বিশ্বের সর্ববৃহৎ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ—বাংলাদেশি এই কীর্তিমানের চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী আজ (২০ ডিসেম্বর)। ২০১৯ সালের এই দিনে ৮৩ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতা অর্জনের পর সুনামগঞ্জের দুর্গম এলাকা শাল্লায় ফিরে আসা শরণার্থীদের ত্রাণ ও পুনর্বাসনের জন্য ৩৬ বছর বয়সে ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা করেন স্যার ফজলে হাসান আবেদ। পরবর্তী সময়ে দীর্ঘ মেয়াদি উন্নয়ন কৌশলের আওতায় সমাজের বিভিন্ন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে ব্র্যাকের বহুমুখী উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সম্প্রসারিত হতে থাকে। 

সুবিধাবঞ্চিত মানুষকে স্বাবলম্বী করে তোলার লক্ষে ব্র্যাক একটি সমন্বিত উন্নয়ন কৌশল গড়ে তোলে যার আওতায় রয়েছে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, ক্ষুদ্রঋণ, দক্ষতা উন্নয়ন, কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা, কুটিরশিল্প, মানবাধিকার, সড়ক নিরাপত্তা, অভিবাসন এবং নগর উন্নয়নের মতো বিভিন্ন কর্মসূচি। 

স্যার ফজলে হাসান আবেদ ১৯৩৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬২ সালে তিনি লন্ডনে অ্যাকাউন্টেন্সি বিষয়ে পড়াশোনা করেন এবং কস্ট ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টেন্ট হন। পাকিস্তান শেল অয়েল কোম্পানির সিনিয়র কর্পোরেট এক্সিকিউটিভ হিসেবে কর্মরত থাকাকালে ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড় এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ নাটকীয়ভাবে তাঁর জীবনের দিক পরিবর্তন করে দেয়। যুদ্ধ শুরুর পর তিনি চাকরি ছেড়ে লন্ডনে চলে যান। সেখানে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার জন্য ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’ ও ‘হেলপ বাংলাদেশ’ নামে দুটো সংগঠন গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন।

মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৯৭২ সালের শুরুর দিকে তিনি যখন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন, তখন দেশের অর্থনীতি সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত। ভারত থেকে ফিরে আসা এক কোটি শরণার্থীর জন্য জরুরিভাবে ত্রাণ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার প্রয়োজন ছিল। স্যার ফজলে হাসান আবেদ তখন প্রত্যাগত শরণার্থীদের সহায়তায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রত্যন্ত এলাকায় ‘ব্র্যাক’ গড়ে তোলেন। সংগঠিত করার মাধ্যমে দরিদ্র মানুষের দক্ষতা উন্নয়ন, কর্মসংস্থান ও ক্ষমতায়ন ঘটিয়ে তাদের জীবনমানের পরিবর্তন ঘটানো ছিল প্রতিষ্ঠানটির মূল লক্ষ্য। 

ব্র্যাক এখন বিশ্বের এক নম্বর এনজিও যার কার্যক্রম এশিয়া ও আফ্রিকার এগারোটি দেশে পরিচালিত হচ্ছে। প্রভাব, উদ্ভাবন এবং টেকসই বৈশিষ্ট্যের বিবেচনায় জেনেভাভিত্তিক গণমাধ্যম সংগঠন ‘এনজিও অ্যাডভাইজার’ ২০২০ সালে টানা পাঁচবারের মতো ব্র্যাককে বিশ্বের শীর্ষ ৫০০ এনজিওর মধ্যে প্রথম হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। 

স্বীকৃতি ও সম্মাননা

সামাজিক ক্ষেত্রে অনন্যসাধারণ অবদানের জন্য স্যার ফজলে হাসান আবেদ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য পুরস্কারগুলোর মধ্যে রয়েছে শিক্ষা উন্নয়নে বিশ্বের সর্বোচ্চ পুরস্কার ইদান প্রাইজ (২০১৯), নেদারল্যান্ডের রাজা কর্তৃক রয়াল নাইটহুড উপাধি (২০১৯), লেগো অ্যাওয়ার্ড (২০১৮), লাউদাতে সি’ অ্যাওয়ার্ড (২০১৭), হোসে এডগারডো ক্যাম্পোস কোলাবোরেটিভ লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড (২০১৬), টমাস ফ্রান্সিস জুনিয়র মেডেল অব গ্লোবাল পাবলিক হেলথ পুরস্কার (২০১৬), ওয়ার্ল্ড ফুড প্রাইজ (২০১৫), ট্রাস্ট উইমেন হিরো অ্যাওয়ার্ড (২০১৪), অর্ডার অব সিভিল মেরিট (অর্ডেন ডেল মেরিটো সিভিল, ২০১৪), লেভ তলস্তয় স্বর্ণপদক (২০১৪), ওপেন সোসাইটি প্রাইজ (২০১৩), শিক্ষার জন্য ওয়াইজ প্রাইজ (২০১১), আন্ট্রপ্রেনর ফর দ্য ওয়ার্ল্ড (২০০৯), ডেভিড রকফেলার ব্রিজিং লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড (২০০৮) ক্লিনটন গ্লোবাল সিটিজেনশিপ অ্যাওয়ার্ড (২০০৭), হেনরি আর. ক্রাভিস প্রাইজ ইন লিডারশিপ (২০০৭), দারিদ্র্য দূরীকরণ ও সামাজিক উন্নয়নে অবদানের জন্য পল্লীকর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) কর্তৃক আজীবন সম্মাননা (২০০৭), মানব উন্নয়নে অসামান্য অবদানের জন্য ইউএনডিপি মাহবুবুল হক অ্যাওয়ার্ড (২০০৪), গেটস অ্যাওয়ার্ড ফর গ্লোবাল হেলথ (২০০৪), গ্লেইটসম্যান ফাউন্ডেশন পুরস্কার (২০০৩), দ্য শোয়াব ফাউন্ডেশন সোশ্যাল আন্ট্রপ্রেনরশিপ অ্যাওয়ার্ড (২০০৩), ওলফ পামে অ্যাওয়ার্ড (২০০১), ইন্টারঅ্যাকশন হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাওয়াার্ড (১৯৯৮), অ্যালানশন ফেইনস্টেইন ওয়ার্ল্ড হাঙ্গার পুরস্কার (১৯৯০), ইউনেস্কো নোমা পুরস্কার (১৯৮৫) এবং কমিউনিটি লিডারশিপের জন্য রামন ম্যাগসেসে অ্যাওয়ার্ড (১৯৮০)।

