বরগুনা সদরের পূর্ব হাজার বিঘা বটতলা সিনিয়র মাদরাসা এমপিওভুক্ত হলেও কয়েকজন শিক্ষকের বিল আটকা ছিল। প্রতিষ্ঠানটির প্রিন্সিপাল মো. আব্দুস সালাম অনেক চেষ্টা তদবির করছিলেন শিক্ষকদের বিল করানোর জন্য। তদবিরের খবরে নিজে থেকে যোগাযোগ করেন মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের উপ-সচিব ও প্রোগ্রাম অফিসার পরিচয়ে দেওয়া দুজন।

কয়েক দফায় ২০২১ সালে মোট ১৪ লাখ টাকা নিলেও বিল হয়নি। পরবর্তীতে যোগাযোগ না করে বদলে ফেলেন সিমও। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হবার পর সন্দেহ হলে খোঁজ-খবর নেন প্রিন্সিপাল আব্দুস সালাম। জানতে পারেন জুবায়ের বা আসাদুজ্জামান মানিক এবং আব্দুল গফফার বা সুমন চৌধুরী নামে কেউ নেই মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তরে।

শুধু প্রিন্সিপাল আব্দুস সালাম-ই নন, সারাদেশে এমন অন্তত দুই ডজন শিক্ষককে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে হাতিয়ে নিয়েছেন কয়েক কোটি টাকা। কেউই টাকা ফেরত পাননি। প্রতারণার শিকারদের একজন বাদী হয়ে ২০২৩ সালের ৯ ডিসেম্বর বংশাল থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলাটি তদন্ত করছিল পিবিআই।

তদন্তে প্রাপ্ত তথ্য ও প্রতারিতদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে জুবায়ের ওরফে মো. আসাদুজ্জামান মানিক ওরফে লুৎফর রহমানকে (৪৭) গত ১৫ ফেব্রুয়ারি রাত ২টায় গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ থানার ফলগাছা গ্রাম থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অপর সহযোগী আব্দুল গফফার ওরফে সুমন চৌধুরী ওরফে সাইফুলকে (৭৭) রাজধানীর উত্তরা-পশ্চিম থানা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে পিবিআই ঢাকা মেট্রোর (উত্তর) একটি দল।

পিবিআই বলছে, মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের ভুয়া উপ-সচিব, প্রোগ্রাম অফিসার কখনো সিস্টেম এনালিস্টের পরিচয়ে মাদরাসার শিক্ষকদের টার্গেট করে তারা। এরপর এমপিওভুক্তি ও নব নিয়োগপ্রাপ্ত লাইব্রেরিয়ানদের বেতন ভাতাদি নিয়মিত করে দেওয়ার আশ্বাসে চার কোটির বেশি ঢাকা প্রতারণা করে আত্মসাৎ করেছে।

রোববার (১৮ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে আগারগাঁওস্থ পিবিআই ঢাকা মেট্রোর (উত্তর) কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান অতিরিক্ত ডিআইজি মো. জাহাঙ্গীর আলম।

পিবিআই কর্মকর্তা, প্রতারক চক্রটির খপ্পরে পড়েছেন ভোলা চরফ্যাশনের কুচিয়ামোড়া ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার মো. কামরুজ্জামানসহ আছলামিয়া হামেলা খাতুন বালিকা দাখিল মাদরাসা, দক্ষিণ চরফ্যাশন শামছুল উলুম দাখিল মাদরাসা, আমিনাবাদ হাকিমিয়া দাখিল মাদরাসা, আছলামপুর মোহাম্মদীয়া দাখিল মাদরাসা, দক্ষিণ আছলামপুর মোবারক আলী দাখিল মাদরাসা, কুন্ডের হাওলা রাশিদীয়া দাখিল মাদরাসা, নূরাবাদ হোসাইনীয়া ফাজিল মাদরাসা, লালমোহন ইসলামীয়া কামিল মাদরাসা, উওর চরমানিকা লতিফীয়া দাখিল মাদরাসা এবং পূর্ব ফরিদাবাদ ইউনূসীয়া জিহাদূল উলূম দাখিল মাদরাসার শিক্ষক, প্রিন্সিপাল ও সুপাররা প্রতারিত হয়েছেন বলে জেনেছি। এর বাইরে আরও ভুক্তভোগী রয়েছেন।

জাহাঙ্গীর আলাম বলেন, চক্রটি আসলে টার্গেট করে করে খোঁজ নিয়ে ফাঁদ পেতে প্রতারণা করতো। এই চক্রের সম্পর্কে জানা যায় ২০২৩ সালে। তবে তারা ২০১৯ সাল থেকে এ ধরণের অভিনব প্রতারণায় জড়িত।

অতিরিক্ত ডিআইজি জাহাঙ্গীর বলেন, এমপিওভুক্তি বাতিল করার ভয়-ভীতি দেখিয়ে এবং এমপিওভুক্তি বহাল রাখা, আবার কোনো মাদরাসার নব নিযুক্ত লাইব্রেরিয়ানদের বেতন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদরাসা শাখা হতে নিয়মিত করে দেওয়ার কথা বলে সংশ্লিষ্ট মাদরাসার অধ্যক্ষ ও সুপারদের আসাদুজ্জামান মানিকের সঙ্গে সাক্ষাত করতে ঢাকায় ডাকা হয়।

