রিকশাচালক মো. মাঈনুদ্দিন

‘একদিন রিক্সার চাক্কা না ঘুরলেই না খাইয়া থাকতে হয়। আর যদি চাইর দিন চাক্কা না ঘুরে, তয় মইরাই যামু’- কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ ও চোখে-মুখে হতাশার ছাপ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন রিকশাচালক মো. মাঈনুদ্দিন।

করোনা সংক্রমণ রোধে সরকারের সাত দিনের বিধিনিষেধের প্রথম দিনে সড়কে যাত্রী নেই। অপ্রয়োজনে মানুষকে বের হতে নিষেধ করেছে পুলিশ। আর এ কারণেই সড়কে যাত্রী নেই। যাত্রী বেশি থাকলে রিকশাচালকদের আয়ও বেশি। কিন্তু যাত্রী না থাকলে আয় আসবে কোথা থেকে?   

গলার স্বর অনেকটা চাপা করেই তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন দুপুর দুইটা পর্যন্ত সব খরচ বাদে অন্তত চার-পাঁচশ টাকা পকেটে থাকে। আজ এখন পর্যন্ত ভাড়াই পেয়েছি মাত্র দেড়শ টাকা। তার মধ্যে একশ টাকা রিকশার জমা হিসেবে মালিককে দিতে হবে। রিকশা চালানো বন্ধ থাকলে আমাদের খুব অসুবিধা হয়। গ্রামে মা, বউ আর দুই মেয়ে থাকে। তাদের চার জনের অন্তত প্রতিদিন বাজার খরচ আছে দুশ টাকা। আমি এখানে থাকি, আমারও খরচ আছে দুশ টাকা। সব হিসেবে দিন আমার পাঁচশ টাকা খরচ আছে।’

রিকশাচালক আমজাদ হোসেন

দেশে করোনা পরিস্থিতিতে অনেকেরই অর্থনৈতিক অবস্থা তেমন ভালো না। ধার দেনা করে নিম্ন আয়ের অনেকেই দিনযাপন করছেন। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, এখন ধারও পাওয়া যায় না। এসব কথারই পুনরাবৃত্তি করে রিকশাচালক মো. মাঈনুদ্দিন বলছিলেন, ‘আমাদের এখন কেউ টাকা ধার দিতে চায় না। তারা বলে, তুই তো টাকা ফেরত দিতে পারবি না। তোকে টাকা ধার দেওয়া যাবে না।’

বুধবার (১৪ এপ্রিল) রাজধানীর জিগাতলায় সীমান্ত স্কয়ারের সামনে ঢাকা পোস্টের কথা হয় এই রিকশাচালকের সঙ্গে। শুধু মাঈনুদ্দিনই না, তার মতো আরও গোটা ১৫ রিকশাচালকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুপুর দুইটা পর্যন্ত তাদের বেশিরভাগই ১০০ টাকার বেশি ভাড়া পাননি। মোহাম্মদপুর, শংকর, ধানমন্ডি-১৫, জিগাতলা এবং ধানমন্ডি লেক পাড়ে এসব রিকশাচালকের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। ভাড়া না পেয়ে তাদের অনেকেই রাস্তার দুধারে চিন্তামগ্ন হয়ে সময় কাটাচ্ছেন। কেউ বা ঘুমাচ্ছেন, কেউ বা শুধুই ভাবছেন, আবার একই টাকা বারবার গুণে দেখছেন কেউ কেউ।

বিধিনিষেধের অনেকটা প্রভাব পড়েছে নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর। রিকশাচালকদের অনেকের অবস্থান নিম্ন আয়ের মধ্যেই। তাই এ প্রভাব থেকে তারাও মুক্ত নন। অসময়ে ভাড়া বেশি নেওয়া তো দূরের কথা, ন্যায্য ভাড়ার চেয়ে কমে যেতেও রাজি তারা। তবুও মিলছে না যাত্রী। যাত্রীর জন্য চেয়ে আছেন চাতক পাখির মতো।

যাত্রী না থাকায় অলস সময় কাটাচ্ছেন রিকশাচালকদের কেউ কেউ

খুব চিন্তিত অবস্থায় দেখা যায় রিক্সা চালক গণি মিয়াকে। জিজ্ঞেস করতেই বলেন, ‘সকাল আটটায় বের হয়েছি। এখন পর্যন্ত দুটি ভাড়ায় মাত্র ৫০ টাকা পেয়েছি। অন্যান্য সময় এই পর্যন্ত চার-পাঁচশ টাকা ভাড়া মেরে ফেলতাম। আজ মালিককে রিকশার ভাড়া দিবো কী করে, আর বিকেলে বাজার নিয়ে যাবো কী করে সেটাই ভাবছি। না পারলে ছেলে-পেলে বউ নিয়ে না খেয়ে থাকতে হবে।’

৬০ টাকা হাতে ধরে দেখিয়ে পঞ্চাশোর্ধ্ব আমজাদ হোসেন বলেন, ‘বাবা রে, কষ্টের কথা আর কী বলব। আজ বোধ হয় না খেয়েই থাকতে হবে। বাইরে মানুষ নাই। কে, কোথায় যাবে? তাই ভাড়াও নাই। এই দেখেন, সকাল থেকে এখন পর্যন্ত ৬০ টাকা ভাড়া মারছি। আল্লাহ জানেন, রিকশার জমার টাকা উঠাতে পারব কি না!’

বর্তমানে চলমান এই বিধিনিষেধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ। কেউ যেন অপ্রয়োজনে বাইরে ঘোরাফেরা করতে না পারে, সেজন্য রাজধানীজুড়ে বসানো হয়েছে পুলিশের চেক পোস্ট। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের থানা ও ট্রাফিক বিভাগের সম্মিলিত টহলও জোরদার করা হয়েছে। পুলিশের মুভমেন্ট পাস ও জরুরি প্রয়োজন ব্যতীত কাউকে বাইরে চলাচল করতে দেওয়া হচ্ছে না। আর তাই যাত্রী সংকটে খেটে-খাওয়া রিকশাচালকরা। চিন্তায় রয়েছেন সামনের দিনগুলো নিয়েও।

এমএইচএন/আরএইচ