‘অশোকা’ ফজলে হাসান আবেদকে অন্যতম ‘গ্লোবাল গ্রেট’ স্বীকৃতিতে ভূষিত করেছে। তিনি এই প্রতিষ্ঠানের ‘গ্লোবাল অ্যাকাডেমি ফর সোশ্যাল আন্ট্রপ্রেনরশিপ’-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দারিদ্র্য হ্রাসে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ব্রিটিশ ক্রাউন ২০০৯ সালে তাকে দ্য মোস্ট ডিস্টিংগুইশড অর্ডার অব সেন্ট মাইকেল অ্যান্ড সেন্ট জর্জ উপাধিতে ভূষিত করেন। 

বিশ্বের স্বল্পোন্নত দেশগুলোয় সহায়তার ক্ষেত্রে জাতিসংঘ মহাসচিবকে পরামর্শ প্রদানে নিযুক্ত ‘বিশ্বের স্বনামধন্য ব্যক্তিবর্গ’ তালিকায় ২০১০ সালে স্যার ফজলে অন্তর্ভুক্ত হন। ২০১৪ এবং ২০১৭ সালে ‘ফরচুন ম্যাগাজিন’ কর্তৃক বিশ্বের ৫০ জন সর্বশ্রেষ্ঠ নেতার তালিকায় তার নাম অন্তর্ভুক্ত হয়।

স্যার ফজলে হাসান আবেদ বহু সম্মানসূচক ডিগ্রি পেয়েছেন। এর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি থেকে ‘ডক্টর অব লজ’ (২০১৪), যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে ‘ডক্টর অব লেটার্স’ (২০০৯), মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে ‘ডক্টর অব লজ’ (২০০৮) এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ইউনিভার্সিটি থেকে ‘ডক্টরেট অব হিউমেন লেটার্স’ (২০০৭) উল্লেখযোগ্য।

ফজলে হাসান আবেদের জীবনীগ্রন্থ “আশার জয়” এর প্রকাশনা

স্যার ফজলে হাসান আবেদের জীবনভিত্তিক গ্রন্থ "আশার জয়" -এর আনুষ্ঠানিক মোড়ক উন্মোচন করা হবে আজ বুধবার। স্যার ফজলে হাসান আবেদ-এর চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকীর দিনে ব্র্যাক সেন্টারে এক প্রকাশনা অনুষ্ঠানে এই বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হবে। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান গ্রন্থটির মোড়ক উন্মোচন করবেন। 

“হোপ ওভার ফেইট: ফজলে হাসান আবেদ অ্যান্ড দ্যা সায়েন্স অফ এন্ডিং গ্লোবাল পোভার্টি” শীর্ষক ইংরেজি ভাষায় মূল গ্রন্থটি লিখেছেন সাংবাদিক স্কট ম্যাকমিলান। বাংলায় বইটি অনুবাদ করেছেন আলভী আহমেদ। 

এই বইয়ে স্যার ফজলে হাসান আবেদের জীবনের নানা গল্প উঠে এসেছে। তিনি ছিলেন এমন একজন নিভৃতচারী মানুষ যিনি আজীবন পাদপ্রদীপের আলো থেকে দূরে থেকে মানুষের কল্যাণে কাজ করে গেছেন এবং মানুষের সম্ভাবনায় দৃঢ় আস্থা রেখেছেন। যিনি এক সংগ্রাম মুখর জীবনযাপন করেছেন, যে জীবনের চালিকাশক্তি ছিল মানুষের সম্ভাবনায় গভীর বিশ্বাস।

বইটির লেখক স্কট ম্যাকমিলান দীর্ঘদিন কাছ থেকে ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদকে দেখেছেন ও তার সঙ্গে কাজ করেছেন। তিনি এখন ব্র্যাক ইউএসএ-এর শিক্ষণ ও উদ্ভাবন বিষয়ক পরিচালকের দায়িত্ব পালন করছেন। 

টিআই/এমএসএ