নাতিকে হারিয়ে দিশেহারা মফিজ মিয়া/ ছবি : ঢাকা পোস্ট

ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত ৯টা। কেবল রাতের খাবার খেয়ে উঠেছি। এর মধ্যে ছেলের নম্বর থেকে অপরিচিত এক লোকের ফোন। বললেন, এ নম্বর যে ব্যক্তির তিনি এক্সিডেন্ট করেছেন, আপনারা দ্রুত কুর্মিটোলা হাসপাতালে আসেন। আমার মাথায় তো আকাশ ভেঙে পড়ল। তাড়াতাড়ি বাড়ির মালিককে জানিয়ে বের হলাম।‘

বলছিলেন রাজধানীর খিলক্ষেত ফুটওভার ব্রিজের নিচে প্রাইভেটকারের ধাক্কায় নিহত শিশু ইয়াসিনের দাদা মফিজ মিয়া। বৃহস্পতিবার (২৮ ডিসেম্বর) ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে মফিজ মিয়ার সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল তখন একই দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত তার ছেলে সুমনের অবস্থা সংকটাপন্ন। হাসপাতালের ১০১ নং ওয়ার্ডে (ক্যাজুয়ালটি) তার চিকিৎসা চলছে। নাতিকে হারিয়ে দিশেহারা মফিজ মিয়া এখন প্রাণান্ত করছেন ছেলের জীবন বাঁচানোর জন্য। তার সঙ্গে ছোটাছুটি করছেন ছোট ছেলে সুজনও।

খিলক্ষেতের ওই দুর্ঘটনায় মফিজ মিয়ার নাতি শিশু ইয়াসিনের পাশাপাশি মারা যান আমরিনা হক (২৭) নামে এক নারী ও উজ্জ্বল পান্ডে (২৬) নামে এক পুরুষ।

নিহত শিশু ইয়াসিন (৮) মোহাম্মদপুরের একটি মাদ্রাসায় পড়াশোনা করত। ইয়াসিনের বাবা ও মফিজ মিয়ার ছেলে সুমন মিয়া রাজমিস্ত্রির কাজ করেন।

মফিজ মিয়া বলেন, ‘ফোন পাওয়ার পর হাসপাতালে এসে দেখলাম আমার ছেলে সুমনের শরীর ক্ষতবিক্ষত। রক্ত বের হচ্ছে সারা শরীর থেকে। ওর একপাশের মাংস আরেকপাশে চলে গেছে। ডাক্তাররা বলছেন দ্রুত ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যান। এদিকে খোঁজ নিয়ে শুনি আমার নাতি (সুমনের ছেলে) এই এক্সিডেন্টে ঘটনাস্থলেই মারা গেছে। ছেলেকে নিয়ে ঢাকা মেডিকেলে যাব নাকি নাতির লাশ আনব; আমি বুঝতে পারছিলাম না। আমি তো পাথর হয়ে গিয়েছিলাম।’

বাবা মার সঙ্গে শিশু ইয়াসিন/ ছবি : ঢাকা পোস্ট

পেশায় নিরাপত্তাকর্মী মফিজ মিয়া নিকুঞ্জের ১৩ নং রোডের ৪১ নং বাড়িতে কাজ করেন। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, মোহাম্মাদপুর থেকে আমার ছেলে আর নাতি আমাকে দেখতে খিলক্ষেতে এসেছিল। আসার সময় ভুনা খিচুড়ি আর শীতের পিঠা নিয়ে আসে। আমি সেসব খাবার রেখে তাদের সঙ্গে গল্প করি। নাতি ইয়াসিন বলেছিল দাদা আমার ক্ষুধা লাগছে। আমি ওরে (ইয়াসিনকে) একটা চিপস আর পাঁচটা জুস কিনে দিয়েছিলাম। চিপসটা আমার ওখানে বসেই খেয়েছে। কিন্তু জুস বাসায় গিয়ে খাবে বলে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল। জুস ও খুব পছন্দ করত। ইয়াসিনের আর সেই জুস খাওয়া হলো না। সেই জুস পড়ে আছে; শুধু আমার নাতিটা নেই- বলেই ডুকরে কেঁদে ওঠেন মফিজ মিয়া।

মফিজ মিয়া বলেন, আমার ছেলে আর নাতি বের হয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর আমি খেতে বসি। খাবার শেষে যখন উঠব তখনই কল আসে, খবর পাই দুর্ঘটনার।

