বেসরকারি চাকরিজীবী নূর নবী। বসবাস করেন রাজধানীর লালমাটিয়া এলাকায়। বাসায় পাইপলাইন গ্যাসের সংযোগ না থাকায় তাকে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) সিলিন্ডার ব্যবহার করতে হয়। তার অভিযোগ, সরকারের নির্ধারিত মূল্যে কখনোই মেলে না সিলিন্ডার গ্যাস।

নূর নবীর মতো এমন ভুক্তভোগী আরও অনেকেই। পাইপলাইন গ্যাসের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত এলপি গ্যাসের সিলিন্ডার যে সরকারি দামে বিক্রি হয় না, এই অভিযোগ বেশ পুরোনো। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) প্রতি মাসের শুরুতে ভোক্তা পর্যায়ে এলপিজি গ্যাসের দাম নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু বাজারে গেলে তার চিত্রটা উল্টো, বিইআরসির নির্ধারিত দামের চাইতে ১৫০ বা ২০০ টাকা অতিরিক্ত দামে বিক্রি হয় এই পণ্য। এ যেন সরকারি সিদ্ধান্ত বা আদেশকে এক প্রকার বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন।

সর্বশেষ রোববার (৩ ডিসেম্বর) ভোক্তা পর্যায়ে ১২ কেজি এলপি গ্যাসের সিলিন্ডারের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১ হাজার ৪০৪ টাকা, যা গত মাসে ছিল ১ হাজার ৩৮১ টাকা।

সরেজমিনে সোমবার (৪ ডিসেম্বর) স্থানীয় বাজার ঘুরে দেখা যায়, প্রতি ১২ কেজি এলপি গ্যাসের সিলিন্ডার দোকানভেদে বিক্রি হচ্ছে ১৫০০-১৬০০ টাকায়। বিক্রেতাদের দাবি, অতিরিক্ত দামে বিক্রি করার বিষয়ে তাদের কোনো হাত নেই। ডিলার পয়েন্ট থেকে যে দামে বিক্রি করা হয়, তারা সে অনুযায়ী বিক্রি করে থাকেন।

বিক্রেতা কাওসার আলী বলেন, কোম্পানি যে দামে সাপ্লাই দেয়, আমাদেরও সে দামে বিক্রি করতে হয়। এর বাইরে তো যাওয়ার সুযোগ নেই। কারণ কেউ তো লসে বিক্রি করবে না।

এদিকে, নির্ধারিত দামে এলপিজির সিলিন্ডার বিক্রি না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করছেন ব্যবহারকারীরা। লালমাটিয়ায় বসবাসকারী সোহেল আহমেদ বলেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে স্বাভাবিকভাবেই অর্থনৈতিক চাপে আছি। সেখানে একটি অতিরিক্ত খরচ চাপটা আরও বাড়িয়ে দিলো।

একই এলাকার বাসিন্দা শিক্ষার্থী পারভেজ আহমেদ বলেন, আমরা যারা ব্যাচেলর থাকি, তাদের প্রতি মাসে এলপি গ্যাস ব্যবহার করতে হয়। সবকিছুর দাম তো এখন এমনিতেও বেশি, তারপরেও সরকারি দামে এলপি গ্যাস কিনতে পারলে আমাদের কিছু সাশ্রয় হতো।

নির্ধারিত দামে এলপিজি সিলিন্ডার বিক্রি না হওয়ার কারণ হিসেবে কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি বিইআরসি। প্রতি মাসের এলপিজি সিলিন্ডারের দাম নির্ধারণ শীর্ষক ব্রিফিংয়ে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, তাদের মনিটরিং টিম মাঠে রয়েছে, কোথাও বেশি দামে বিক্রি করা হলে বা এমন অভিযোগ পেলে সে মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

