মানুষের চলাচল সীমিত করতে কঠোর অবস্থানে ছিল পুলিশ

করোনার বিস্তার প্রতিরোধে দেশব্যাপী চলছে সাত দিনের বিধিনিষেধ। এই সময়ে সম্মুখযোদ্ধা হিসেবে চিকিৎসকদের বাইরে বের হতে বাধা নেই এবং মুভমেন্ট (চলাচল) পাস লাগবে না বলে জানিয়েছিলেন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ। কিন্তু কঠোর বিধিনিষেধের প্রথম দিনেই হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন বেশ কয়েকজন চিকিৎসক।

ভুক্তভোগী অনেকেই এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাসও দিয়েছেন। তাদের অভিযোগ, পুলিশের আইজিপি বেনজীর আহমেদের নির্দেশনা তৃণমূল পুলিশ সদস্যরা মানছেন না।

চিকিৎসকদের সংগঠন ফাউন্ডেশন ফর ডক্টরস সেফটি রাইটস অ্যান্ড রেসপনসিবিলিটিজ (এফডিআরএস) জানিয়েছে, বিধিনিষেধের প্রথম দিনে কর্মস্থলে যাওয়া-আসার পথে ভোগান্তিতে পড়েছেন চিকিৎসকরা। অনেককেই গুনতে হয়েছে জরিমানা। অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামিয়ে দেওয়া কিংবা দুই ঘণ্টা পর্যন্ত পথে আটকে রাখার মতো ঘটনাও ঘটেছে।

এসব ঘটনার নিন্দা জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউসিজি) অধ্যাপক ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘চিকিৎসকরা যেহেতু জরুরি পরিসেবায় নিয়োজিতদের মধ্যে পড়েন, সেহেতু পরিচয় দেওয়ার পরও তার নামে মামলা দেওয়া উচিত হয়নি। যা হয়েছে ঠিক হয়নি, মহা-অন্যায় হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে জরুরি বিভাগ তো খোলা, সে হিসেবে চিকিৎসকরা তো অবাধে কর্মস্থলে যেতে পারার কথা। তা না হলে তারা এতো রোগীর চিকিৎসা কীভাবে দেবেন? তারা যে কষ্ট করে যাচ্ছেন, এটাই তো বেশি। আর যেন এমন না হয়, তা নিশ্চিতে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।’

বাধার শিকার হওয়া চিকিৎসকদের ক্ষোভ

কর্মস্থলে যেতে পুলিশের বাধা ও ভোগান্তিতে পড়ে ক্ষোভ জানিয়েছেন বেশ কয়েকজন চিকিৎসক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে চিকিৎসকদের নিজস্ব গ্রুপগুলোতে তারা এ নিয়ে পোস্ট দিয়েছেন।

কৃষ্ণা হালদার নামে এক চিকিৎসক লিখেছেন, ‍‘গত রাতে কুয়েত মৈত্রী সরকারি হাসপাতালে আমার নাইট শিফটে ডিউটি ছিল। সকালে আমার ব্যক্তিগত প্রাইভেট কার পিক-আপ করার সময় কারওয়ান বাজার সিগন্যালে ড্রাইভার আমার আইডি কার্ড দেখানোর পরও পুলিশ মামলা করেছে।’

তিনি আরও লেখেন, ‘পুলিশ তাকে ফাইন (জরিমানা) করেছে, সব কাগজপত্র নিয়ে গেছে। পরে তিনি পুলিশের সহযোগিতা চেয়েও পাননি। বারবার চেষ্টা করেও তিনি মুভমেন্ট পাস বের করতে পারেননি বলেও উল্লেখ করেছেন।’

কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে কাজ করা নার্সরা বিপাকে পড়েন একদম সকালে। হাসপাতালটির নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) দায়িত্বে থাকা চিকিৎসক শাহজাদ হোসেন মাসুম লিখেছেন, ‘‍আমার আইসিইউর নার্সদের বহনকারী অধিদফতর থেকে স্টিকারযুক্ত গাড়ি টঙ্গী থেকে আসার সময় আটকে রাখে পুলিশ এবং জানায় মুভমেন্ট পাস ছাড়া যেতে দেবে না। তারা আমাকে কল করলে আমি পরিচালককে জানাই। তারা কোভিড আইসিইউর স্টাফ উল্লেখ করে অনেকবার অনুরোধ করলেও পুলিশ মুভমেন্ট পাস ছাড়া গাড়ি ছাড়বে না বলে জানায়। দুই ঘণ্টা আটকে থাকার পর তারা হাসপাতালে পৌঁছাতে পারেন।’

