শুরু হয়েছে অমর একুশে বইমেলা-২০২৪। পুরোদমে বেচাকেনা শুরু না হলেও ইতোমধ্যেই বেশ জমে উঠেছে এবারের বইমেলা। মেলা থেকে বই কিনতে স্টলে স্টলে ঘুরছেন ক্রেতারা। খোঁজ করছেন নতুন গল্প, কবিতা, উপন্যাসের বই। পাঠকদের হাতে প্রিয় বই তুলে দিচ্ছেন একদল বিক্রয়কর্মী। আর এসব বিক্রয়কর্মীদের অধিকাংশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইডেন মহিলা কলেজ, ঢাকা কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত। মাসজুড়ে বইমেলা হওয়ায় পড়াশোনার পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা খণ্ডকালীন চাকরিতে আয়ের সুযোগ পেয়েছেন।

বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ এবং ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান মিলে প্রায় সাড়ে ১১ লাখ বর্গফুট জায়গাজুড়ে এবার আয়োজন করা হয়েছে অমর একুশে বইমেলা। এখানে থাকছে ৬৩৫টি প্রতিষ্ঠান এবং ৩৭টি প্যাভিলিয়ন। একাডেমি প্রাঙ্গণে ১২০টি প্রতিষ্ঠানকে ১৭৩টি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে ৫১৫টি প্রতিষ্ঠানকে ৭৬৪টি ইউনিটসহ মোট ৬৩৫টি প্রতিষ্ঠানকে ৯৩৭টি ইউনিট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

মেলায় অংশ নেওয়া প্রকাশনী ও প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের বই প্রদর্শন ও বিক্রির জন্য চুক্তিভিত্তিক খণ্ডকালীন কিছু বিক্রয়কর্মী এবং জনবল নিয়োগ দিয়ে থাকে। খণ্ডকালীন চাকরির এই বিশাল বাজারে সাধারণত বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরাই কাজের সুযোগ পেয়ে থাকেন। ফলে পড়াশোনার পাশাপাশি খণ্ডকালীন চাকরিতে আয়ের সুযোগ তৈরি হয়েছে কয়েক হাজার শিক্ষার্থীর। 

বইমেলার প্রতিটি স্টলভেদে ৩-৩০ জন বিক্রয়কর্মী কাজ করছেন। কাজের ধরনের ওপর ভিত্তি করে দেওয়া হচ্ছে সম্মানীও। এছাড়াও কিছু ক্ষেত্রে বাড়তি সুযোগ সুবিধাও রয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় এবছরও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও প্রকাশনীর হয়ে প্রায় কয়েক হাজার তরুণ-তরুণী বইমেলায় খণ্ডকালীন চাকরি করছেন ও আয় করছেন।

আয়ের পাশাপাশি একজন শিক্ষার্থী খণ্ডকালীন কাজ করে অভিজ্ঞতাও অর্জন করছেন। যা ভবিষ্যতে কর্মক্ষেত্রে সুফল বয়ে আনবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

বাতিঘর প্রকাশনীর ম্যানেজার তারেক আব্দুর রব বলেন, একজন শিক্ষার্থী যখন বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজ শুরু করে প্রথমে সে ধৈর্য ধরতে শেখে। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার, নানা বয়সী মানুষের সঙ্গে কথা বলার মত যোগ্যতা অর্জন করে। একজন ক্রেতাকে রাজি করিয়ে পণ্য বিক্রি করার মতো যোগ্যতা অর্জন করে। 

তিনি বলেন, একজন শিক্ষার্থী বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজ করলে মাস শেষে তারা ভালো মানের একটা টাকা আয়ের পাশাপাশি জ্ঞান অর্জনও করতে পারে। যখন একজন ক্রেতা কোনো বই সম্পর্কে জানতে চায় তখন বিক্রয়কর্মীরা বইয়ের কয়েক পৃষ্ঠা পড়ে জানার চেষ্টা করে। যা তাদের জ্ঞান বৃদ্ধির পাশাপাশি পরে চাকরির বাজারেও প্রভাব ফেলে। তারা দীর্ঘ সময় একটানা কাজ করতে শেখে যা তাদের পরবর্তী জীবনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যান লেকের পাড় ধরে হাঁটতে থাকলে এক কোণে চোখে পড়বে শিশুদের জন্য বই নিয়ে গড়ে উঠা স্টল ‘স্বরবৃত্ত প্রকাশন’। এখানে বিক্রয়কর্মী কাজ করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি অ্যান্ড বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী মো. জাকারিয়া। তিনি বলেন, এখানে কাজ করার ফলে যে অভিজ্ঞতা হচ্ছে সেটা ভবিষ্যৎ জীবনে চাকরির বাজারে কাজে লাগবে। মাস শেষে শুধু টাকাই না, বরং টানা ৭-৮ ঘণ্টা কাজ করার ফলে গ্রাহকদের ডিল করার মতো যোগ্যতা একজন বিক্রয়কর্মী অর্জন করে, যা তাদের চাকরির দৌড়ে এগিয়ে রাখে। 

কয়েকটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিক্রয়কর্মী নিয়োগের জন্য পত্রপত্রিকায় তেমন একটা বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় না। প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বইমেলায় কাজের জন্য প্রার্থীদের কাছ থেকে সিভি চাওয়া হয়। এ ছাড়া ব্যক্তিগত যোগাযোগ ও প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের নির্দিষ্ট বইয়ের দোকান থেকেও সিভি নেওয়া হয়। বিভিন্ন মাধ্যম থেকে জেনে শিক্ষার্থীরা সিভি জমা দিয়ে বইয়ের স্টলে কাজ পেয়ে থাকেন। 

