গত সপ্তাহে রাজধানীর মিরপুরে জমে থাকা বৃষ্টির পানিতে বিদ্যুতায়িত হয়ে চারজনের মৃত্যুর জন্য বিদ্যুতের চোরাই লাইন দায়ী বলে মনে করছে ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেড (ডেসকো)। সংস্থাটির তদন্তে উঠে এসেছে, চোরাই পথে নেওয়া বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগের দুর্বল পয়েন্ট থেকেই বিদ্যুতায়িত হয়ে প্রাণ যায় চার সাধারণ মানুষের।

মিরপুরে কমার্স কলেজ–সংলগ্ন ঝিলপাড় বস্তির সামনের সড়কের ওই ঘটনার পর তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে ডেসকো।  

ওই কমিটির তদন্তে উঠে এসেছে, ঝিলপাড় বস্তি এলাকায় তিনটি চোরাই লাইন নেওয়া হয়েছিল। যার ভোক্তার সংখ্যা ৪০০/৪৫০ জন। তবে সেখানে ৪০টির মতো বৈধ ডেসকোর মিটারও ছিল। সেখানে চোরাই লাইন যারা নিয়েছেন তাদের তিনজনকে শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে মামলা ও আইনানুগ পদক্ষেপ নেবে ডেসকো। 

• এক রাতেই এলোমেলো সব, অন্যকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেই হলেন লাশ

ডেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. কাওসার আমীর আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের ওই এলাকায় (মিরপুর) বিদ্যুতের লাইন সুসংগঠিতই ছিল। ২৫০-৩০০ জন ভোক্তা সেখানকার লাইনটা ব্যবহার করেন। তবে কেউ কেউ চোরাই লাইন নিয়েছিলেন। ডেসকোর দূরবর্তী একটি লাইন থেকে ছাদ বেয়ে মাদ্রাসা ও ফার্মেসির মাঝ দিয়ে প্লাস্টার ভেঙে ড্রেনের ভেতর দিয়ে রাস্তার এক পাশ থেকে আরেক পাশে চোরাই লাইন নেওয়া হয়েছিল।

তিনি আরও বলেন, গত ২১ সেপ্টেম্বর রাতে প্রচুর বৃষ্টি হয়। যেখানে চোরাই লাইন জোড়া লাগানো হয়েছিল, সেখানে হয়তো ইনসুলেশন ছিল। সেখানে বৃষ্টির পানি পৌঁছেছিল। সেখান দিয়ে যাওয়ার পথে কারও হয়তো পা পড়েছিল। এতেই একেক করে পাঁচজন বিদ্যুতায়াতি হন। এরমধ্যে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায় এক শিশু। তবে মর্মান্তিকভাবে মারা যায় চারজন।

কারা চোরাই লাইন নিয়েছিল তাদের শনাক্ত করা হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা স্পষ্ট যে চোরাই লাইন থেকেই সে রাতে মর্মান্তিক দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। আমরা অনেকের নাম পেয়েছি। তাদের মধ্যে আমরা তিনজনকে সনাক্ত করেছি। যদিও তদন্ত এখনও চলছে।

তিনি বলেন, তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন দাখিল করার পর প্রতিবেদনের ভিত্তিতে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

ঢাকা শহরে প্রচুর চোরাই বা অবৈধ বিদ্যুতের সংযোগ সচল বলে অভিযোগ রয়েছে। এরকমের অবৈধ সংযোগকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা ও সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার প্রক্রিয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, আপনাকে আমি বলতে পারি, প্রতি রাতে প্রচুর অবৈধ লাইন কাটি। কিন্তু কে বা কারা চোরাই লাইন নিচ্ছেন তা এলাকাবাসী বলেন না। যেখানে অবৈধ লাইন সচল পাই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

তিনি অভিযোগ করে বলেন, আমরা যে দামে বা খরচায় বিদ্যুত সরবরাহ করি তার চেয়ে বেশি দামেই কিন্তু চোরাই লাইন ব্যবহার করা হয়। 

ঝিলপাড় বস্তিতে অনেকেই অবৈধ লাইন ব্যবহার করছিলেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেখানে আমাদের সক্ষমতা আছে। সবার ঘরে আলাদা আলাদা লাইন দিতে পারি। কিন্তু তারা সবাই লাইন নেননি। তবে সবাই বিদ্যুত ব্যবহার করছেন। যার অধিকাংশই অবৈধ। যেদিন দুর্ঘটনা ঘটেছে সেদিনও আমরা সেখানে কাজ করেছি।

