বাংলাদেশের সড়ক পথচারীদের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বলে মন্তব্য করে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) এর চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বলেছেন, প্রায় প্রতিদিনই পথচারীরা রোডক্র্যাশের শিকার হচ্ছেন। এতে প্রাণ হারাচ্ছে সাধারণ পথচারী, যানবাহনের যাত্রী এবং কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশ। পরিবহনের পাশাপাশি পথচারী পারাপার ও তাদের নিরাপদে চলাচল সড়ক নিরাপত্তার অন্যতম একটি অংশ যা আমাদের বর্তমান আইন বা নীতিকাঠামোতে উদ্বেগজনকভাবে অনুপস্থিত।

শনিবার (২৩ সেপ্টেম্বর) জাতীয় প্রেস ক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে নতুন সড়ক নিরাপত্তা আইনের দাবিতে রোড সেইফটি কোয়ালিশন বাংলাদেশ আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা তিনি।

ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, সড়ক নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট উল্লিখিত বিষয়গুলোকে আমলে নিয়ে প্রয়োজন একটি নতুন আইন, যার মূল কেন্দ্রে থাকবে মানুষের জীবনের নিরাপত্তা। এই আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সড়কে শৃঙ্খলা বজায় রাখা ও মৃত্যুর হার কমিয়ে আনার জন্য রোড সেফটি কোয়ালিশন বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছে। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, আচরণগত পাঁচটি মূল ঝুঁকির (অতিরিক্ত গতি, মানসম্মত হেলমেট ব্যবহার না করা, সিটবেল্ট ব্যবহার না করা, মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানো, শিশুদের জন্য নিরাপদ আসনের অনুপস্থিতি) বিষয়গুলোকে বিবেচনায় রেখে সার্বিকভাবে সেইফ সিস্টেম এপ্রোচের আলোকে যথাযথ আইন ও নীতিমালা প্রণীত এবং বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের সড়ক অধিকতর নিরাপদ হবে। এসব পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন বাংলাদেশকে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে যাবে।

রোডক্র্যাশের বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরে লিখিত বক্তব্যে ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, বাংলাদেশে রোডক্র্যাশে প্রতি বছর প্রাণহানি হয় আনুমানিক ২৫ হাজার মানুষের। অবকাঠামোগত উন্নয়নের পরেও রোডক্র্যাশের সার্বিক হার কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। যা আমাদের জন্য উদ্বেগজনক। অথচ এই সব অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু প্রতিরোধযোগ্য। কিন্তু এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টরা কতটা আন্তরিক তা প্রশ্ন থেকে যায়।

তিনি বলেন, নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করার জন্য উন্নত দেশগুলো সেইফ সিস্টেম এপ্রোচের (মাল্টিমডাল ট্রান্সপোর্টেশন, নিরাপদ সড়ক, নিরাপদ যানবাহন, নিরাপদ সড়ক ব্যবহারকারী ও রোডক্র্যাশ পরবর্তী ব্যবস্থাপনা) আলোকে নিজেদের আইনি ও নীতি কাঠামো প্রণয়ন ও এর যথাযথ বাস্তবায়নে সুফল পেয়েছে। সেইফ সিস্টেম এপ্রোচের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো, মানুষ বা সড়ক ব্যবহারকারী ভুল করলেও সড়ক ব্যবস্থাপনা এমন হবে যার ফলে মানুষকে তার ভুলের সর্বোচ্চ মাসুল অর্থাৎ মৃত্যু বা পঙ্গুত্বের শিকার যেন হতে না হয়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, আমাদের বর্তমান আইনি ও নীতি কাঠামোতে এই দর্শন সম্পূর্ণরূপে অনুপস্থিত। তবে আশার কথা হলো, বিশ্ব ব্যাংকের সহযোগিতায় গৃহীত বাংলাদেশ রোড সেইফটি প্রকল্পে সেইফ সিস্টেম এপ্রোচের কিছু ব্যবহার শুরু হয়েছে। আমরা এই বিজ্ঞানভিত্তিক প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানাই। পাশাপাশি, সেইফ সিস্টেম এপ্রোচের আলোকে নিরাপদ সড়কের জন্য আলাদা আইনি কাঠামোর জোর দাবি জানাই, যাতে সড়কে মানুষের জীবনের মৃত্যু ঝুঁকি কমে এবং জীবন হয় নিরাপদ।

নিসচার চেয়ারম্যান বলেন, আমাদের বর্তমান সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ এবং সড়ক পরিবহন বিধিমালা-২০২২ মূলত সড়কে পরিবহনের জন্য আইন এবং সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা সংক্রান্ত বিধিমালা। তাই পরিবহন ব্যবস্থাপনার জন্য তৈরি এই আইনে সাম্প্রতিক সংশোধনীর সময়ে গতি নিয়ন্ত্রণ, হেলমেট ও সিটবেল্ট ব্যবহারের মতো কিছু বিষয় সংযোজন করা হলেও তা সড়কে রোডক্র্যাশের কারণে মানুষের মৃত্যু ও বড় ধরনের আঘাত থেকে রক্ষার করার জন্য পর্যাপ্ত নয়। সুতরাং সড়কে সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সেইফ সিস্টেম এপ্রোচের আলোকে নিরাপদ সড়ক সংক্রান্ত আলাদা আইন প্রণয়ন ও এর যথাযথ বাস্তবায়নের কোন বিকল্প নেই।

তিনি আরও বলেন, নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করার দায়িত্ব শুধুমাত্র একটি মন্ত্রণালয় কিংবা একটি দপ্তরের নয়, এতে অনেকগুলো সরকারি দপ্তর ও মন্ত্রণালয়ের সক্রিয় অংশগ্রহণ দরকার। এরূপ ব্যবস্থাকে দক্ষভাবে কার্যকর করতে হলে আইনি কাঠামো দ্বারা স্বীকৃত আর্থিক ও কার্যগতভাবে স্বাধীন একটি সড়ক নিরাপত্তা সংক্রান্ত লীড এজেন্সি প্রতিষ্ঠা করা একান্ত প্রয়োজন। এছাড়াও রোডক্র্যাশ সংক্রান্ত তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহের বৈজ্ঞানিক ও স্বীকৃত কোনো পদ্ধতি বাংলাদেশে না থাকার কারণে প্রায়শই হতাহতের তথ্য ও সংখ্যা নিয়ে ভিন্নতা দেখা দেয়। এই বিষয়টিও গুরুত্বসহকারে আইনের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।

সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন রোড সেফটি কোয়ালিশন বাংলাদেশের সদস্য সংস্থা ব্র্যাকের সড়ক নিরাপত্তা কর্মসূচির প্রোগ্রাম ম্যানেজার এম খালিদ মাহমুদ, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের প্রকল্প পরিচালক (রোড সেফটি) ডা. মাহফুজুর রহমান ভূঁঞা, বাংলাদেশ এনজিওস নেটওয়ার্ক ফর রেডিও অ্যান্ড কমিউনিকেশনের (বিএনএনআরসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এএইচএম বজলুর রহমান, সিআইপিআরবির পরিচালক ডা. সেলিম মাহমুদ চৌধুরী, ঢাকা আহ্‌ছানিয়া মিশনের হেলথ সেক্টরের প্রকল্প সমন্বয়কারী শারমিন রহমান, ইমপ্রেসিভ কমিউনিকেশন লিমিটেডের (আইসিএল) ম্যানেজিং ডিরেক্টর খন্দকার হাসিবুজ্জামান, এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সহযোগী অধ্যাপক ড. সোহেল মাহমুদ, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক বজলুর রহমান প্রমুখ।

/এমএইচএন/এমএ