তবে, ভোক্তাপর্যায়ে কেন সরকারি দামে সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে না, এর উত্তর জানতে চাইলে এলপি গ্যাস অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি মো হামিদ ভুইয়া লতিফ ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিইআরসি থেকে কোম্পানির জন্য যে দামটা নির্ধারণ করা হয়, সেই দামে ডিলার আমাদের কাছে বিক্রি করে না। এর ফলে লোড-আনলোডসহ আমাদের যে নিজস্ব আনুষঙ্গিক খরচ হয়, সেজন্য নির্ধারিত দামে এলপিজি সিলিন্ডার বিক্রি করাটা সম্ভব হয় না। 

তিনি বলেন, বেশি দামে বিক্রির কারণ হিসেবে কোম্পানি বলে ডলারের রেট বেশি বা এলসি জটিলতা রয়েছে। কিন্তু আমাদের তো এখানে কিছু করার নেই। আমরা চেষ্টা করি স্বল্প লাভ করে পণ্যটা গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দিতে।

তিনি আরও বলেন, আমরা এ সমস্যা সমাধানে বিইআরসির কাছে গিয়েছিলাম। কিন্তু ইতিবাচক ফলাফল আসেনি। একমাত্র কোম্পানি ও বিইআরসি যদি একত্রে সমন্বয় করে, তাহলেই সঠিক দামে ভোক্তার কাছে গ্যাস সিলিন্ডার পৌঁছে দেওয়া সম্ভব।

কাঁচামালের দাম অপরিবর্তিত, তবুও বেড়েছে এলপিজির দাম

এলপি গ্যাসের কাঁচামাল হিসেবে পরিচিত প্রোপেন ও বিউটেন। প্রতি মাসে পণ্য দুটির দাম ঘোষণা করে সৌদি আরামকো কোম্পানি। সৌদি কার্গো মূল্য (সিপি) ঘোষিত রেট অনুযায়ী, চলতি মাসে প্রোপেনের টনপ্রতি মূল্য ৬১০ ডলার ও বিউটেনের মূল্য ৬২০ ডলার। দুটি পণ্যের নির্ধারিত অনুপাত অনুযায়ী, গড় মিশ্রণের ক্ষেত্রে দাম দাঁড়ায় ৬১৬ ডলার ৫০ সেন্ট। এ রেটকে ভিত্তিমূল্য ধরে প্রতি মাসে এলপি গ্যাসের দাম ঘোষণা করে বিইআরসি।

এর আগে, গত নভেম্বরে প্রোপেন ও বিউটেনের দাম টনপ্রতি যথাক্রমে ৬১০ ও ৬২০ ডলার ঘোষণা করেছিল সৌদি আরামকো। গত নভেম্বরে দুটি পণ্যের গড় মূল্য অপরিবর্তিত ছিল।

তবুও ভোক্তা পর্যায়ে এলপিজির দাম বৃদ্ধি করেছে বিইআরসি। এর কারণ হিসেবে কমিশনের চেয়ারম্যান নুরুল আমিন বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে এলপি গ্যাসের কাঁচামালের দাম বাড়েনি। গত মাসের মতোই রয়েছে। তবে ডলারের বিনিময় হার বেড়ে যাওয়ায় এলপিজির দাম কিছুটা বেড়েছে।’

ডলারের বিনিময় হার ১১৬ টাকা ৩৯ পয়সা ধরে রোববার (৩ ডিসেম্বর) এলপিজির নতুন দাম ঘোষণা করে বিইআরসি। এলপিজির দাম ঘোষণার ক্ষেত্রে সাধারণত পণ্যটির আগের মাসের আমদানি মূল্যকে বিবেচনায় নেওয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক গত মাসে ডলারের সর্বোচ্চ দর বেঁধে দিয়েছিল ১১১ টাকা। 

সে হিসাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত ডলারের দরকে গ্রহণ করেনি নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। আমদানিকারক কোম্পানির ইনভয়েস মূল্য থেকে গড় করে পুরো মাসের জন্য ডলারের হিসাব বের করা হয়। এরপর দেশের বাজারে মূল্য ঘোষণা করে কমিশন।

ওএফএ/কেএ