কেবল খাবার অর্ডার করে বসেছি। হঠাৎ চিৎকার চেঁচামেচি তারপর ধোঁয়া। একটু পর বিকট শব্দ৷ বেড়িয়ে দেখি নিচে আগুন। উপরে উঠে যাই। তারপর বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। চারদিকে অন্ধকার আর প্রচণ্ড ধোঁয়া। মানুষের ছুটোছুটির মধ্যে দেখি অনেকে পুড়ছিল। অবচেতন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখি অনেককে। নিজে বাঁচার অনেক চেষ্টা করি। কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্টের রান্না ঘরের জানালা দিয়ে কার্নিশ থেকে নিচে লাফিয়ে পড়ি। এরপর আমাকে নেওয়া হয় ঢামেক হাসপাতালে।

রাজধানীর বেইলি রোডে কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্ট ভবনের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এ পর্যন্ত ৪৬ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। 

আমিন বলছিলেন, অনেকবার চেষ্টা করি লাফ দিতে পারিনি। কিন্তু পেছনে অনেকের বাঁচার আকুতি ও পুড়তে থাকা দেখে বেঁচে ফেরার চিন্তায় গতরাতে লাফ দিয়েছিলাম। নইলে আমিও হয়তো পুড়ে কয়লা হতাম।
 
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের বাইরে গতরাতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের নিজের সেই ভয়ার্ত অভিজ্ঞতার কথা জানান ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মো. আমিন।

তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি আর মিনহাজ ভাইসহ বেশ কয়েকজন গিয়েছিলাম বেইলি রোডে। আমি আর মিনহাজ ভাই উঠে যাই ভবনটির চতুর্থ তলায় খানা'স রেস্টুরেন্টে। আমরা সেখানে বসি খাবার অর্ডার দিয়ে সেলফিও তুলি। এর কিছুক্ষণ পর চারিদিকে চিৎকার চেঁচামেচি আর ধোঁয়া দেখতে পাই। 

কিছুক্ষণ পর চেঁচামেচি চিৎকার বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু হঠাৎ বিস্ফোরণের শব্দ পাই। তখন রাত ৯ টা ৫০ মিনিটের মতো। সিঁড়ি ধোয়ায় আচ্ছন্ন। উপরে দ্রুত উঠতে থাকি। এরমধ্যেই বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ছুটোছুটিতে মিনহাজ ভাইকে হারিয়ে ফেলি।

আগুন লাগার কিছুক্ষণ আগে সেলফি তুলেছেন আমিন ও মিনহাজ। ছবি- সংগৃহীত

মোবাইলের লাইট জ্বালিয়ে উপরে উঠি আবার নিচে নামি। দেখি নিচে সব আগুনে জ্বলছে। 

তিনি বলেন, অনেকক্ষণ মিনহাজ ভাইকে খুঁজেছি, পাইনি। ফ্লোরে ফ্লোরে কান্নার আওয়াজ, চিৎকার আর বাঁচার আকুতি শুনেছি। মোবাইলের আলোতে দেখেছি অনেককে পুড়তে। বাঁচাও বাঁচাও আকুতি কানে বাজছিল।

সব কেমন যেন দুঃস্বপ্ন লাগছিল। বাঁচার অনেক চেষ্টা করেও কোন উপায় পাচ্ছিলাম না। পরে কোনো রকম নিচে নেমে কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্টে রান্না ঘরের পাশ দিয়ে কার্নিশে উঠে পড়ি। কয়েকবার চেষ্টা করেছি লাফিয়ে পড়তে কিন্তু ভয় পাচ্ছিলাম। আবার পেছন থেকে কান্নার আওয়াজ আর পুড়তে থাকা দৃশ্য দেখে বাঁচার চেষ্টা থেকে লাফ দেই। 

আমিন বলেন, নিচে লাফ দেওয়ার পর আমার মনে হচ্ছিল কোমড় ভেঙে গেছে। দাঁড়াতে পারছিলাম না। হামাগুড়ি দিয়ে কোনো রকম মূল সড়কে আসি। ফোনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র বড় ভাই সৌমিত আহমেদ অরণ্যকে ঘটনা খুলে বলি। এরপর ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের সহায়তা আমাকে নেওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। 

তিনি বলেন, নিচে হামাগুড়ি দিতে দিতে চিৎকার করে অনেকবার মিনহাজ ভাই, মিনহাজ ভাই বলে ডেকেছি কিন্তু কোনো সাড়া পাইনি। তখনো ভেবেছিলাম মিনহাজ ভাই হয়তো বাঁচার জন্য কোথাও ঢুকে পড়েছেন। কিন্তু ভাই যে পুড়ে যাবেন এটা ভাবিনি। হয়তো আমিও পুড়ে কয়লা হতাম, যদি লাফ না দিতাম। 

সৌমিত আহমেদ অরণ্য বলেন, গতকাল রাতে ছোট ভাই আমিন, মিনহাজসহ কয়েকজন রাজধানীর বেইলি রোডে খেতে গিয়েছিলাম। আমিন আর মিনহাজ ছিল উপরে। আমরা কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্ট থেকে নেমে বাইরে যাই। আমার মা বাড়ি যাবে এজন্য আমি আরেক বন্ধু মেহেদি হাসান রিফাতকে নিয়ে শ্যামলী যাই।  

সাড়ে ১০টার দিকে আমিন ফোন করে জানায় যে, সে কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্টের রান্না ঘরের পাশ দিয়ে উপর থেকে নিচে লাফিয়ে পড়েছে। এরপর সে দাঁড়াতে পড়তেছে না, কিন্তু ভবনে মিনহাজ রয়েছে। সে কোমরে ব্যথা পেয়েছে। এরপর আমরা দ্রুত ঘটনাস্থলে ফিরে আসি এবং ফায়ার সার্ভিসের মাধ্যমে আমিনকে রেসকিউ করে হাসপাতালে পাঠাই। 

অরণ্য বলেন, কিন্তু একাধিকবার আমরা মিনহাজের মোবাইল ফোনে কল করেছি। সারারাত ধরে মিনহাজকে খোঁজ করেছি হাসপাতালে খুঁজেছি৷ পরে হাতের ঘড়ি দেখে মিনহাজের মরদেহ সনাক্ত করা হয়।

জেইউ/এমএসএ