মরদেহ দাফন করছেন গাউসিয়া কমিটির সদস্যরা

আম্বিয়া বেগম (ছদ্মনাম)। চট্টগ্রামের এক ব্যবসায়ীর মা। জ্বর ও শ্বাসকষ্ট হওয়ার পরপরই তাকে চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। দুই দিন চিকিৎসার পর হাসপাতালেই মারা যান তিনি। মৃত্যুর পরও তার কাছে ঘেঁষে না কেউ।

অদৃশ্য ঘাতক করোনাভাইরাসের ভয়ে তার জানাজার ব্যবস্থাও করেনি কেউ। সবাই যখন এভাবে দূরে দূরে সরে যাচ্ছিল, তখনই এগিয়ে আসে গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ। আজীবনের সঙ্গীরা স্বার্থপরের মতো আম্বিয়াকে একা রেখে গেলেও শেষ বিদায়ের সঙ্গী ছিল এই গাউসিয়া কমিটিই।

শুধু আম্বিয়া নন, করোনাকালে হঠাৎ স্বজনহীন হয়ে যাওয়া এমন অসংখ্য মানুষের শেষ বিদায়ের সঙ্গী ছিল এই গাউসিয়া কমিটি। চট্টগ্রাম থেকে শুরু করা এই কাজ ছড়িয়েছে এখন দেশের বিভিন্ন স্থানে।

গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশের করোনায় মৃতদের কাফন-দাফন-সৎকার কর্মসূচির প্রধান সমন্বয়ক মোছাহেব উদ্দিন বখতেয়ার ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনার চরম মানবিক সংকটে গাউসিয়া কমিটি এগিয়ে এসেছে। মৃতের পাশে কেউ না থাকলেও শেষ বিদায়ের সঙ্গী হয়েছে গাউসিয়া কমিটি। শুধু দাফন কিংবা সৎকার নয়, অ্যাম্বুলেন্স ও অক্সিজেন নিয়েও আক্রান্তদের পাশে থেকেছে এটি।

গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশের তথ্য মতে, গত বছর ১৩ এপ্রিল থেকে করোনা আক্রান্ত মানুষের দাফন-কাফনের কাজ শুরু করে এটি। এখন পর্যন্ত সারাদেশে করোনাকালে দাফন সহায়তা করা হয়েছে দুই হাজার ৩৫৮ জনকে। তন্মধ্যে শুধু চট্টগ্রামেই এক হাজার ৯৩৬ জনকে দাফনে সহায়তা করা হয়। এছাড়া সৎকার সহায়তা দেওয়া হয় ২৯ জন হিন্দু ও ৩ জন বৌদ্ধকে।

দাফন সহায়তা পাওয়াদের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন ৩৫ জন। এছাড়া অজ্ঞাত মরদেহ ছিল ১৩ জনের। এর মধ্যে করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া মানুষের পাশাপাশি আছেন করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়ারাও। এছাড়া করোনাকালে এমনিতে মৃত্যুবরণ করা মানুষের নামও আছে গাউসিয়া কমিটির দাফন-কাফনের তালিকায়। দাফন-সৎকারের পাশাপাশি গাউসিয়া কমিটি অক্সিজেন সেবা দিয়েছে ১৩ হাজার ৭৯৭ জনকে। অ্যাম্বুলেন্সে সেবা দিয়েছে দুই হাজার ৬৭৮ জন রোগীকে। 

প্রায় দেড় হাজার স্বেচ্ছাসেবক এই কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। পুরুষের পাশাপাশি নারী স্বেচ্ছাসেবীও রয়েছে গাউসিয়া কমিটিতে। করোনা আক্রান্ত বা উপসর্গ নিয়ে কোনো নারী মারা গেলে তাদের গোসল থেকে শুরু করে বাকি কাজ করে থাকেন নারী স্বেচ্ছাসেবীরা। বর্তমানে চট্টগ্রামের প্রতিটি থানাতেই তাদের টিম রয়েছে।

কাজের প্রক্রিয়া সম্পর্কে গাউসিয়া কমিটি জানায়, করোনা আক্রান্ত বা করোনা উপসর্গ নিয়ে কেউ মারা গেলে তাদের স্বজনরা ফোনে কমিটিকে জানান। তখন মরদেহ হাসপাতাল কিংবা বাসা থেকে গ্রহণ করা হয়। গোসল করানো, কাফন পরানো, জানাজা এবং সবশেষে দাফন করা হয়।

মোছাহেব উদ্দীন বখতিয়ার বলেন, করোনা আক্রান্ত হয়ে কেউ মারা গেলে মরদেহের দাফন কাফনে খুবই কম পাওয়া যায় আত্মীয়-স্বজনদের। এক বছরের বেশি সময় কেটে গেলেও এখনও মানুষের করোনাভীতি কাটেনি। গত রোববার (১৮ এপ্রিল) চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে এক ব্যক্তির (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) মা মারা যান। তাকে কাছে যাওয়ার জন্য ডাকলেও তিনি যাননি। শুধু ছেলেই নন, স্বজনদের কেউই মরদেহ স্পর্শ করেননি। ফলে স্বেচ্ছাসেবকরা সব কাজ করেন। সাম্প্রতিক সময়ে এরকম অনেক ঘটনা ঘটছে। সবকিছু আমরা করার পরও লাশের কাছে আসতে চান না আত্মীয়-স্বজনরা। 

বর্তমানে কাজ কিছুটা ব্যাহত হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, দাফন কাজে ব্যবহারের জন্য চারটি আম্বুলেন্স থাকলেও বর্তমানে তিনটি দিয়ে কাজ করতে কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। দাফন-কাফনের খরচ কীভাবে ব্যবস্থা করেন এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মূলত আঞ্জুমান ই রহমানিয়া ট্রাস্ট আমাদের সহায়তা দিয়ে থাকে। এছাড়া কেউ স্বেচ্ছায় কিছু দিতে চাইলে আমরা তা গ্রহণ করি। 

দাফনের সময়ে আত্মীয়-স্বজনরা কাছে আসতে চান না এখনও। দূর থেকে দাঁড়িয়ে বলেন, দিয়ে দেন। তবে সবচেয়ে আশ্চর্য বিষয় হল, এক বছর চরম ছোঁয়াচে এই রোগের সঙ্গে কাজ করলেও এখন পর্যন্ত গাউসিয়া কমিটির কোনো স্বেচ্ছাসেবী করোনায় আক্রান্ত হননি। এমনকি কেউ অসুস্থও হননি বলে জানান মোছাহেব উদ্দীন বখতিয়ার।

গাউসিয়া কমিটির স্বেচ্ছাসেবক দলে কাজ করা আব্দুল্লাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত, করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন, এরকম দুইশ জনের দাফন-কাফনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলাম। এছাড়া এখন এমনিতে মারা গেলে মানুষ দাফন-কাফনের জন্য আমাদের ফোন দেয়। সেগুলোও আমরা করি। 

কেএম/আরএইচ