ক্ষোভ প্রকাশ করে ফেসবুকে চিকিৎসকদের দেওয়া স্ট্যাটাস

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অবেদনবিদ্যা (অ্যানেস্থেসিয়া) বিভাগের চিকিৎসক ইফতেখারকে ফার্মগেটে অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামিয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। তিনি রাতের ডিউটি সেরে বাসায় ফিরছিলেন। পরে ওই চিকিৎসক সাত কিলোমিটার হেঁটে রামপুরার বাসায় পৌঁছান।

স্কয়ার হাসপাতালের চিকিৎসক নাজমুল ইসলামের স্ত্রী চিকিৎসক ইসরাত জাহান ফেসবুকে স্ট্যাটাসও দিয়েছেন। সঙ্গে তার স্বামীকে যে তিন হাজার টাকার জরিমানা গুনতে হয়েছে সেই স্লিপও যুক্ত করেছেন।

ইসরাত জাহান লিখেছেন, ‘‌আমার হাসবেন্ড স্কয়ার হসপিটালের কোভিড ইউনিটে কর্তব্যরত আছেন। আজকে সকাল ৮টা থেকে তার ডিউটি ছিল। আমাদের বাসায় আমার শ্বশুর কোভিড পজিটিভ হওয়ায় আমার হাসবেন্ড বাসা (মুন্সিগঞ্জ) থেকে নিজেদের গাড়ি নিয়ে ডিউটিতে যাচ্ছেন বেশ কিছুদিন ধরে। সকালে আমাদের গাড়ি সাইনবোর্ডের একটু পরে থামায় পুলিশ এবং তিন হাজার টাকা জরিমানা করে। আমার হাসবেন্ডের সঙ্গে তার কর্মস্থলের আইডি কার্ড ছিল। স্কয়ার হাসপাতালের ট্রান্সপোর্ট অবশ্যই মুন্সিগঞ্জ আসবে না। আর হঠাৎ একটা অ্যাপ বানিয়ে বলল নেন মুভমেন্ট পাস নামক সার্কাস নিয়া বাইর বের হবেন, যেখানে তাদের ওয়েবসাইটে ঢোকাই যায় না। এমতাবস্থায় ডাক্তাররা কি সারাদিন ডিউটি বাদ দিয়ে পাস পাস খেলবে নাকি?’

রিয়াজ আহমেদ তমাল লিখেছেন, ‘৭টায় গাজীপুরের টঙ্গী কলেজ গেট থেকে রিকশাযোগে আসার সময় টঙ্গী স্টেশন রোডে পুলিশ আটকায়। আমার আইসিডিডিআর,বি আইডি কার্ড দেখালে বলে যে আমাদেরও নাকি বের হওয়া নিষেধ। অবশেষে বলে দিলেন যে, হাসপাতালে ডিউটি করতে হলে রাতে সেখানে থেকে যেতে।’

এফডিএসআরের নিন্দা

এফডিআরএসের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, চিকিৎসকদের কর্মস্থলে যাওয়ার পথে বিভিন্ন স্থানে পুলিশি হয়রানির অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তাৎক্ষণিকভাবে এফডিএসআরের পক্ষ থেকে পুলিশের ঊর্ধ্বতন মহলে বিভিন্ন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে। পুলিশের আইজিপি এ বিষয়ে অবহিত হয়েছেন।

বলা হয়েছে, বিচ্ছিন্নভাবে আজ বিভিন্ন স্থানে যেসব হয়রানির শিকার হয়েছেন সব চিকিৎসকের প্রতি আমাদের সহমর্মিতা। আমরা এ অভিযোগ পাওয়ার পর থেকে গণমাধ্যমসহ সংশ্লিষ্ট মহলের কাছে আমাদের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছি, অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে জোর দাবি জানিয়েছি। তারা আগামীতে যেন কোনো চিকিৎসককে এমন হয়রানি না করেন সে বিষয়ে সব প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।

এফডিএসআরের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের সঙ্গেও এ বিষয়ে কথা বলা হয়েছে। তিনি কেবিনেট সচিবকে বিষয়টি অবহিত করে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন। যেসব চিকিৎসকের কাছ থেকে জরিমানা নেওয়া হয়েছে সেই রশিদ দেখালে জরিমানার টাকা ফেরত দেবেন বলেও জানিয়েছেন। এরপর এমন অনাকাঙ্ক্ষিত অবস্থার মুখোমুখি হলে দুটি মোবাইল নাম্বারে জানানোর (01711048475, 01916896490) জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।

এর আগে মঙ্গলবার (১৩ এপ্রিল) পুলিশের আইজিপি বেনজীর আহমেদ জানিয়েছিলেন, লকডাউন চলাকালে চিকিৎসক, সাংবাদিকসহ জরুরি সেবায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের কোনো মুভমেন্ট পাস নিতে হবে না।

টিআই/এফআর/জেএস