বেঁচে যাওয়া শিশুর দায়িত্ব নিতে চায় ডেসকো 
সেদিনের বৃষ্টিতে একই পরিবারের তিনজনসহ চারজনের মর্মান্তিক মৃত্যু হলেও অলৌকিকভাবে বেঁচে যায় এক শিশু। ডেসকোর ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, অবশ্যই এটা মর্মান্তিক একটি ঘটনা। এটার জন্য ডেসকোর তো দায় থেকেই যায়। দায়বদ্ধতা থেকেই মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। ডেসকোতেও সিদ্ধান্ত হয়েছে। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া শিশুর দায়িত্ব নেবে ডেসকো। একটা ফিক্সড ডিপোজিট করা হবে। সেখান থেকে যা প্রফিট আসবে, ২১ বা ২২ বছর বয়স পর্যন্ত ওই শিশুর তত্ত্বাবধায়কের কাছে যাবে। এভাবে ওই শিশুর পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার চিন্তা করা হয়েছে। 

• চোখের নিমেষে সব শেষ, অলৌকিকভাবে বেঁচে গেল সাত মাসের শিশুটি

গত ২১ সেপ্টেম্বর রাতে প্রবল বৃষ্টিতে মিরপুর মডেল থানার সিরাজিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসা হাজী রোড ঝিলপাড় বস্তির বিপরীত পাশের রাস্তায় জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। জলমগ্ন ওই সড়কে বিদ্যুৎস্পসৃষ্ট হয়ে মারা যান একই পরিবারের তিনজনসহ মোট চারজন। 

নিহতরা হলেন— মিজান (৩০), তার স্ত্রী মুক্তা বেগম (২৫), মেয়ে লিমা (৭) এবং অটোরিকশাচালক অনিক। বেঁচে যাওয়া শিশুটির বাবা-মা মিজান-মুক্তা। এই শিশু হোসাইনকে বাঁচাতে গিয়েই মূলত মারা যান অটোরিকশাচালক অনিক। 

দুর্ঘটনার পর সমালোচনার মুখে সুষ্ঠু তদন্তে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করেছে ডেসকো। তদন্ত কমিটির প্রধান এসএন্ডডি অপারেশন (রূপনগর সার্কেল) তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. শওকত আলী। কমিটির বাকি দুই সদস্য হলেন, টেস্টিং এন্ড রিপেয়ারিং বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী প্রকৌশলী শেখ তানভীর আহম্মেদ ও ইস্টার্ন হাউজিং বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ মিজানুর রহমান। তদন্ত কমিটিকে সাত কার্যদিবসের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলেছে ডেসকো।

আরও ১৫ কার্যদিবস সময় চায় তদন্ত কমিটি
তদন্ত কমিটির প্রধান এসএন্ডডি অপারেশন (রূপনগর সার্কেল) তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. শওকত আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা দুর্ঘটনার পর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। ড্রেনে দুটি অবৈধ লাইন পেয়েছি। ওপরেও পেয়েছি একটি অবৈধ চোরাই লাইন। এর বাইরে তো আশপাশে অনেক চোরাই লাইন পেয়েছি। সেগুলো বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। চোরাই লাইন কারা নিয়েছে তাদের সনাক্ত করা হচ্ছে। আমরা সুষ্ঠু তদন্তের জন্য আরও ১৫ কার্যদিবস সময় চেয়েছি। তদন্ত কাজ শেষ হলে আমরা প্রতিবেদন দাখিল করব। 

যোগাযোগ করেনি ডেসকো
মিরপুর ওই দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া শিশুটি বর্তমানে রয়েছে বরিশালে তার দাদার কাছে। যোগাযোগ করা হলে হোসাইনের নানা মো. লিটন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের সঙ্গে ডেসকোর কেউ যোগাযোগ করেনি। হোসাইনের দায়িত্ব নেবে, টাকা দেবে বা ভরণপোষনের দায়িত্ব নেওয়ার কথা কেউ বলেনি। 

এদিকে এ ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় শনিবার পর্যন্ত কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। 

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মিরপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি, তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছি। ওই রাতেই তদন্ত শুরু হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্ট ঘটনায় যথাযথ কর্তৃপক্ষ হচ্ছে ডেসকো। ডেসকো এই ঘটনায় যেহেতু তদন্ত কমিটি করেছে। আমরা ওই তদন্ত প্রতিবেদনের অপেক্ষায় আছি।  

জেইউ/এনএফ