বাতিঘর প্রকাশনীর বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজ করছেন ইডেন মহিলা কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মঞ্জুয়ারা মিম। তিনি বলেন, যখন শুনলাম বইমেলায় বিক্রয়কর্মী নিয়োগ দেওয়া হবে তখন আমি বাতিঘর পাবলিকেশনে সিভি জমা দেই। পরবর্তীতে বাংলামোটরে বাতিঘরের অফিসে আমার মৌখিক ভাইভা অনুষ্ঠিত হয়। ভাইভায় উত্তীর্ণ হলে আমাকে বিক্রয়কর্মী হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। 

তিনি বলেন, একজন শিক্ষার্থী হিসেবে ফেব্রুয়ারি মাসটা একটা বড় সুযোগ আমাদের জন্য। আমরা মোটামুটি ভালো পরিমাণে আয় করতে পারি যা অন্য মাসে খুব একটা হয়ে উঠে না। আমার মতো প্রায় হাজারো শিক্ষার্থী এই বইমেলায় খণ্ডকালীন চাকরি করে টাকা আয় করছে।

বইমেলার সময়সূচি অনুযায়ী কাজের সময় নির্ধারিত হয়। মেলা বেলা তিনটা থেকে শুরু হওয়ায় কাজও শুরু হয় বিকেল থেকেই। তবে মেলা শুরুর কিছু সময় আগে বিক্রয়কর্মীদের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য স্টলে যেতে হয়। মেলা রাতে যতক্ষণ চলে, বিক্রয়কর্মীদেরও ততক্ষণ থাকতে হয়। ছুটির দিনগুলোয় মেলা বেলা ১১টা থেকে শুরু হওয়ায় ডিউটিও শুরু হয় ১১টা থেকেই। যেহেতু মেলা টানা এক মাস চলে, তাই সাপ্তাহিক ছুটি ছাড়াই তাদেরকে কাজ করতে হয়।

বইমেলার স্টলগুলোতে প্রতিষ্ঠানভেদে বেতন নির্ভর করে। একেক প্রতিষ্ঠানের বেতন একেক রকম। প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত ১০-১৫ হাজার টাকা বেতন দিয়ে থাকে। তবে যেগুলো বড় প্রতিষ্ঠান, সেগুলোতে বেতন কিছুটা বেশি থাকে। বেতনের বাইরে খাবার ও টি-শার্ট দেওয়া হয়। ছুটির দিনে মেলা যেহেতু সকাল থেকে শুরু হয়, তাই সকাল, দুপুর ও বিকেলের খাবার দেওয়া হয়। অন্য দিনগুলোয় শুধু বিকেলের নাশতা দেওয়া হয়।

ডিউটি প্রসঙ্গে মিম বলেন, মেলা শুরু হয় ৩টায়। তবে আমাদেরকে আড়াইটায় আসতে হয়। মেলা সাড়ে আটটায় শেষ হয়, আমরা ৯টার দিকে সবকিছু গুছিয়ে চলে যাই। তাছাড়া ছুটির দিনে সকাল ১১টায় মেলা শুরু হলে আমাদের সাড়ে ১০টায় উপস্থিত থাকতে হয়। 

বেতন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, খণ্ডকালীন হিসেবে বেশ ভালোই বেতন দেওয়া হয়। মোটামুটি ১০ হাজার টাকা থেকে বেতন শুরু হয় এবং কাজের ভিত্তিতে পরে বৃদ্ধি করা হবে বলে জানানো হয়েছে।

কথাপ্রকাশ প্যাভিলিয়নের সাপ্লাই অ্যান্ড সেলস অফিসার জাফিরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের এখানে মোট ১৯ জন বিক্রয়কর্মী কাজ করছেন। তাদের কয়েকজন গতবছর এখানে কাজ করেছিলো, সে হিসেবে পুনরায় নিয়োগ পেয়েছে। বাকিদেরকে সিভি জমা দেওয়ার পরে মৌখিক ভাইভা নেওয়া হয়েছে। ভাইভায় আমরা তাদেরকে কাজের ধরণ, ছুটিবিহীন এক মাস কাজ করা, টাইম শিডিউল ও বেতন সম্পর্কে অবহিত করি। এসবে তারা আমাদের সঙ্গে ঐক্যমতে আসার পরে আমরা তাদের নিয়োগ দিয়েছি।

বেতন কাঠামো সম্পর্কে তিনি বলেন, আমাদের এখানে ১২ হাজার থেকে শুরু করে বেতন দেওয়া হয়। তবে পরবর্তীতে তাদের পারফমেন্সের উপর ভিত্তি করে বেতন বৃদ্ধি ও মাসিক ভাতা দেওয়া হবে। 

খণ্ডকালীন বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজ করে ভবিষ্যতে শিক্ষার্থীরা কী সুফল ভোগ করবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভবিষ্যতে শিক্ষার্থীরা যদি বই নিয়ে কাজ করতে চায় তাহলে তারা একটা বিস্তারিত ধারণা পাবে। তাছাড়া বই সম্পর্কে শিক্ষার্থীরা একটি স্বচ্ছ ধারণা পেয়ে থাকে। এখানে কাজ করার সুবাদে একজন পাঠককে ডিল করার ক্ষমতা তারা অর্জন করে। কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে এই মাস অতিবাহিত করার পরে তারা চাকরি জীবনের কাজের অভিজ্ঞতা লাভ করে।

কেএইচ/পিএইচ