রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হয়েছে বাঙালির প্রাণের মেলা অমর একুশে গ্রন্থমেলা। বই ও লেখকদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কটা আত্মিক বলেই হয়তো এর নাম প্রাণের মেলা। মাসব্যাপী চলা এ মেলা শুরুতে দেশে নিষিদ্ধ কয়েকটি বই সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।

ইতিহাস বিকৃতি, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, রাজনৈতিক বিতর্ক বা অশ্লীলতার মতো কারণ দেখিয়ে দেশে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বইকে নিষিদ্ধ বা মুদ্রণ, প্রকাশনা, বিতরণ ও বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল কর্তৃপক্ষ। আবার কোনো কোনো বই প্রকাশের পর বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল।

সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়, বাংলা একাডেমি ও প্রকাশকদের কাছ থেকে নিষিদ্ধ এবং বাজেয়াপ্ত এসব বইয়ের সঠিক সংখ্যা সম্পর্কে কোনো ধারণা পাওয়া যায়নি। প্রকাশনা খাত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশে নিষিদ্ধ বইয়ের সংখ্যা খুব বেশি নয়।

স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম বই নিষিদ্ধ হয় নব্বইয়ের দশকে। তবে, স্বাধীনতার কয়েক বছরের মধ্যেই কবিতা লিখে আলোচনা ও বিতর্কের জন্ম দিয়ে এক পর্যায়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন কবি দাউদ হায়দার। সেই সময় দাউদ হায়দারের বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে একটি মামলাও দায়ের করা হয়।

আলোচিত ‘কালো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নায় কালো বন্যায়’ নামে কবিতাটি ১৯৭৪ সালে দৈনিক সংবাদ পত্রিকার সাহিত্য পাতায় ছাপা হয়েছিল।

বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে নিষিদ্ধ বা বাজেয়াপ্ত হওয়া কয়েকটি বই হলো:

নারী : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের লেখা ‘নারী’ বইটি স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে যেসব বই নিষিদ্ধ হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম আলোচিত নন-ফিকশন বই। এটি ১৯৯২ সালে একুশে বইমেলায় প্রথম প্রকাশিত হয়। নারীবাদ নিয়ে লেখা ৪০৮ পৃষ্ঠার বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর পরই ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়।

বইটি ইসলাম ধর্ম এবং ধর্মবিদ্বেষী বলে অভিযোগ করে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের একজন কর্মকর্তা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বইটি বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করার জন্য আবেদন করেন। এরপর ১৯৯৫ সালের ১৯শে নভেম্বর তৎকালীন সরকার বইটি নিষিদ্ধ করে।

লজ্জা : ভারতে বসবাসরত বাংলাদেশি নারীবাদী লেখক তসলিমা নাসরিনের বেশ কয়েকটি বই নিষিদ্ধ হয়েছে। তার লেখা ‘লজ্জা’ উপন্যাসটি ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত হয়, এবং প্রকাশনার ছয় মাসের মাথায় বইটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এই বইটিকেই বাংলাদেশে প্রথম নিষিদ্ধ বই হিসেবে দাবি করা হয়। উপন্যাসটি ভারতের বাবরি মসজিদ ভাঙার ঘটনাকে কেন্দ্র করে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রেক্ষাপটে লেখা হয়েছিলে।

‘ক’ : তসলিমা নাসরিনের লেখা আরেকটি বই ‘ক’ ২০০৩ সালে প্রকাশিত এবং নিষিদ্ধ হয়। লেখক বইটিকে আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস বলে বর্ণনা করেছেন। বইটিতে তিনি বিভিন্ন সময়ে তার নিজের ওপর ঘটা যৌন নিপীড়নের কথা তুলে ধরেছেন। এতে বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন পরিচিত লেখক, শিল্পী, সাহিত্যিকের নাম উল্লেখ করেছিলেন তিনি।

অবশ্য অভিযুক্তরা সবাই যৌন নিপীড়নের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তাদের মধ্যে একজন তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে ১০০ কোটি টাকার একটি মানহানির মামলা করেছিলেন, এবং মামলাটি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত বই বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা দেন আদালত। পরে ২০১৫ সালে সেই মামলাটি আদালত খারিজ করে দেন।

‘আমার ফাঁসি চাই’ : বাংলাদেশে ১৯৯৯ সালের মার্চে ‘আমার ফাঁসি চাই’ নামক একটি বই প্রকাশিত হয়, এবং অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সরকার বইটি নিষিদ্ধ করে। বইয়ের মাধ্যমে লেখক মতিয়ুর রহমান রেনটু ইতিহাস বিকৃতি এবং রাজনৈতিক বিতর্ক ছড়িয়েছেন— এমন অভিযোগে বইটি নিষিদ্ধ করা হয়।

‘রেভোলিউশন, মিলিটারি পারসোনেল অ্যান্ড দ্য ওয়ার অব লিবারেশন ইন বাংলাদেশ’ : ২০২০ সালে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি এলডিপি সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমদের লেখা ‘রেভোলিউশন, মিলিটারি পারসোনেল অ্যান্ড দ্য ওয়ার অব লিবারেশন ইন বাংলাদেশ’ নামে একটি বই নিষিদ্ধ ও বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। বইটি ২০০৮ সালে প্রকাশিত হয়।

সূত্র : বিবিসি বাংলা

কেএ