবং ইয়াবার সহজলভ্যতার কারণে এর ব্যবহার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ইয়াবা উত্তেজক মাদক হিসেবে পরিচিত, যা স্কুলকলেজ পড়ুয়া তরুণ-তরুণীরা বেশি ব্যবহার করছে।

গবেষণায় উঠে আসা তথ্য তুলে ধরে জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, দীর্ঘদিন ইয়াবা ব্যবহারে ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতা রোগ দেখা দেয়। এ বিষণ্নতার কারণেও ইয়াবা আসক্তদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা অনেক বেশি থাকে। আত্মহত্যা প্রবণতার সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্য ও মানসিক রোগের যোগাযোগ নিবিড়। বর্তমান বিশ্বে আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট ও বিশ্বায়নের কারণে উন্নয়ন ও অবক্ষয় সমান্তরালে চলছে। ফলে মানসিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, ৯০ শতাংশ আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তির কমপক্ষে একটি মানসিক রোগ থাকে, সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে ডিপ্রেশন। অনেক ক্ষেত্রেই মাদকাসক্ত ব্যক্তির মধ্যে কিছু মানসিক সমস্যা লক্ষ্য করা যায়। আবার মাদকাসক্তি ছাড়াও মানসিক রোগের লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়। এ ধরনের রোগ এবং মানসিক অস্থিরতা আত্মহত্যার একটি বড় কারণ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, সাত লাখেরও বেশি মানুষ প্রতি বছর আত্মহত্যা করে মারা যাচ্ছে। ১৫-২৯ বছর বয়সীদের মৃত্যুর চতুর্থ প্রধান কারণ হলো আত্মহত্যা। বিশ্বের মোট আত্মহত্যার ৬০ শতাংশ হয় এশিয়াতে। বিশ্বব্যাপী দেখা গেছে, দুইভাবে মানুষ আত্মহত্যা করে থাকে- এক, আবেগপ্রবণ হয়ে এবং দ্বিতীয়ত, পরিকল্পনা করে। বাংলাদেশসহ এশিয়ার দেশগুলোতে বেশি আত্মহত্যা হয় আবেগপ্রবণ হয়ে।

সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও আত্মহত্যা একটি জটিল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশে জাতীয় পর্যায়ে আত্মহত্যাজনিত মৃত্যুর সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণাপত্রের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে ৩২ জন মানুষ আত্মহত্যা করে থাকেন। করোনার সময় ১৪ হাজার আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে এবং ২০২২ সালে ৩৬৪ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে।

বাংলাদেশে আত্মহত্যার কারণগুলো হচ্ছে- শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন, শারীরিক এবং মানসিক অসুস্থতা, পারিবারিক কলহ এবং সম্পর্কের বিচ্ছেদ, মাদকের ব্যবহার, অর্থনৈতিক সমস্যা, পড়াশোনার চাপ, বেকারত্ব, পারিবারিক আত্মহত্যার ইতিহাস ইত্যাদি।

আত্মহত্যার ঝুঁকির লক্ষণগুলো হচ্ছে- মৌখিক হুমকি, ঘন ঘন মৃত্যু সংক্রান্ত ইচ্ছার কথা বলা, যখন দেখছেন আপনার সন্তান বা কাছের মানুষটি হঠাৎ করেই চুপচাপ হয়ে যাচ্ছে, তার চেহারা, স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে উদাসীন বা ওজন খুব দ্রুত বাড়ছে বা কমছে, ফেসবুক বা সোশ্যাল মিডিয়াতে মৃত্যু নিয়ে বেশি পোস্ট বা ঘটনা দিচ্ছে, শরীরে অপ্রত্যাশিত আঘাতের চিহ্ন ইত্যাদি।

সংবাদ সম্মেলনে কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি চিকিৎসা কেন্দ্রের মনোচিকিৎসক বিশেষজ্ঞ ডা. রাহেনুল ইসলাম বলেন, সহানুভূতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা আত্মহত্যা করায় কোনো ব্যক্তির নিজের আগ্রহকে যতটা সহজ করে তুলে ধরি, পারিপার্শ্বিক অবস্থা, প্রভাব ও অন্যান্য কারণ বিবেচনা কমই করি।

তিনি বলেন, আত্মহত্যা হিরোইজমের ব্যাপার নয়, এটা প্রতিরোধ যোগ্য। চোখ যা দেখে না, মন তা দেখে ও বোঝে। আমাদের বুঝতে হবে। আর মাদককে বৈধতা দিলেই মাদক বৈধ হয়ে যায় না। অথচ আত্মহত্যার নেপথ্যে বড় একটি কারণ মাদকাসক্তি।

প্রতিষ্ঠানটির সিনিয়র সাইকোলজিস্ট রাখী গাঙ্গুলী বলেন, বৈশ্বিকভাবে মৃত্যুর নেপথ্যে ১০ কারণের মধ্যে আত্মহত্যা একটি। প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন করে আত্মহত্যা করছেন। আত্মহত্যা প্রতিরোধে আশার সঞ্চারণ ঘটাতে হবে। আশাই আত্মহত্যা বিমুখ করতে।

সংবাদ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা আহ্‌ছানিয়া মিশন স্বাস্থ্য সেক্টরের পরিচালক ইকবাল মাসুদ।

জেইউ/এসএম/এসএসএইচ/