রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার রামচন্দ্রপুর খাল। পাশ দিয়ে গেলেই আসে বিশ্রী গন্ধ, পানির তো অস্তিত্ব নেই, তবে আছে কয়েক স্তরের বর্জ্য। পরিত্যক্ত সোফা সেট, নানান নষ্ট আসবাবপত্রসহ বাদ নেই তোশক-বালিশও। এছাড়া প্লাস্টিক, বোতলসহ এমন কোনো বর্জ্য নেই যা এই খালে ফেলা হয়নি।

এমন এক খালের রূপ পুরোই বদলে ঝকঝকে করে তুলেছে নানা বয়সী নারী-পুরুষ। তবে, সেখানে তরুণদের উপস্থিতিই বেশি ছিল। গত ২৮ ও ২৯ সেপ্টেম্বর তাদের সবার চেষ্টায় খালটি পরিষ্কার হয়েছে। ওপরের কয়েক স্তরের বর্জ্যগুলো আর নেই। প্রবাহিত হচ্ছে খালের পানিও। সেই সঙ্গে খালের ওপরে থাকা তিন সেতুও বিভিন্ন রঙে রাঙিয়ে চিত্র-শিল্প ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

মাত্র ২ দিনে এত বড় একটি কাজ কীভাবে হলো, কে উদ্যোগ নিলো, কারা খাল পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমে এগিয়ে এল? এত সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা গেল, রামচন্দ্রপুরের এই খাল পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমের বা প্রজেক্টের নাম দেওয়া হয়েছে “খালে হবে”। সেই থিম বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে আসলেই খালে হয়েছেও। মাত্র দুই দিনে অসম্ভব এই কাজটি করে ফেলেছে একদল তরুণ। যারা শ্রম দিয়েছে স্বেচ্ছায়। শুধুমাত্র নিজেদের তাগিদ থেকে কোন রকমের সুবিধা পাওয়ার চাহিদা ছাড়াই “খালে হয়েছে”, মানে খাল পরিষ্কার হয়েছে। এখন আর সেই দুর্গন্ধ নেই, নেই কোন বর্জ্য, ফিরে এসেছে পানি প্রবাহও।

খালের এই অবস্থা কতদিন থাকবে তা নিয়েও দেখা দিয়েছে প্রশ্ন, বিষয়টি নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যেও রয়েছে সংশয়। স্থানীয়রা বলছেন, কয়েকদিন পর খালের অবস্থা আগের মতো না হলেই হয়। এজন্য সিটি কর্পোরেশনকে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দাবি জানিয়েছেন তারা।

মাসিক রম্য একটি পত্রিকার সহকারী সম্পাদক কার্টুনিস্ট মোরশেদ মিশু। তবে, এই পরিচয় ছাড়াও তিনি এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক পরিচিত “খালে হবে” নামক একটি প্রজেক্টের জন্য উদ্যোগ নেওয়া ব্যাক্তি হিসেবে।

কিছুদিন আগে রাজধানীতে তীব্র জলাবদ্ধতা, এই রামচন্দ্রপুর খাল দিয়ে পানি নামতে না পারার একটি ভিডিও তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখতে পান। তারপর থেকেই তিনি কিছু একটা করার উদ্যোগ নেওয়ার কথা ভাবছিলেন। এরই মধ্যে প্রজেক্ট “খালে হবে” নামক একটি পোস্ট দেন। আর সেই পোস্টেই বদলে দেয় খালের সব কিছু। অনেকেই কাজ করার আগ্রহ দেখায়।

সবশেষ ৯৩ জন স্বেচ্ছাসেবক অংশ নেয় খাল পরিষ্কারে। তাদেরকে নিয়েই মোরশেদ মিশু নেমে পড়েন খাল পরিষ্কারে। মাত্র দুই দিনে মোহাম্মদপুরের ডিএনসিসির ৩৩ ওয়ার্ডের আওতাধীন রামচন্দ্রপুর খালটি তারা পরিষ্কার করে ফেলেন। এই বিশাল কর্মযজ্ঞে ২ দিনে স্বেচ্ছাসেবকদের খাবার, নৌকা ভাড়া,পানি, ডুবুরি, পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের বকশিশ সব মিলিয়ে খরচ হয়েছে ৮৬ হাজার ৬০০ টাকা। খরচের এই বিষয়গুলোর পাইটুপাই হিসেবে নিজের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আইডিতে তুলে ধরেছেন মোরশেদ মিশু।

সার্বিক বিষয় নিয়ে মোরশেদ মিশু বলেন, কিছুদিন আগে এই খালের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখে মনে হয়েছিল কিছু একটা করতে পারলে কেমন হয়। সেই আইডিয়া থেকেই "খালে হবে" এমন একটি পোস্ট দেওয়া। ১০০'র মতো স্বেচ্ছাসেবক কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। কিন্তু, এই কাজ করতে যে টাকা খরচ হবে সেটা কীভাবে আসবে? এরপর দেশি,বিদেশি বন্ধুদের কাছ থেকে আর্থিক সহযোগিতা পাই। এরপর স্থানীয় ওয়ার্ড কমিশনারের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি সেই ওয়ার্ডের সব পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের আমাদের সঙ্গে কাজে যুক্ত করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। এরপর সবার সহযোগিতায় গত ২৮ ও ২৯ সেপ্টেম্বর খালটির ১ থেকে ৪ নম্বর ব্রিজ পর্যন্ত পুরো অংশে পরিষ্কার করতে পেরেছি। এছাড়া, আমরা যে কোনো দেয়াল, স্থান পরিষ্কারের পর রঙ করে দেই। আমাদের সঙ্গে ছিল এশিয়ান পেইন্ট, অ্যাওয়ারনেস থ্রি সিক্সটি।

তিনি জানান, আগামী দুই বছরের মধ্যে ২০০ আর পাঁচ বছরের মধ্যে ৫০০ স্থান পরিষ্কারের পর রাঙিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা আছে। পাশাপাশি পাহাড়ের যাওয়ার চিন্তা রয়েছে। মানুষ পাহাড়ে ঘুরতে গিয়ে ময়লা করে আসে। সেগুলো আমরা পরিষ্কার করতে চাই।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও প্রশংসায় ভাসছেন মোরশেদ মিশু। মাহিন আব্দুল্লাহ নামের একজন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করে লিখেছেন, প্রজেক্ট “খালে হবে” বিরাট চ্যালেঞ্জিং একটা প্রজেক্ট ছিল। কিন্তু ছেলেপেলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তুড়ি মেরে কাজটা সেরে দিয়েছে…।

রামচন্দ্রপুরের এই খাল পরিষ্কারের একটি ভিডিও নিজের ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে শেয়ার করে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম লিখেছেন, একটু একটু করে আমরা সবাই মিলে বদলে দিচ্ছি ঢাকা। সবাই মিলে সবার ঢাকা।

এএসএস/এমজে