দেশে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি দিন দিন অবনতির দিকে যাচ্ছে। সংক্রমণের সংখ্যা ওঠানামা করলেও মৃত্যুর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। শুক্রবার (১৬ এপ্রিল) স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, ২৪ ঘণ্টায় করোনায় আক্রান্ত ১০১ জনের মৃত্যু হয়েছে, যা দেশে একদিনে করোনায় মৃত্যুর নতুন রেকর্ড। 

পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত ১০ দিনে করোনায় ৮২০ জনের মৃত্যু হয়েছে। যার মধ্যে হাসপাতালেই মারা গেছেন ৭৮৭ জন। গাণিতিক হিসাবে যা প্রায় ৯৬ শতাংশ। চিকিৎসকরা বলছেন, অধিকাংশ রোগীই সংকটাপন্ন অবস্থায় হাসপাতালে আসছেন। তাদের ফুসফুস দ্রুত সংক্রমিত হচ্ছে। শুরুতে তেমন কোনো উপসর্গ না থাকা এবং রোগটির প্রতি মানুষের অবহেলাতেই এত মৃত্যু হচ্ছে বলে ধারণা করছেন তারা। 

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, করোনায় গত ৭ এপ্রিল ৬৩ জন এবং ১০ এপ্রিল মারা যাওয়া ৭৭ জনের সবার মৃত্যু হয়েছে হাসপাতালে।  বৃহস্পতিবার ১৫ এপ্রিল মারা যাওয়া ৯৪ জনের মধ্যে ৯০ জন এবং বুধবার (১৪ এপ্রিল) ৯৬ জনের মধ্যে ৯৪ জন হাসপাতালে মারা গেছেন। আর শুক্রবার ১০১ জনের মধ্যে ৯৪ জনের মৃত্যু হয়েছে হাসপাতালে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) এনেসথেশিয়া বিভাগের কনসালটেন্ট সাজ্জাদ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘অনেক রোগীই সংকটাপন্ন হওয়ার পরে হাসপাতালে আসছেন। আবার হাসপাতালে এসেও অনেকে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে বিলম্ব করছেন। অর্থাৎ অনেকের শুরুতেই ফুসফুসের অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। তারা হাসপাতালে আসার পর চিকিৎসার ক্ষেত্রে আবার স্বজনদের দিক থেকে নানা সিদ্ধান্তহীনতা দেখা যায়। এসব কারণে হাসপাতালে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্তদের ফুসফুস খুব দ্রুত সংক্রমিত হচ্ছে। ফলে অল্প সময়ে ড্যামেজ (অকার্যকর) হচ্ছে। তাদের ফুসফুস ফুটবলের মতো হয়ে যায়। আমাদের এখানে যত রোগী আসছেন, প্রায় সবার একই অবস্থা। আমরা চেষ্টা করছি সবদিক দিয়ে। কিন্তু কাজ হচ্ছে না। অনেকে আবার প্রথমে লাইফ সাপোর্ট সুবিধা নিতে রাজি হন না।’

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সুলতানা সাহানা বানু বলেন, ‘রোগীর সংখ্যা এখন প্রচুর। আমাদের প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ স্যাম্পল সংগ্রহ করতে হয়। ফেব্রুয়ারি মাসে কিছুটা কমে গিয়েছিল। ওই সময় প্রতিদিন মেশিন রান (চালানো) হতো একবার, এখন রান করতে হয় তিনবার। একবার রান করার সময় ৯৬টি স্যাম্পল দেওয়া হয় মেশিনে। আবার দেখুন, রোগীর সংখ্যা বেশি হলেও মানুষ কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি মানছে না।’

ফুসফুস দ্রুত সংক্রমিত হওয়ার কারণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘দেখা যাচ্ছে নতুন ভ্যারিয়েন্ট ৭০ থেকে ৯০ ভাগ বেশি আক্রমণ করার ক্ষমতা রাখে এবং দ্রুত ছড়ায়। আগে যেমন নাকের ভেতরে গিয়ে সংখ্যা বৃদ্ধি করত, তারপর ফুসফুসে যেত। এখন তার আর দরকার পড়ে না। এটি এখন সরাসরি ফুসফুসে চলে যায় এবং ফুসফুসকে সংক্রমিত করে। অর্থাৎ আগে ভাইরাসটি নাকে থাকলে সর্দি, কাশি ও জ্বর হতো; এখন সেগুলো হচ্ছে না। সরাসরি ফুসফুস আক্রান্ত হওয়ার পর সামান্য মাথাব্যথা, গা ব্যথা হয়। পরে সিটি স্ক্যানে দেখা যায় ফুসফুস ৩০ থেকে ৫০ ভাগ অকার্যকর হয়ে গেছে। ওদিকে করোনা পরীক্ষাতেও পজিটিভ না এসে বারবার নেগেটিভ আসছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বিভিন্ন দেশ থেকে আমাদের দেশে অবশ্যই অনেকগুলো ভ্যারিয়েন্ট এসেছে, যা আমরা প্রয়োজনীয় গবেষণার অভাবে শনাক্ত করতে পারিনি। যেহেতু নতুন ভ্যারিয়েন্টগুলোর বিপরীতে আমাদের কোনো প্রতিরোধ ক্ষমতা নেই, সেহেতু ভাইরাসটি দ্রুত ছড়াবে। আর সামনে নতুন ভ্যারিয়েন্ট যেটি আসবে, সেটি আগের তুলনায় অনেক বেশি মারাত্মক হবে।’

মৃতদের অধিকাংশই পুরুষ এবং ষাটোর্ধ্ব

এ পর্যন্ত ভাইরাসটিতে মোট মারা যাওয়া ১০ হাজার ১৮২ জনের মধ্যে পুরুষ ৭ হাজার ৫৬৬ জন এবং নারী ২ হাজার ৬১৬ জন।  শুক্রবার মারা যাওয়া ১০১ জনের মধ্যে ৬৩ জনেরই বয়স ৬০ বছরের বেশি। এছাড়া ৫১ থেকে ৬০ বছরের আছেন ২৩ জন। তবে দ্বিতীয় ঢেউয়ে ৪১ থেকে ৫০ এবং ৩১ থেকে ৪০ বছর বয়সীরাও মারা যাচ্ছেন উল্লেখযোগ্য সংখ্যায়। 

দেশের করোনা পরিস্থিতি

শুক্রবার স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে জানানো হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন রেকর্ড ১০১ জন। শনাক্ত হয়েছেন ৪ হাজার ৪১৭ জন। মোট আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৭ লাখ ১১ হাজার ৭৭৯ জন। 

একই সময়ে ১৮ হাজার ৭০৭ জনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। পরীক্ষা করা হয়েছে ১৮ হাজার ৯০৬টি। 

নমুনা পরীক্ষার তুলনায় শনাক্তের হার ২৩ দশমিক ৩৬ শতাংশ। দেশে এ পর্যন্ত মোট নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ৫১ লাখ ৩৪ হাজার ৪৭৮টি। মোট পরীক্ষার তুলনায় শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ৮৬ শতাংশ।

বৃহস্পতিবার ১৫ এপ্রিল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ৯৪ জনের মৃত্যু হয়। এটি ছিল দেশে একদিনে করোনায় তৃতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যু। তার আগে বুধবার মারা যান ৯৬ জন, যা ছিল দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।

গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম ৩ জনের দেহে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়। এর ১০ দিন পর ১৮ মার্চ দেশে এ ভাইরাসে আক্রান্ত প্রথম একজনের মৃত্যু হয়।

টিআই/আরএইচ/জেএস