এরপর ২০২১ সালের ২ আগস্ট উল্লেখিত মাদরাসার অধ্যক্ষ ও সুপাররা বিশ্বাস করে সম্মিলিতভাবে বাংলাদেশ সচিবালয়ের বিপরীতে ওসমানী মিলনায়তনের সামনে দেখা করেন জোবায়ের রহমানের সঙ্গে। যিনি নিজেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদরাসা শাখার প্রোগ্রাম অফিসার পরিচয় দেন। সেখান   থেকে মামলার বাদী ভোলা চরফ্যাশনের কুচিয়ামোড়া ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার প্রিন্সিপাল কামরুজ্জামানসহ অন্যান্য মাদরাসার অধ্যক্ষ ও সুপাররা বংশাল থানাধীন রায় সাহেব বাজারে যান।

সেখানে ১২ লাখ টাকা চান জোবায়ের। সেদিন নগদ দেওয়া হয় ৬ লাখ ৯০ হাজার টাকা। বাকি টাকা চারটি মোবাইল নাম্বারে নগদ ও বিকাশের মাধ্যমে আরও মোট ৪ লাখ ৬১ হাজার ১০০ টাকা পাঠান শিক্ষকরা।

তিনি জানান, টাকা দিয়েও কাজ না হওয়ায় ও সকল মাদরাসার শিক্ষক কর্মচারীর বেতন বন্ধ হয়ে যায় ও নিয়োগ প্রাপ্ত লাইব্রিয়ানদের বেতনের অগ্রগতি না দেখতে পেয়ে সবাই খোঁজ নিতে থাকেন। মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তরে খোঁজ-খবর নিয়ে তারা জানতে পারেন জুবায়ের ওরফে আসাদুজ্জামান মানিক নামে কোনো প্রোগ্রাম অফিসার কর্মরত নেই।

পিবিআই ঢাকা মেট্রোর (উত্তর) প্রধান জাহাঙ্গীর বলেন, ভুক্তভোগী শিক্ষকরা নিরুপায় হয়ে এক রকম রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছিলেন। না টাকা ফেরত পাচ্ছিলেন না বেতন-ভাতা। পিবিআই মামলাটি তদন্তের ভার নিয়ে দুই মাসের মধ্যেই মূল দুই প্রতারককে গ্রেপ্তার করে। ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আদালতে উপস্থাপন করলে আদালত আসামিদের দুদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে পিবিআই কর্মকর্তা বলেন, বরগুনার পূর্ব হাজার বটতলা সিনিয়র মাদরাসা থেকে ১৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা, নাটোরের বাগাতিপাড়া টেকনিক্যাল এন্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউট থেকে ৮৫ হাজার টাকা, ভোলার উত্তর চরমানিকা লতিফীয়া দাখিল মাদরাসা  থেকে ১১ লাখ ৬০ হাজার টাকা, জয়পুরহাটের মোহাব্বতপুর আমিনিয়া ফাজিল মাদরাসা থেকে ২ লাখ ৭০ হাজার টাকাসহ আরও অন্যান্য মাদরাসার শিক্ষকদের এমপিওভুক্তি বাতিল করার ভয়-ভীতি দেখিয়ে বিভিন্ন বিকাশ ও নগদ নম্বরে সর্বমোট ৪ কোটি ১ লাখ ১৩ হাজার ৯৭২ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার তথ্য আমরা পেয়েছি।

মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তর বা মন্ত্রণালয়ের কোনো কর্মকর্তার এখানে যোগসাজশ রয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা সেরকম কোনো তথ্য পাইনি। তবে এখানে জুবায়ের ওরফে আসাদুজ্জামান মানিক মূল হোতা। তিনি আব্দুল গফফারকে নানা পরিচয়ে ব্যবহার করতেন। ২০১৯ সাল থেকে তারা শতাধিক ভুক্তভোগী শিক্ষককে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। এরকম আরও অজানা ভুক্তভোগী শিক্ষকদের আমরা যোগাযোগের জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।

পিবিআই ঢাকা মেট্রোর (উত্তর) কার্যালয়ে কথা হয় ভুক্তভোগী বরগুনা সদরের পূর্ব হাজার বিঘা বটতলা সিনিয়র মাদরাসার প্রিন্সিপাল মো. আব্দুস সালামের সঙ্গে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রতিষ্ঠানের ৬ জন শিক্ষকের বিল আটকা ছিল। ভাবিনি এই বিল করাতে গিয়ে ফাঁদে পড়বো। সচিবালয়ের সামনে সাক্ষাত করেছি। ১৪ লাখ টাকা দিয়েছি। বিল তো হয়নি উল্টো পথে বসার দশা হয়েছে। আর কেউ যেন এভাবে লেনদেন না করেন সেই অনুরোধ জানান তিনি।

ভোলা চরফ্যাশনের উত্তর চরমানিকা লতিফিয়া দাখিল মাদরাসা সুপার মো. সালেহ উদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, সাত প্রতিষ্ঠানের জন্য যৌথভাবে ১১ লাখ ৫২ হাজার দিয়েছিলাম। কথা হয়েছিল লাইব্রেরিয়ানদের বিল করে দেবে। ২০২১ সালের ওই লেনদেনের কদিন বাদেই হাওয়া হয়ে যান তারা। মোবাইল ফোন নাম্বার বন্ধ পেয়ে যখন মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তরে খোঁজ নিতে থাকি, তখন টের পেয়ে একটা ভুয়া চিঠি ধরিয়ে দেয়। সেটিতে বিল হয়নি যোগাযোগও আর হয়নি। শেষ পর্যন্ত পিবিআইয়ের দ্বারস্থ হয়ে দুই প্রতারকের দেখা পাই। তিনি দুজনের সর্বোচ্চ ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।

জেইউ/এমএসএ