শাহনাজ বেগম

শাহনাজ বেগম। রাজধানীর মিরপুর-৬ নম্বরে একটি বস্তিতে থাকেন। মানুষের বাসা-বাড়িতে কাজ করেন। তার স্বামী পেশায় বাসচালক। সরকারের কঠোর বিধিনিষেধের কারণে গণপরিবহন বন্ধ। পাশাপাশি বেশিরভাগ বাসা-বাড়ির কাজও বন্ধ। ফলে আর্থিক অনটনে পড়েছে শাহনাজের পরিবার। 

শাহনাজ বলেন, ‘করোনায় মরে গেলে যাব তারপরও যেন গাড়ি চালু করা হয়। গাড়ি না চললে আমরা খাবারের অভাবেই মরে যাব।’

ঢাকা পোস্টের সাথে তার একান্ত আলাপচারিতায় উঠে আসে করোনার কারণে দেয়া সরকারি বিধিনিষেধে নিম্ন আয়ের মানুষের দুর্দশার ছবি। শাহনাজ বলেন, ‘সরকার লকডাউন দেওয়ার পর থেকে আমার স্বামী কোনো কাজ করতে পারছেন না। ১৪ এপ্রিল থেকে আমার স্বামী ঘরে বসা। পরিবারের আয়-ইনকাম সব বন্ধ। জমানো টাকাগুলোও শেষ হয়ে গেছে। কোনো রকমে খেয়ে রোজা রাখছি। ইফতারেও সেভাবে কিছু খেতে পারছি না। অনেক কষ্টে সংসার চলছে।’

তিনি বলেন, ‘গতবছর লকডাউনের সময় অনেক মানুষ বিভিন্ন অনুদান ও সহায়তা করেছে। কিন্তু এবার এতদিন হয়ে গেলেও কোনো অনুদান বা সহায়তা পাইনি। এছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কিছুই দেওয়া হয়নি। বর্তমানে না খেয়ে জীবন পার করার মতো অবস্থা তৈরি হয়েছে।’

সরকারের কাছে আপনাদের দাবি কী? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘করোনায় মরে গেলে কোনো সমস্যা হবে না। মরে গেলে কোনো আফসোসও থাকবে না। তারপরও যেন গাড়ি চালু করা হয়। আমাদের কি পেট নেই? আমাদেরও ক্ষুধা লাগে, খেতে হয়। সরকার মনে করে, আমাদের পেট নেই। এই জন্য গাড়ি বন্ধ রাখছে।’

গত বছরের শেষের দিকে দেশব্যাপী খানা জরিপের ভিত্তিতে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) জানায়, করোনাভাইরাসের প্রভাবে বাংলাদেশে সার্বিক দারিদ্র্যের হার বেড়েছে। ২০২০ সালে দারিদ্র্যের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২ শতাংশ। যা ২০১৮ সালে ছিল ২৪.৫ শতাংশ। সে হিসাবে দুই বছরের ব্যবধানে দারিদ্র্যের হার প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে।

সানেম জানায়, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৬ সালের তথ্য অনুযায়ী দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ২৪.৩০ শতাংশ। ২০১৮ সালে জিইডি ও সানেমের গবেষণা অনুযায়ী দেশের এই দারিদ্র্যের হার দাঁড়ায় ২১.৬০ শতাংশ। কিন্তু সানেমের ২০২০ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরের গবেষণায় দারিদ্রের হার বেড়ে ৪২ শতাংশ দাঁড়িয়েছে। 

সানেমের তথ্যানুযায়ী, করোনার প্রভাবে দারিদ্র্যের হার বেড়ে যাওয়ায় মানুষ খাদ্যবহির্ভূত ব্যয় কমিয়েছে। পাশাপাশি অনেকে সঞ্চয় ভেঙে জীবন নির্বাহ করছেন। কেউ ঋণ নিয়েছেন, আবার কেউ খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এনেছেন।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্ট্যাডিজির (বিআইডিএস) ফেলো অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, করোনার প্রাদুর্ভাবে মৃত্যুর হার ১০ থেকে ১৫। বাকি ৮৫ ভাগ সুস্থ হয়ে যাবে। কিন্তু দারিদ্র্যের কষাঘাতে অপুষ্টির শিকার হলে ধুঁকে ধুঁকে মরতে হবে অনেক মানুষকে। লকডাউনে স্বচ্ছল মানুষেরা বড় বাসায় সামাজিক দূরত্ব মানতে পারে। কিন্তু ঝুপড়ি ঘরে বা বস্তিতে থাকা মানুষগুলো লকডাউনে একে অন্যের সাথে গাদাগাদি করে থাকতে বাধ্য হয়। এখানে সামাজিক দূরত্ব বলে কিছুই থাকে না।

অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ

তিনি বলেন, ‘লকডাউন দিলে মৃত্যু ঝুঁকি কমানোর শান্তিতে থাকে সচ্ছল মানুষ। কিন্তু ক্ষুধার যন্ত্রণায় ভোগা দরিদ্র মানুষদের জন্য লকডাউন কোনো শান্তির বার্তা আনে না। তারা করোনার ঝুঁকি নিতে রাজি, কিন্তু ক্ষুধার যন্ত্রণায় ভুগতে রাজি নয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘করোনার কারণে শিক্ষায় যে ধনী-দরিদ্র বৈষম্য তৈরি হয়েছে তাতে ভবিষ্যৎ আয়-বৈষম্য আরও বাড়বে। লকডাউন ধনী-বান্ধব, দরিদ্রবান্ধব নয়। সরাসরি খাদ্য সহায়তা দিয়ে অতি দরিদ্রদের হয়তো বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব। কিন্তু খাদ্য সহায়তা না দিলে তো মানুষ না খেয়েই মারা যাবে। এজন্য জীবন-জীবিকার সমন্বয় আনতে হলে এখনই সার্বিক পরিকল্পনা নিতে হবে। বারবার লকডাউন দিলে অর্থনৈতিক ক্ষতির বোঝা আরও বাড়বে।

এসআর/ওএফ/জেএস