তিনি বলেন, ঢাকা মেডিকেলে এসে সিট পাইনি, ফ্লোরেই ছেলের চিকিৎসা চলছে। একদিকে রক্ত দিচ্ছে আরেক দিক দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। আমি ডাক্তারকে বললাম স্যার আপনারা ব্লাড বন্ধ করেন। তারা বলে, আপনারা রোগীকে পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে যান, এটা করেন-ওটা করেন...। নাতি তো দুনিয়া থেকে চলে গেছে। এখন ছেলেকে বাঁচাতে পারি কি না শেষ চেষ্টা করছি। শেষ যখন নাতির সঙ্গে কথা হয় তখন সে বলেছিল দাদু আমার ক্ষুধা লাগছে। ওর কথাটা কানে বাজছে।

মফিজ মিয়া জানান, শিশু ইয়াসিনের নানা বাড়ি বরিশালে আর তাদের বাড়ি নোয়াখালীতে। লাশ কোথায় দাফন করা হবে তা এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি। অনেকে তাকে বলছেন বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করার জন্য। সেখানেই দাফন করা হতে পারে।

তিনি বলেন, আমার নাতিকে যারা নির্মমভাবে হত্যা করেছে, ছেলের জীবনকেও কেড়ে নিচ্ছে আমি তাদের বিচার চাই। ক্ষতিপূরণ চাই। এ দেশের সাধারণ মানুষ কোনো বিচার পায় না। বড়লোকের টাকা আর ক্ষমতার কাছে মানুষ জিম্মি। আমার তো টাকা নেই ক্ষমতাও নেই। গরিবকে মেরে ধনীরা পার পেয়ে যায় এই দেশে।

‘আমার ছেলের অবস্থাও খুব খারাপ। দুই হাত ভেঙে গেছে। তার এক দিকের মাংস অন্যদিকে চলে গেছে। মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছে। কোমরেও আঘাত। ডাক্তাররা শুধু বলে ব্লাড লাগবে ব্লাড লাগবে। আমার ছেলের রক্তের গ্রুপ ও নেগেটিভ। সারা রাত মানুষকে ফোন দিয়ে ব্লাড খুঁজেছি। পরে সাড়ে চার হাজার টাকা করে ৯ হাজার টাকা দিয়ে দুই ব্যাগ ব্লাড কিনেছি। একদিক দিয়ে ব্লাড দিচ্ছে আরেক দিক দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। আমি বেতন পেয়েছি ১০ হাজার টাকা। দুই ব্যাগ ব্লাডেই শেষ হয়ে গেল ৯ হাজার!’-বলেন মফিজ মিয়া।

সুমনের বাসার পাশের মুদি দোকানদার শাহেদ হোসেন এসেছেন তাকে দেখতে। তিনি বলেন, ‘বাচ্চাটা (নিহত ইয়াসিন) আমার দোকানে প্রায়ই যেত। গতকাল সন্ধ্যায় মারা যাওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগেও আমার সঙ্গে কথা বলেছে। আমার দোকানে গেছে। মাদ্রাসা ছুটি তাই বাবার সঙ্গে বাড়ি যাবে বলেছিল।’ 

মায়ের সঙ্গে শিশু ইয়াসিন/ ছবি : সংগৃহীত

টঙ্গী বাজারে ছোট ব্যবসা করেন নিহত ইয়াসিনের ছোট চাচা সুজন। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, কলিজাটা পুড়ে যাচ্ছে। দেখাতে পারছি না। রাত ৮ টায় ওরা আমার আব্বাকে দেখে বের হইছিল। আর ৯ টায় আমার ভাতিজা নেই। ভাইয়ের একমাত্র ছেলে ইয়াসিন। সে আজ নেই, কীভাবে নেনে নিই বলেন।

সুজন বলেন, আমি ছোট চাচা। ইয়াসিনকে অনেক আদর করতাম। ইয়াসিনও আমাকেও খুব ভালোবাসত। ফোন দিলেই কাকু কাকু করে চিল্লাইতো। এখন আর কেউ চিল্লাইব না। 

উল্লেখ্য, বুধবার (২৭ ডিসেম্বর) রাত ৯টার দিকে রাজধানীর খিলক্ষেত ফুটওভার ব্রিজের নিচে প্রাইভেটকারের ধাক্কায় নারী-শিশুসহ তিনজন নিহত হন। তাদের একজন ছিল শিশু ইয়াসিন। 

খিলক্ষেত থানার উপ-পরিদর্শক মোশারফ বলেন, রাত ৯টার দিকে বিমানবন্দরের দিক থেকে আসা একটি বেপরোয়া প্রাডো জিপ (ঢাকা মেট্রো-১৫-২৫৯১) ফুটওভার ব্রিজের নিচে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পথচারীদের ওপর উঠে পড়লে হতাহতের এ ঘটনা ঘটে।

এমএম/এসকেডি